স্মৃতিতে একুশে পত্রিকা সম্পাদক—‘জিন্নাত আসছো?’


জিন্নাত আয়ুব : সাংবাদিকতা করতে এসে সত্য কথা বলতে অনেকেই ভয় পান। কিন্তু একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার স্যার সাহসের সাথে সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি সাংবাদিকতাকে নিছক পেশা হিসেবে নয়, একটি মিশন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পেশার শুরু থেকে আমৃত্যু সে ব্রত পালন করে গেছেন। তাই তিনি আমাদের চোখে এক অনুকরণীয় সাংবাদিক।

রাজনীতির উত্থান-পতনের নেপথ্যের নানা ঘটনা তুলে ধরতেন আমাদের প্রয়াত সম্পাদক। শুধু রাজনীতি বা রাজনীতির মানুষ তাঁর খবরের বিষয় ছিল না। অর্থনীতি, সমাজের চালচিত্র, প্রান্তিক মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা- সবই তিনি একুশে পত্রিকায় তুলে ধরতেন অথবা তুলে ধরতে বলতেন। এক কথায় বলতে হয়, বর্ণময় ছিল তাঁর সাংবাদিকতা জীবন।

স্যারের মানবিক মূল্যবোধের একটি কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে— ২০২২ সালের ২০ মে সকালে স্যারকে ফোন দিয়ে বলি, ‘আনোয়ারায় এক সিএনজি অটোরিকশা চালককে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের অসহায় স্বজনরা দাবি করছেন, এক প্রভাবশালীর ইন্ধনে এই ঘটনা ঘটেছে।’

সম্পাদক মহোদয় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নির্দেশ দেন, অনিয়মকারী, অপরাধী যেই হোক না কেন ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্তারিত জেনে নিউজ করো। সেদিন একুশে পত্রিকার অনলাইনে নিউজটা লিড হলো।

এরপর প্রভাবশালীরা আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি জানালে স্যার বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকতার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ থেকে নিউজটি করেছি। আমরা সমাজের নিপীড়িত মানুষের কথা লিখতে এসেছি, লিখে যাবো।’

পরে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ওই প্রভাবশালী আমার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। সত্য প্রকাশে অকুতোভয় সম্পাদক আজাদ তালুকদার স্যার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাংবাদিকতা করার জন্য উৎসাহিত করে গেছেন একুশে পত্রিকার প্রতিটি সদস্যকে।

চট্টগ্রামে একুশে পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করে সাংবাদিকতার ইতিহাসে অতি অল্প সময়ে মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে একটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে নিয়েছেন শ্রদ্ধেয় আজাদ তালুকদার স্যার।

২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর একুশে পত্রিকার ২০২২ সালের সেরা প্রতিনিধির পুরস্কার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সম্পাদক স্যার। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সাংবাদিকতার সেরা কাজটুকু করতে চাই সর্বোচ্চ, সর্বস্ব দিয়ে। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা শুধু সাংবাদিকতা করতে চাই, আর কিছু করতে চাই না। আমরা জানি, সত্য প্রকাশ করতে গেলে বাধা আসবেই। কিন্তু সত্যের আছে নিজের শক্তি।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন কিংবা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কালো টাকাকে সাদা করতে হবে, তাদের লগ্নিকে জায়েজ করতে হবে এ ধরনের কালো হাত নেই বলে আমরা ভালো সাংবাদিকতা করতে পারছি। সীমিত সাধ্য, সামর্থের মধ্যেও আমরা সাংবাদিকতার সেরা কাজটুকু করতে চাই। সেটি করতে আমরা বদ্ধপরিকর, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো মূল্যে।’

স্যারের সাথে আমার শেষ কথা হয় গত ২৩ জুলাই ঢাকার পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে স্যারের রুমে প্রবেশ করতেই বললেন- ‘জিন্নাত আসছো?’

আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। হাতটা ধরে স্যারের কপালে চুমু দিয়েছিলাম। অজান্তেই এমন দুঃসাহস দেখিয়ে ফেললাম। সত্যি বলতে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।

রুগ্ন শরীর নিয়ে সম্পাদক স্যার আমাদের সাথে কথা বললেন। অনেক কিছুই বললেন। সবাইকে ভালো করে কাজ করতে বললেন। আমাদেরকে সাহসী সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখতে বললেন।

এমন শারীরিক অবস্থায়ও তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা সকালের নাস্তা করেছো? আমি তোমাদের সকালের নাস্তাটা করাই।’ সবার এতো খেয়াল রাখেন বলেই বোধহয় তিনি এতোটা ব্যতিক্রম, অনন্য।

তখনও স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে সুস্থতা ছাড়া অন্য কিছু আমি-আমরা চিন্তাও করতে পারি নাই। স্যার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন এই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম।

এতো মানুষকে কাঁদিয়ে স্যার যে চলে গেলেন, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে।

লেখক : একুশে পত্রিকার আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা প্রতিনিধি।