ইশারায় ডেকে হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়


শরীফুল রুকন : প্রিয় মানুষের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক বুঝি আর নেই। কাছের মানুষ চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা চেপে ধরে, তার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করার শক্তি কম মানুষেরই আছে। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।

আমার প্রিয় সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় আজাদ তালুকদার ভাইয়া আমাদের চিরবিদায় দিয়েছেন গত ২ আগস্ট ভোররাত ৪টা ১১ মিনিটে। ওনার মৃত্যুর খবর পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য অচল ছিলাম।

অনেক কষ্টে একুশে পত্রিকার অনলাইনে লিখলাম আজাদ ভাইয়ার ‘শোক সংবাদ’। লেখাটা লিখতে যে এত কষ্ট হবে, আগে ভাবিনি; কিছুক্ষণ পরপর আটকে যাচ্ছিলাম, কী লিখছি এসব!

যদিও জানি, মানুষ যখন জন্মায়, তখন থেকেই তার নিয়তি-নির্ধারিত আয়ু থেকে তার বেঁচে থাকার বিয়োজন ঘটতে থাকে। এক অর্থে মানুষের আয়ু বাড়ে না, বরং কমতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। আগামীকাল জীবনে কী ঘটবে অথবা কেমন অনুভব করব, এটুকুও বুঝতে আমরা অসহায়ভাবে ব্যর্থ।

ভাইয়ার ছোট–বড়, খুঁটিনাটি স্মৃতি এখন আমাকে তাড়িয়ে ফিরছে। একের পর এক স্মৃতিগুলো আসছে-যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা তীব্র ব্যথায় বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে। এই তো কদিন আগেও কত সুন্দর ছিল সবকিছু।

আজাদ ভাইয়ার সাথে আমার প্রথম কখন দেখা হয়, সেটা পুরোপুরি মনে নেই। তবে ২০১৫ সালে একটি ঘটনার পর ওনার সাথে আমার যোগাযোগটা বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের ৮ জুন। সেদিন চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের চালানের আড়ালে কোকেন আনার ঘটনা কাভার করতে আমি বন্দরে গিয়েছিলাম। একাত্তর টেলিভিশনের হয়ে ঘটনা কাভার করার জন্য বন্দরে ঢুকেছিলেন আজাদ ভাইয়াও। আমি তখন বাংলামেইলে কাজ করি।

টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা বন্দরে ঘটনাস্থল থেকে একের পর এক লাইভ আপডেট দিচ্ছিলেন দর্শকদের। হঠাৎ খেয়াল করলাম, পরিচিত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা চোখের ইশারায় ডাকছেন। কাছে যেতেই বললেন, কোকেন উদ্ধারের ঘটনায় একজন আটক আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তথ্যটি তখনও অন্য সাংবাদিকরা পাননি।

এই তথ্য আমি সাথে সাথে শেয়ার করি আজাদ ভাইয়ার সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি একাত্তর টিভির লাইভে এই তথ্য প্রচার করেন। সাথে সাথে অন্য সাংবাদিকরা ওনাকে ঘিরে ধরেন, এই তথ্য কে দিয়েছে, কীভাবে পেলেন? তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। পরে আমার কাছে জানতে চাইলেন, তথ্যদাতা কর্মকর্তার নাম, কোথায় তিনি? কিন্তু ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করায় আমি কিছু বলিনি। যদিও কিছু সময় পরে আটকের তথ্য অফিসিয়ালি জানানো হয়।

পরে আজাদ ভাইয়ার সাথে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য শেয়ার করেছিলাম। ওই তথ্য দিয়ে একাত্তর টিভিতে নিউজ ও টকশোতে আলোচনা করেন তিনি। এর ফলে একটি বিশেষ বাহিনী বেশ চাপে পড়ে। তারা অসন্তোষ, ক্ষোভের কথাও আজাদ ভাইকে জানিয়ে দিয়েছিল। মূলত বাংলামেইলের চট্টগ্রাম অফিসের তৎকালীন ইনচার্জ আলম দিদার ভাইয়ার সাথে আজাদ ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাধে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করতাম; এভাবে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা গড়ে উঠে।

২০১৫ সালের শেষের দিকে আজাদ ভাইয়া জানালেন, তিনি একুশে পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ চালু করতে চান, আমি যেন সহযোগিতা করি। আমাকে দিয়ে তিনি একুশে পত্রিকার ডোমেইনটি কেনালেন। এমনকি সাইট তৈরি করার দায়িত্বও দেন। আমার এক বন্ধুর ভাগিনা রিদুয়ানের সহযোগিতায় আমি ডোমেইন কেনা ও সাইট ডেভেলপের কাজটি করে ফেলি। তখন আমি দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার।

আজাদ ভাইয়ার অনুরোধে আলোকিত বাংলাদেশের পাশাপাশি আড়ালে থেকে একুশে পত্রিকায়ও কাজ শুরু করি আমি। তখন একুশে পত্রিকার কোনো অফিস ছিল না। আমি ও আজাদ ভাইয়া যে যেখানে আছি, সেখান থেকে একুশে পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ চালিয়ে নিয়েছি। ২০১৬ সালের মে মাসে আমি আলোকিত বাংলাদেশ ছেড়ে যোগ দিই দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদে। সেখানে ছিলাম ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

প্রতিদিনের সংবাদে থাকার সময়ও আমি একুশে পত্রিকার অনলাইনে নিয়মিত নিউজ আপ করতাম। প্রতিদিনের সংবাদ ছেড়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একুশে পত্রিকায় যোগ দিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করি। এরপর দিনে দিনে আজাদ ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। ভাইয়ার সাথে এত স্মৃতি আছে যে বলে-লিখে শেষ করা যাবে না হয়তো। সময় সুযোগে আগামীতে আরও লেখার ইচ্ছে আছে।

গত ৩১ জুলাই সকালে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকে আজাদ ভাইয়ার সাথে সর্বশেষ দেখা ও কথা হয় আমার। প্রায় ১০ মিনিট ছিলাম আইসিইউতে। প্রথমে ঢুকতেই দেখি, আমাদের বটবৃক্ষ আজাদ ভাইয়ার ক্ষীণ ও ক্লান্ত দেহটা তখন আইসিইউর নরম বিছানায় মিশে গেছে। চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার এক পাশে হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ খুললেন। সালাম দিলাম। এরপর কিছু সিদ্ধান্ত, ইচ্ছের কথা জানালেন, একুশে পত্রিকা কীভাবে চলবে, সেটাও জানালেন।

একপর্যায়ে আমাকে হাতের ইশারায় আরও কাছে ডাকলেন। কাছে যেতেই, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আমাকে অনেক পছন্দ করেন; আমার জন্য দোয়া করছেন।’ এমন অবস্থায় আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। দ্রুত পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে আসি আইসিইউ নামক মৃত্যুপুরী থেকে।

লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা।