রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

দণ্ডিত হওয়ার তিন মাসেও বরখাস্ত হননি সীতাকুণ্ডের দুই ইউপি চেয়ারম্যান

প্রকাশিতঃ ৩০ মে ২০২৩ | ৯:৪০ অপরাহ্ন

এম কে মনির : পরিবেশ ধ্বংসের দায়ে দণ্ডিত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর ও বাড়বকুণ্ড ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী। প্রায় তিন মাস আগে দণ্ডিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।

অথচ স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯-এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্য তার স্বীয় পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন যদি, তিনি পরিষদ বা রাষ্ট্রের স্বার্থের হানিকর কোন কার্যকলাপে জড়িত থাকেন, অথবা দুর্নীতি বা অসদাচরণ বা নৈতিক স্খলনজনিত কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’

এর আগে সমুদ্রের তলদেশ থেকে অবৈধভাবে ৫০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলনের দায়ে গত ৬ মার্চ সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ার চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর ও বাড়বকুণ্ডের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজকে আড়াই লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর; তাদের সঙ্গে আবুল কাশেম মাস্টার নামে স্থানীয় একজন শিল্পপতিও দণ্ডিত হন।

বালু উত্তোলনের বিষয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের এক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুনানিতে উপস্থিত হন দুই ইউপি চেয়ারম্যান ও মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডের মালিক মাস্টার আবুল কাশেম। শুনানিতে তাদেরকে সাগরের তলদেশ থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় তারা বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করে নেন।

পরে ৬ মার্চ তাদেরকে অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৎকালীন পরিচালক মুফিদুল আলম সাগরের তলদেশ থেকে ৫০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করে নিচু জমি ভরাট করার দায়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে আদেশ জারি করেন। আদেশে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জরিমানার সব টাকা পরিশোধের নির্দেশ প্রদান করা হয়।

আদেশে আরও বলা হয়, গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ও চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি দুই দফায় সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ও বাঁশবাড়িয়ার সমুদ্র তীর পরিদর্শন করেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার কর্মকর্তারা।

পরিদর্শনে বাঁশবাড়িয়ার আকিলপুর সমুদ্র সৈকত ও মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডের উভয়পাশে দেড়-দুই কিলোমিটার লম্বা পাইপ স্থাপন করে সাগরের তলদেশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রমাণ মেলে। একইসাথে সাগরের বালু দিয়ে আশেপাশের নিচু কৃষি জমি, পুকুর ও ডোবা ভরাটের প্রমাণ পাওয়া যায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৎকালীন পরিচালক (বর্তমানে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত) মুফিদুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলে সাগর থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ওই এলাকার বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। ফলে বর্ষাকালে জোয়ারের পানি গ্রামাঞ্চল ও বিস্তৃত ফসলের মাঠ প্লাবিত করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। একইসাথে সন্দ্বীপ চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট মারাত্মক হুমকিতে পড়ে। পাশাপাশি ওই এলাকার কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনজীবনে দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।’

জরিমানার ওই আদেশে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দণ্ডিত ইউপি চেয়ারম্যানরা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা পরিশোধও করেছেন। বিষয়টি একুশে পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যায়লের পরিচালকের পিএস মো. সাইফুল করিম।

যদিও জরিমানার টাকা পরিশোধের পর তাদেরকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি উপজেলা প্রশাসন। এমনকি বিষয়টি খতিয়েও দেখেননি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেন। শুধু তাই নয় উপজেলার দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান বালু উত্তোলনের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি জেলা প্রশাসন কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি ইউএনও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার আইনেরও ভুল ব্যাখা দেন সীতাকুণ্ডের ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে তাদের জেল হলে স্বপদ থেকে অপসারণ করার কথা। জরিমানা হলে অপসারণ হওয়ার কথা নয়।’ এসময় স্থানীয় সরকার আইনের ৩৪ ধারায় যেকোনো দণ্ড পেলে বরখাস্ত করার বিষয়টি উল্লেখ আছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি এটি (আইনের ব্যাখ্যা) জানি না। বিষয়টি আমাকে দেখতে হবে।’

জানা যায়, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে গভীর সমুদ্রে খননযন্ত্র বসিয়ে বালু উত্তোলন করছিল একটি চক্র। এসব বালু শিপইয়ার্ডের জাহাজ ভেড়ানোর কথা বলে তোলা হচ্ছিল। কিন্তু উত্তোলিত বালু সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন বালু সেইল সেন্টারে বিক্রি শুরু হয়। শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে তোলা এসব বালু দিয়ে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, বাড়বকুণ্ড এলাকার কৃষি জমি, পুকুর, ডোবা ও খাল ভরাট করা হচ্ছিল। এতে ওই এলাকায় কোটি কোটি টাকায় নির্মিত বেড়িবাঁধের ব্লক ভেঙে পড়ছিল। হুমকিতে পড়েছে পর্যটন শিল্প, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও বিস্তৃত কেওড়া বন। যা পরিবেশে দীর্ঘ মেয়াদী বিরূপ প্রভাব ফেলাসহ চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য হুমকি বলেও জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

আর এসব আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে আসার অভিযোগ উঠে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর ও বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজীর বিরুদ্ধে। তারা দুজন বসুন্ধরা গ্রুপ, ক্যাপিটাল পেট্রোলিয়াম, জেএমআই, ইউনিগ্যাস, ইউরো গ্যাস, মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বালু তুলে দেন বলে স্থানীয়রা জানান। এ দুজন চেয়ারম্যান দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে সমুদ্রের তলদেশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। খুলে বসেন নিজস্ব ড্রেজিং মেশিনের প্রতিষ্ঠান। গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। অন্য সব চেয়ারম্যান পুরোনো গাড়ি ব্যবহার করে আসলেও এই দুইজন দুই দফায় পাল্টেছেন নিজেদের ব্যবহৃত গাড়ি, বানিয়েছেন শহরে একাধিক বাড়ি।

অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে সাগরের তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করলেও এই দুই ইউপি চেয়ারম্যানকে একবারও শাস্তির আওতায় আনেনি স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। রহস্যজনক কারণে তাদের ব্যাপারে নীরব রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম। অথচ প্রকাশ্য দিবালোকে তারা দুজন বালু উত্তোলন করে ব্যবসা করে আসছেন।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক শাহিনা সুলতানা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আমাদেরকে জানাতে হবে। জানার পরই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব। তাছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানদের বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালকের অনুমতিক্রমে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারও কাজ করতে পারেন।’

সনাক-টিআইবি’র চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন থেকে একেবারে অধস্তন পর্যন্ত মনিটরিং করা উচিত। দুই চেয়ারম্যান যদি দণ্ডিত হয়ে থাকেন তাহলে আইন অনুযায়ী তাদেরকে অপসারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় এখানে আইনের সুস্পষ্ট ব্যতয় ঘটবে এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি না মর্মে প্রতীয়মান হবে। আমরা আশা করবো, দ্রুত এই দুইজন ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২২ জুন লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা ইউনিয়নের কাজির পাড়া ও জামছড়ি খালে অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহান। এসময় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে লোহাগড়ার চারম্বা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিনকে ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেন। একইসাথে ৪২ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ ও বালু উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত ৩ টি মেশিন ধ্বংস করে দেয়া হয়।

সেসময় অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ শাহজাহান একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমার কাছে তথ্য ছিল ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে অভিযান চালিয়ে সত্যতা পাই এবং অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তিনি জরিমানার টাকা পরিশোধ করেছেন।

পরবর্তীতে গত ৩ জানুয়ারি ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।