‘ডাক্তারদের ঘুষ-কমিশন খাওয়া বন্ধে আইন চাই’


শরীফুল রুকন : আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসকদের কমিশন দেয়। যার কারণে রোগনির্ণয় ব্যয় বাড়ছে। আবার ওষুধ কোম্পানি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক দিচ্ছে, সত্য। যারা চেক দেয় ও যারা নেয়, তাদেরকে ধরা দরকার। সেমিনার, কর্মশালা করলে ডাক্তাররা কিছু শিখতে পারেন; সেইগুলোর আয়োজনে ওষুধ কোম্পানি সহায়তা করছে, সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু চেক দিচ্ছে, ক্যাশ টাকা দিচ্ছে; পাঁচ লাখ, তিন লাখ, দুই লাখ টাকা দেওয়ার মানে কী? ওদের ওষুধ লিখেই তো টাকাটা কাভার করতে হবে! কিছু চিকিৎসক টাকার লোভে অনুমোদনহীন ওষুধও লিখছেন। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা উচিত।’

ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকদের চেক গ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘কেউ যদি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে চেক নেয়, এটা খুবই অন্যায় কাজ। বিবেক বিসর্জন দিয়ে কেউ যদি টাকা নিয়ে ওষুধ লিখে, খুবই দুঃখজনক। কোয়াক ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তাররা এসব বেশি করে। কেউ যদি তার নৈতিকতার স্খলন ঘটায়, নৈতিকতা বিসর্জন দেয়, আমাদের নিন্দা জানানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। আমরা এটা সমর্থন করি না। এভাবে কোনো কিছুর বিনিময়ে ওষুধ লেখা, কোনো কিছু নিয়ে কারও ল্যাবে পরীক্ষা করতে দেওয়া, এগুলো নীতিবহির্ভূত।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকলে তারা হীন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছে। আমি একজন ডাক্তার, আমি আমার নিজের পেশাগত মর্যাদা হারাচ্ছি কেন? আমার যে মহৎ পেশা, এই পেশার যে একটা মর্যাদা আছে, এটা আমি নিজেই ক্ষুণ্ন করছি। এটা হওয়া উচিত না। প্রত্যেক ডাক্তারের কাছে অনুরোধ, তারা যেন এ কাজটি থেকে বিরত থাকেন। বিক্রি হয়ে গেলে ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারের ব্যাপারে অন্য জায়গায় কটু মন্তব্য করে। বলে, টাকার বিনিময়ে তাকে কেনা যায়। টাকা নিলে আপনার সম্পর্কে তো মানুষ কথা বলবে, আপনার চরিত্র নিয়ে কথা বলবেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির প্রমোশনে খরচ হলে আলাদা ভাউচার থাকবে। কিন্তু চিকিৎসকদের যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা কোন খাতে যাচ্ছে? ডাক্তারদের আয়ের হিসাব নেওয়া উচিত। তাদের টাকা কোন কোন সোর্স থেকে আসছে? প্রতিদিন কে কয়টা রোগী দেখেন, রোগীপ্রতি কত টাকা নেন, রোগী দেখা থেকে মোট কত টাকা আসে, ওষুধ কোম্পানিগুলো থেকে টাকা-উপহার-মাসোহারা নেওয়া কতটা বৈধ- এসব বিষয় শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অরাজকতা কিছুটা কমানো যাবে।’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এদেশে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকার সুযোগে বেসরকারি চিকিৎসক তো বটেই, সরকারি চিকিৎসকরাও ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিচ্ছেন। এটা অন্যায়। আইন করে এটা বন্ধ করা উচিত।’

চিকিৎসকদের পেশা চর্চার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। অসদাচরণ, অবহেলা বা ভুলের কারণে রোগীর ক্ষতি হলে সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, এমনকি নিবন্ধন বাতিল করতে পারে বিএমডিসি। তবে ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টাকা খাওয়ার বিষয়ে কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ও বিএমডিসির শৃঙ্খলা কমিটির চেয়ারম্যান ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর কাছে প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, ‘আর বলবেন না। এই জায়গাটা হচ্ছে আমাদের চিকিৎসক সমাজের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট। বেশি নষ্ট হয়ে গেছে এই জায়গাটা। এখানেই শুধু বিএমডিসির তেমন করণীয় কিছু নেই। এখানে মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমএ ও বিএমডিসি- সবাই মিলে যৌথভাবে কিছু করা গেলে ফল পাওয়া যাবে। এই জায়গায় হাত দিতে হলে শক্তভাবে দিতে হবে এবং এখানে অনেক কাজ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি পার্টি- একটি হলো কোম্পানি, আরেকটা হলো আমাদের চিকিৎসক সমাজ। দুই পার্টিকে সমানতালে কাজ করতে হবে। কোম্পানিকে বুঝতে হবে, তার কী কাজ। এই কাজের জন্য সে কতটুকু করবে, কতটুকু করবে না। তার সীমারেখা কোথায়? একইভাবে চিকিৎসক সমাজকেও বুঝতে হবে, আমাদের সীমারেখাটা কোথায়। দুইটা জায়গায় দুইটা সীমারেখা যদি আমরা টানতে পারি এবং তখন সরকার যদি বলে— দুইজনেই সীমারেখা অতিক্রম করলে আমরা হ্যান্ডেল করবো, তাহলে হয়তো কাজ হবে। সরকারকে একটু বড় চোখ দিয়ে তাকাতে হবে।’

মূল প্রতিবেদন : কমিশন বাণিজ্যে দ্বিগুণ রোগ নির্ণয়ের খরচ