‘জানি না কেন এত কাঁদলাম’


নজরুল কবির দীপু : আজাদ তালুকদারের সাথে আমার বন্ধুত্ব সেই ১৯৯০ সাল থেকে, তখন দুজনই স্কুলে পড়তাম। আমাদের মধ্যে ছিল মনের মিল। একজনের সঙ্গে অন্যজনের আগ্রহ বা চিন্তার মিল ছিল। আবার সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদে একে অন্যের পাশে থাকার চেষ্টা ছিল আমাদের মধ্যে।

আজাদের নেতৃত্বে একুশে পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়েছে। সারাদেশের মানুষ এখন একুশে পত্রিকাকে চেনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনন্য প্লাটফর্ম হিসেবে। অকালে আমার এ বন্ধুুটির মৃত্যু আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ, সে আরও দীর্ঘায়ু হলে আমরা আরও বেশি পেতে পারতাম।

আজাদের জীবন ছিল বহুমাত্রিক ও বিপুল অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। ২৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত থেকে সে দেশের সাংবাদিকতা পেশাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনই নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে সাংবাদিকতার বাইরে বহুক্ষেত্রে।

কখনো প্রশাসনের বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছে, কখনো বা চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের আয়োজন করে জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার টানেই সে কলমযোদ্ধা হয়েছিল। দলমত ও বয়সনির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেওয়ার তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল, তা আমাদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

আজাদের পরিচয় বহুমাত্রিক। বিশাল তার কর্মের পরিধি। আজাদ আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছে, তবে তার কর্ম ও আদর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করবে দীর্ঘ দীর্ঘকাল। কর্মের মাঝেই সে বেঁচে থাকবে।

সর্বশেষ আজাদকে দেখতে যখন বিআরবি হাসপাতালের গিয়েছিলাম, তার কেবিনে ঢুকতেই দেখি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, ‘নজরুল, তুই এসেছিস?’

তখন আমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। অনেকক্ষণ দুজনই কাঁদলাম। জানি না কেন এত কাঁদলাম। গত শবে বরাতের রাতে বাবাকে হারালাম; বাবার মৃত্যুতেও মনে হয় এভাবে কাঁদিনি।

পাশে থাকা দেলোয়ারা আপার মেয়ের জামাইকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। ভদ্রলোক আমাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে খাটের উপর বসালেন। ওই মুহূর্তে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আজাদ বলেছিল, ‘বন্ধু, আমার একমাত্র ছেলে অর্ঘ্যকে তুই দেখিস।’ অর্ঘ্যকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। অর্ঘ্য যাতে সুৃশিক্ষিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়; এসব দেখে যেতে চেয়েছিল আজাদ। কিন্তু এক ক্যান্সারে সব চুরমার হয়ে গেল।

শেষ দিনগুলোতে ঘুরে ফিরে আজাদের কথা ছিল, অর্ঘ্যকে যেন দেখে রাখি, একুশে পত্রিকাকে যেন বাঁচিয়ে রাখি। তাকে কথা দিয়েছিলাম— যতদিন বেঁচে আছি, তার চাওয়া পূরণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

আজাদের অনেক স্মৃতি জমে থাকলো। সময় পেলে বলবো কখনো। আপাতত এতটুকু বলি, আজাদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়নি। সে আমাদের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবে। তার সততা, সাহসিকতা, অনুপ্রেরণায় জন্ম হবে হাজারো কলম সৈনিক। যারা দ্যুতি ছড়াবে ঘুণে ধরা এই সমাজে। তাদের মাঝে হয়তো অর্ঘ্যকেও দেখবো একদিন।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা