[এখানেই আছে আমার অন্তর্নিহিত রক্তক্ষরণ, উপোস থাকা, দিনের পর দিন নির্ঘুম থাকা ও রক্তাক্ত হওয়ার গল্প।]
আজাদ তালুকদার : পথচলার ১৯ বছর পূর্ণ করল আপনাদের প্রিয় একুশে পত্রিকা। ২০০৪ সালে মাসিক পত্রিকা হিসেবে একুশে পত্রিকার যাত্রারম্ভ। পাঠক-ইচ্ছের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে পত্রিকাটি সাপ্তাহিকে রূপ নেয়। অব্যাহত পাঠকচাহিদা পূরণ আর যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে ২০১৫ সালে অনলাইন সংস্করণ চালু করে একুশে পত্রিকা। ২০২০ সালে চট্টগ্রামের অন্যতম প্রথম নিবন্ধিত অনলাইন হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় পত্রিকাটির।
পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ওয়েব পোর্টালের পাশাপাশি ভিডিও কনটেন্ট, নিয়মিত আট পৃষ্ঠার সাপ্তাহিক প্রকাশনার মাধ্যমে পাঠকের ভালোবাসাকে সঙ্গী করে একুশে পত্রিকা এখন অনেক পরিণত, পরিব্যাপ্ত। নিরন্তর পাঠক-চাহিদা মাথায় রেখে অচিরেই একুশে পত্রিকার দৈনিক মুদ্রণ সংস্করণের চিন্তাও করছি আমরা। একুশে পত্রিকার এই দীর্ঘ সময়ের পথচলা মসৃণ ছিল না; নানা সংকটের খানাখন্দ, বিপর্যয়ের ভাঙা সেতু অতিক্রম করতে হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুই বছর আগে আমি লিভার-ক্যান্সারে আক্রান্ত হই। দেশে ও ভারতে আমার চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে। এমন অবস্থায়ও আমি একুশে পত্রিকা সম্পাদনার কাজ অব্যাহত রেখেছি, নিজেই প্রতিবেদন লিখছি। যদিও নিউজ লিখতে আমার এখন অনেক কষ্ট হয়। বুক, পেট, ঘাড় ও চোখ ব্যথা করে। তবুও একুশে পত্রিকাকে ভালোবাসি বলেই আল্লাহর অশেষ রহমতে কাজ করতে পারছি। কাজ না করে আর কী করবো? একুশে পত্রিকা ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই। এটাই আমার ধ্যানজ্ঞান। একুশে পত্রিকাকে ঘিরেই আমার যত স্বপ্ন।
প্রচুর সীমাবদ্ধতা থাকার পরও ২০০৪ সালে একুশে পত্রিকাকে ঘিরেই উদ্যোক্তা হতে চেয়েছিলাম আমি। তখন থেকেই এই শহরে একাই ৪৮ পৃষ্ঠার একটি মাসিক ম্যাগাজিন (একুশে পত্রিকা) বের করে ফেলতাম। একাধারে সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ নির্মাণ, বিদগ্ধজনদের লেখা সংগ্রহ, নিজেই টাইপ করা, প্রুফ দেখা, সংবাদ সম্পাদনা, নিজেই আবার পেইজ মেকিং (পৃষ্ঠা সজ্জা), ট্রেসিং প্রিন্ট বের করে প্লেট মেকারের কাছে সেগুলো নিয়ে যাওয়া, প্লেট মেকিংয়ের পর কাগজসহ প্রেসে পৌঁছে দেওয়া। ছাপার পর ছদ্মবেশে সেই পত্রিকা আবার শহরের পত্রিকা স্টলগুলোতে পৌঁছে দেওয়া, লেখকদের সম্মানিও নিজ হাতে যত্ন করে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতাম আমি। কলুর বলদের মতো এত খাটাখাটুনি একাই করতাম। সাংবাদিকতার নেশায় হয়তো এমন পাগল ছিলাম।
বিজ্ঞাপনের চাইতে একুশে পত্রিকার জন্য ভালো একটা লেখা সংগ্রহে গুরুত্ব বেশি দিতাম। শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিক ও প্রবীণ সাংবাদিকদের পেছনে পেছনে ঘুরতাম, একটা লেখার জন্য। বিজ্ঞাপনের জন্য এতটা ঘুরতাম না। কোনমতে খরচটা উঠলেই হলো। তখন ১০ হাজার টাকা দিয়ে ৫০০ পত্রিকা বের করা যেত। একটি-দুটি বিজ্ঞাপন হলেই হয়ে যায়। খেয়ে না খেয়ে কত কষ্ট করেছি! নিজে লেখা সংগ্রহ করেছি। একুশে পত্রিকা নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল, এজন্য এসব কাজকে পীড়ন হিসেবে নিইনি, আনন্দ হিসেবে নিয়েছি।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশে এমন কোনো উদাহরণ আছে কিনা আমার জানা নেই, একজন ব্যক্তিই একাই একটি পত্রিকা বের করে ফেলছেন। কাঁধে প্লেট বহন করতে গিয়ে একবার কাঁধ কেটে গিয়েছিল। অঝোর ধারায় রক্ত ঝরেছিল। পত্রিকা বের করতে একটানা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পত্রিকা বের হবে না এ কারণে, ৭২ ঘণ্টা জেগে ছিলাম, এমন দিনও গেছে। পকেটে টাকা ছিলো না, এ কারণে মোমিন রোডের আলী হোটেলে গিয়ে ৫ টাকা দিয়ে সবজিভাত খেয়েছিলাম। অনেক সময় ৫ টাকাও ছিল না, তাই ভাতও খাইনি। চেরাগি পাহাড় আসার জন্য কখনো কখনো পকেটে দুই টাকা টেম্পোভাড়া থাকত না। তাই বাকলিয়া থেকে হেঁটে এসেছি। একুশে পত্রিকার ছোট্ট একটা অফিসে গরমে কষ্ট পেয়েছি, মাথায় ফোসকা পড়েছে, একটা ফ্যান পর্যন্ত লাগাতে পারিনি- এমন দিনও পার করেছি।
একাত্তর টিভি, বৈশাখী টিভি, একুশে টিভি, রাংগস গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন অধুনালুপ্ত দৈনিক সকালের খবর, ডেইলি স্টারের সিস্টার কনসার্ন সাপ্তাহিক ২০০০, রেডিও ও আন্তর্জাতিক ফিচার সংস্থা-সান ফিচার সার্ভিসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছি। কিন্তু একুশে পত্রিকাকে আমি ছাড়িনি, সন্তানের মতো আগলে রেখেছি।। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মস্থলের কাজ শেষ করে, অন্যান্য সংবাদকর্মীরা, বন্ধু-স্বজনরা যখন আড্ডায় মেতে উঠতো, তখন সে সময়টাকে আমি বেছে নিতাম পত্রিকার পাতা ভরাটের জন্য। অনেক কষ্ট করে পত্রিকাটা আমি একটা জায়গায় টেনে এনেছিলাম।
আমার ইচ্ছা ছিল, একজন আপাদমস্তক সংবাদকর্মী হওয়ার, একজন সম্পাদক হওয়ার। কিন্তু আজকের দিনে এসে আমি কিছু হতে পেরেছি কিনা জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কিছুই করতে পারিনি, হতে পারিনি। এই শৈল-শহর, পর্বত-শহরে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমার চেয়ে স্বল্প যোগ্যতার সাংবাদিক খুব কমই আছে, তবে আমার কাছে একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে সততা। আমি সততার পরাকাষ্টা একদিনের জন্যও ভাঙিনি। আমার শরীরে আমি একটা হারাম পয়সা ঢুকানোর চেষ্টা করিনি। আমি পরিশ্রম করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা কাজ করেছি এমন দিনও গেছে। যে কারণে হয়তো একুশে পত্রিকা আজকের অবস্থানে এসেছে। এটা একটা ট্র্যাজিক গল্প হতে পারে। পত্রিকার জন্য মানুষ এত ত্যাগ স্বীকার করে কিনা আমার জানা নেই। হয়তো করে, কিন্তু তাদের বৈষয়িক ফিডব্যাক, আউটপুট বেশি আছে।
আমি কষ্ট করেছি প্রচুর। কারণ, আমি বাঁকা পথ চিনতাম না। বৈষয়িক ছিলাম না। যে কারণে আমার অর্থনৈতিক আউটপুট তেমন আসেনি।
তবুও আজকের দিনে এসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। পত্রিকা ছাড়া আমি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য তৈরি করতে পারিনি। আমার কাছে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শুধু পত্রিকার উপর নির্ভর করে আমি চলি। আবার কারও কাছ থেকে আমি সহযোগিতা নিই না। কেউ উপঢৌকন দিলেও নিই না। কালো টাকা, ঘুষ দূরের কথা। একটা পত্রিকা তৈরি করা, উদ্যোক্তা হওয়া, সেই পত্রিকায় কিছু মানুষ কাজ করবে, সেই পত্রিকার নামডাক হবে, এটাই ছিল আমার লক্ষ্য।
আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, প্রধানমন্ত্রীর দশটি বিশেষ উদ্যোগের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য একুশে পত্রিকার সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)। এছাড়া অভিবাসন বিষয়ে সাংবাদিকতায় অবদান রাখায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পেয়েছে একুশে পত্রিকা। শুধু তাই নয়, একুশে পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক শরীফুল রুকন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২১ পেয়েছেন। এছাড়া পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতা এগিয়ে নিতে একুশে পত্রিকার সঙ্গে চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ইন্টারনিউজ। সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিসেফ-মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২১ এর মনোনয়ন, এমআরডিআই ফেলোশিপ-২০২২ ও ২০২৩;সহ আরও বহু অর্জন জমা পড়েছে একুশে পত্রিকার অর্জনের ঝুলিতে।
সত্য প্রকাশে সব সময় একুশে পত্রিকা অভিন্ন একটি অবস্থান বজায় রেখেছে। বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে গেলেও অনেক সময় সত্য সংবাদ প্রকাশে দ্বিধা করেনি একুশে পত্রিকা। এমনকি সংবাদ প্রকাশে বাধা আসার শঙ্কা থেকে বিজ্ঞাপন নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে পর্যন্ত একুশে পত্রিকা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। যদিও বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক বজায় রেখে চলাটা একুশে পত্রিকার পক্ষে খুব সহজ ছিল না।
‘নিউজের উপাদান যদি হন আমার বাবা, তাকেও ছাড় নেই’- অঙ্গীকারে একুশে পত্রিকা সংবাদের প্রচলিত সংজ্ঞা ও কাঠামো বদলাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরার সাহস নানা কারণে অন্য অনেক গণমাধ্যম চিন্তাও করতে পারে না, সেটাই করে আসছে একুশে পত্রিকা।
দেশের গণমাধ্যম নিয়ে আপনারা যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, দেশের বড় গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে। সেসব গণমাধ্যমগুলোকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা এজেন্ডা বাস্তবায়নে নামতে হয়। একুশে পত্রিকা এই অপসংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে। কারণ পত্রিকা ছাড়া আমাদের আর কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই।
একুশে পত্রিকার সীমাবদ্ধতা অনেক। একে প্রতিনিয়ত পাড়ি দিতে হচ্ছে প্রতিকূল স্রোত। এরপরও যারা নদী দখল-নষ্ট করে, বন উজাড়-দখল করে ফেলে, ভূমিদস্যুতা করে, খাদ্যে রাসায়নিক-ভেজাল দেয়, তাদের কোনো ছাড় একুশে পত্রিকা দেয় না। মানবাধিকার নিশ্চিতেও একুশে পত্রিকার অবস্থান পরিস্কার। অদম্য মেধাবী এবং প্রশাসনে যুক্ত মানবিক মানুষদের উৎসাহ দেয় একুশে পত্রিকা।
অনেক টাকা লগ্নি করে রাতারাতি আওয়াজ তুলে আরেক রাতে আওয়াজ ছাড়াই গুটিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা আসিনি। আমরা এসেছি খুব নীরবে, সন্তর্পণে। সেই সন্তর্পণ পথচলায় সাধারণ পাঠক, জনগণই আমাদের আস্থা, সাহসের স্ফুলিঙ্গ। সেই অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ থেকে কখনো যদি আগুনের কুণ্ডলি তৈরি হয়, হইচই উঠে, তবে তা-ই আমাদের সাংবাদিকতা।
প্রতিদিন একুশে পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত একেকটি নিউজ কয়েক লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অনলাইনে প্রকাশিত পুরো সপ্তাহের সেরা প্রতিবেদনগুলো নিয়ে ছাপানো সাপ্তাহিক একুশে পত্রিকা মানুষের আরও কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘ ১৯ বছর পার করে আসা একুশে পত্রিকা আগামীতেও দেশের কথা বলবে, মানুষের কথা বলবে। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে ভয়ডরহীন দাঁড়ানোর নীতিতে একুশে পত্রিকা অবিচল রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আগামীতেও সত্য প্রকাশে অবিচল থাকবে একুশে পত্রিকা। ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও জনস্বার্থে কাজ করার চেষ্টা করবে। আমাদের সঙ্গে আছে বিপুল পাঠকগোষ্ঠী, তারাই একুশে পত্রিকার প্রধান শক্তি।
[একুশে পত্রিকার ১৯ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত সম্পাদকের অভিমত]