কাউছার আলম : একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৪ সালের দিকে। চট্টগ্রামে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করতে গিয়ে। তখন চেরাগী পাহাড় এলাকায় লুসাই ভবনের সামনে একটা ছোট্ট অফিসে একুশে পত্রিকার কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। তখন চট্টগ্রামের উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের প্রাণবন্ত আড্ডায় জমজমাট থাকতো অফিসটি। এ পত্রিকায় তখন যারা লিখতেন সবাই তরুণ সাংবাদিক। আমিও লিখতাম এ কাগজটিতে। লিখেছি ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
এরপর পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় পিছুটান থাকার কারণে লাইনচ্যুত হয়ে যোগ দিই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। তারপরও বন্ধের দিনে এসে দেখা করে যেতাম আজাদ ভাইয়ের সাথে। সে থেকেই আজাদ তালুকদার ভাইয়ের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে, যা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে আজাদ ভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে। সেসময় তিনি আমাকে দেখে বলছিলেন, ‘কাউছার, তুমি কেমন আছো? আমার জন্য দোয়া করিও।’ সেদিন বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি আজাদ ভাইয়ের সাথে। কারণ চিকিৎসকের বারণ ছিল কোনো ভিজিটরের সাথে কথা না বলতে। তারপরও চট্টগ্রাম থেকে কষ্ট করে তাকে দেখতে গিয়েছি বলেই সেই আবদারটা রেখেছেন আজাদ ভাই। তাঁকে দেখে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই আমার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসে। পরীক্ষা করে জানতে পারি ডেঙ্গু পজিটিভ।
সেদিন থেকে বিছানায় পড়ে ছিলাম টানা ১০ দিন। তার মাঝে খবর পেয়েছি আজাদ ভাইকে এইচডিওতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তখন থেকেই মনে আর শান্তি নেই। কখন যে কী ঘটে যায়। ঠিক তার পরদিনই গভীর রাতে জ্বর আর ব্যথায় বিছানায় ছটফট করি। ভোররাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, আজাদ ভাই আর নেই। মহান আল্লাহ পাকের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পরপারে।
অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই আমি মনে মনে ভাবছি এ মুহূর্তে যদি আজাদ ভাইয়ের কিছু হয়ে যায়, তাহলে তো আমি সশরীরে থাকতে পারব না। ঠিক এমনটাই হয়েছে বাস্তবে। শারীরিক অবস্থা এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, তাঁর জানাজায় উপস্থিত হতে পারিনি। সারাদিন বিছানায় বিষণ্নতায় আমার মন বোবাকান্না করে নিভৃতে।
আজাদ ভাইয়ের নিবিড় পরামর্শে ইতিমধ্যে পটিয়া থেকে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী নিউজ করেছি। যা পটিয়ায় বেশ আলোচিত হয়েছে। আজাদ ভাই সবসময় পরামর্শ দিতেন, বলতেন; ‘কাউছার, ভালো নিউজের জন্য অনুসন্ধান করো। লেগে থাকো। এগুলো তোমার জীবনের সিঁড়ির মতো কাজ করবে৷’
আমি আজাদ ভাইকে কখনো বসে থাকতে দেখিনি। এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে দেশ ও বিদেশে লড়েও নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রাখতেন। আমাকে স্পেশাল নিউজের অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন এবং সেই নিউজগুলোকে ভালো ট্রিটমেন্ট দিয়ে সাইটে আপ করতেন। তখন সেই নিউজের ‘মার মার কাট কাট’ অবস্থা হতো। সাড়া পড়ে যেত।
আমার সাংবাদিকতা জীবনে আজাদ ভাইয়ের সংস্পর্শে থেকে যা শিখেছি, জেনেছি তা আগামী দিনের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। আজাদ ভাইয়ের আদর্শ বুকে ধারণ করে যেন বাকি সময়টুকু তাঁরই একুশে পত্রিকার সাথে থেকে কাটিয়ে দিতে পারি সেই আশা রাখি।
আমি সবসময় আজাদ তালুকদার ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস, প্রাণশক্তি আর উদ্যম দেখে মুগ্ধ হতাম। ঈর্ষাকাতর হতাম, তাঁর সাহস আর কথা বলার জাদুকরি ক্ষমতা দেখে। সেসব রপ্ত করতে গিয়েও যখন বারবার হোঁচট খেতাম তখনই স্মরণে আনতাম আজাদ ভাইকে। ভাবতাম জীবনের কঠিন সময়কে উতরে যেতে প্রয়োজন আজাদ ভাইয়ের মতো ইতিবাচক ও দুর্দমনীয় মনোভাব।
আজাদ ভাই আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে আমার সাংবাদিকতা জীবনটা আরও সমৃদ্ধ হতো। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই বুকে সাহস রেখে বলেছেন, আমাকে আরও বাঁচতে হবে। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। আল্লাহপাক আমাকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখবেন, আমার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করে যেতে।
কিন্তু আল্লাহ তাঁকে ভালোবেসে অকালেই আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছায়। তিনি যা করেন সবই বান্দার ভালোর জন্যই করেন। আমরা আজাদ ভাইয়ের আদর্শ বুকে ধারণ করে সততা, দক্ষতা ও নিষ্টার সাথে একুশে পত্রিকাকে আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবো। এটা করতে পারলেই আজাদ ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে। পাশাপাশি আমাদের সাংবাদিকতা জীবন আরও সমৃদ্ধ হবে।