জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তরের সহ-সম্পাদক নাজমুস সাকিব রহমান চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের বাসিন্দা। গত ২৫ এপ্রিল ভোরে ঢাকা থেকে চকবাজারের গোলজার মোড় আসেন তিনি। সেখান থেকে হেঁটে খালপাড়ের বাসায় যাওয়ার পথে বাকলিয়া আদর্শ বালিকা স্কুলের দক্ষিণ পাশে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন নাজমুস সাকিব রহমান। ছিনতাইকারীরা তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। তাতেই শান্ত থাকেনি অপরাধী চক্রটি, শুরুতে এবং শেষে ছুরিকাঘাত করে নাজমুস সাকিব রহমানের শরীর রক্তাক্ত করে।
নাজমুস সাকিব রহমান বলেন, ‘সেদিন আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে ছিনতাইকারীরা আমাকে ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। ওই দিনই আমি চকবাজার থানায় মামলা করেছি। এক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি নেই।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে হঠাৎ বেড়েছে ছিনতাই। প্রায় প্রতিটি ব্যস্ত সড়ক ও এলাকায় নির্বিঘ্নে ছিনতাই হচ্ছে। ঘর থেকে বের হলেই সাধারণ মানুষকে থাকতে হয় আতঙ্কে। নগরের একেখান ও অলংকারের বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, আকবর শাহ, ফয়েজ লেক, আমতল, নিউমার্কেট, টাইগারপাস, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ, নতুন ব্রিজ, কল্পলোক আবাসিক, রাহাত্তারপুল, কালামিয়া বাজার, বাকলিয়া খালপার, চকবাজার, বহদ্দারহাট, খাজা রোড, মুরাদপুর, ২নং গেইট, প্রবর্তক মোড়, কাজীর দেউড়ি, জিইসি মোড়, ওয়াসা, বায়েজিদ, শেরশাহ, অক্সিজেন, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, সিঅ্যান্ডবি মোড়সহ অর্ধশতাধিক স্থানে ছিনতাই হচ্ছে হরহামেশা। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়লেও পুলিশের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়।
অভিযোগ আছে, বিভিন্ন সময় ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালেও তা জিডিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে৷ বেশিরভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলা হচ্ছে না। ছিনতাইয়ের অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় গেলে মামলা না নিয়ে ‘হারানো’ উল্লেখ করে জিডি (সাধারণ ডায়রি) করার পরামর্শ দেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এর কারণ উল্লেখ করে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যদি কোনো থানা এলাকায় ছিনতাই বেড়ে যায় তাহলে ধরে নেওয়া হয়, ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে দেখাতে থানা-পুলিশ কম মামলা নেওয়ার চেষ্টা করে।
পুলিশি ঝামেলা-হয়রানির আশঙ্কার কারণে অনেকে আবার থানায় যান না, মামলা করেন না। ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ মাঝে মধ্যে মামলা নিলেও সাধারণত দস্যুতার ধারায় (দণ্ডবিধির ৩৯২ ধারা) নেয়। ছিনতাইয়ের ঘটনায় আঘাতজনিত কোনো ঘটনা ঘটলে ৩৯৪ ধারায় মামলা হয়। আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হলে তখন ৩০২ ধারায় দোষীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেওয়া হয়। যদিও তাদের বেশিরভাগ ছিনতাইকারী থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর গ্রেপ্তার হলেও কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে পুনরায় একই অপরাধে সক্রিয় হচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, নগরে কতজন ছিনতাইকারী রয়েছে, পুলিশের কাছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। এছাড়া কারা কারাগারে আছে, আর কারা জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, সেই তথ্যের হালনাগাদও নেই পুলিশের কাছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মাদকসেবি, কিশোর গ্যাংয়ের মত অপেশাদার ছিনতাইকারী। যারা নগরের বিভিন্ন অলিগলিতে সুযোগ পেলেই ছুরিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পথচারী ও যাত্রীদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে।
সনাক-টিআইবি’র চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ছিনতাই বৃদ্ধির ঘটনা উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে পুলিশ দায় এড়াতে পারে না। ছোটখাটো অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পারছে না পুলিশ। যার কারণে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারী, প্রতারকসহ বিভিন্ন অপরাধীর টার্গেট হচ্ছে। এসব ঘটনাকেও গুরুত্ব দিতে হবে৷ কারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব।
ছিনতাইয়ের ধরণ :
পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের সুবিধার্থে নানান রকম কৌশল অবলম্বন করে থাকে ছিনতাইকারীরা। সাধারণত ৫ থেকে ১০ জন মিলে ছিনতাই করে থাকে। এদের মধ্যে ২-৩ জন পুলিশ আসছে কিনা তা পাহারা দেয়। ছিনতাইকারীরা বেশিরভাগ সময় নির্জন জায়গাকে বেছে নেয়। প্রথমে কয়েকজন মিলে একজনকে টার্গেট করে তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পথচারী তরুণ ও বয়স্কদের টার্গেট করা হয়। তারপর টার্গেটকে অনুসরণ করে নির্জন স্থানে আটকে ছোরার ভয় দেখিয়ে মোবাইল, স্বর্ণালঙ্কার, টাকাসহ সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়।
সদস্য সংখ্যা কম হলে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা হয় ভিন্ন। লোকাল বাস কিংবা রিকশায় থাকা যেকোনো একজনকে টার্গেট করে পর্বেক্ষণ করতে থাকে তারা। এদের নজর থাকে ভ্যানিটি ব্যাগ, হাত ব্যাগ, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন সেটের দিকে। যথারীতি তারা সড়কে যানজট কিংবা ট্রাফিক সিগন্যালের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। এরপর সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে মোবাইল কিংবা হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এছাড়াও এটিএম বুথে টাকা তুলতে আসা ব্যক্তিরাও টার্গটে থাকে ছিনতাইকারীদের। বুথের আশেপাশেই তারা সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে।
বিভিন্ন সময় সিএনজি অটোরিকশা অথবা রিকশা চালকের যোগসাজসেও ছিনতাই করা হয়। এছাড়া সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল। আবার অনেক ছিনতাইকারী পথচারী সেজে সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা নগরের ব্যস্ত সড়ক, জনবহুল এলাকা কিংবা বাসস্টপকে বেছে নেয়। সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া হয়ে উঠার বিষয়টি পুলিশ সদস্যরাও অবগত, স্পটগুলো প্রায় চিহ্নিত। যদিও এই স্থানগুলো ঘিরে পুলিশের নজরদারি তেমন নেই। ফলে এই সুযোগটাই কাজে লাগচ্ছে অপরাধীরা।
কারা, কেন ছিনতাই করছে :
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ৩ ধরণের ছিনতাইকারী দেখা যায়। এক ধরণের ছিনতাইকারী আছে, যারা পেশাদার। ছিনতাই করেই তার নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করে। এই ধরণের ছিনতাইকারীরা এলাকাভিত্তিক সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে ছিনতাই করে। এক এলাকার ছিনতাইকারীর সাথে অন্য এলাকার ছিনতাইকারীর যোগাযোগও হয় নিয়মিত। এদের বেশিরভাগই চিহ্নিত অপরাধী। পুলিশের কাছে তারা মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে, কারাগারেও যায়। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও ছিনতাইয়ে নেমে পড়ে।
ছিনতাইকারীদের মধ্যে তরুণ ও কিশোর বয়সীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই করে থাকে। পুলিশের ভাষায়, এদের অপেশাদার ছিনতাইকারী বলা হয়ে থাকে। তারা হঠাৎ (মাদক সেবনের টাকার জন্য) রাস্তায় নেমে ছিনতাই করে। পুলিশের দাবি, এ কারণে তাদের সহজে শনাক্ত করা যায় না।
আবার বেশকিছু এলাকার বিভিন্ন বড় ভাইদের ইন্ধন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিনতাইয়ের অভিযোগও পাওয়া যায়। এরা মূলত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। নগরীর চান্দগাঁও, চকবাজার, পাঁচলাইশে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হওয়া ছিনতাইকারীরা বড় ভাইদের ইন্ধন ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। তবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় এসব বড় ভাইদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না পুলিশ।
শ্রাবনী দাশ নামে এক কলেজ ছাত্রী বলেন, ‘গত ২৩ এপ্রিল বিকালে আমি এবং আমার বান্ধবী নতুন ব্রীজ থেকে হেঁটে বাকলিয়ার দিকে আসছিলাম। হঠাৎ দুজন ছেলে এসে আমার বান্ধবীর ফোনটি কেড়ে নেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তবে তারা যাওয়ার আগে আমি পেছন থেকে তাদের একজনের ছবি তুলি। ছবিসহ বিষয়টি আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলে জানতে পারি এরা বাকলিয়া এলাকায় চিহ্নিত ছিনতাইকারী। এদের একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট আছে। সন্ধ্যা হলে নতুন ব্রীজ এলাকায় দল বেঁধে ছিনতাই করে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি অবগত থাকলেও তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
রাসেল নামে এক ব্যক্তি বলেন, গত ৫ মে অভিনব কৌশলে আমার আত্মীয়ের টাকা লুট করে নেয় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। আমার ওই আত্মীয় অফিসের টাকা নিয়ে বাসে করে বাসায় যাচ্ছিলেন। বাস কদমতলি এলাকায় আসলে একজন লোক তার গায়ে বমি করে দেয়, সাথে সাথেই আরেকজন লোক এসব পরিস্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পাশে থাকা আরও ২ জন লোক আমার ওই আত্মীয়কে পানি দিয়ে পরিস্কার করে দিতে থাকেন। এই সুযোগে ওনার টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে তাদেরই এক সদস্য উধাও হয়ে যায়। এই কৌশলেও টাকা লুট হয়ে আসছে।
এদিকে, প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনা শেয়ার করছেন ভুক্তভোগীরা। ফেসবুকের একটি গ্রুপে গোলাম আকবর নামে এক ব্যক্তি পোস্ট করেন, গত ১৭ এপ্রিল রাত ১০ টার দিকে বহদ্দারহাট থেকে আমার মামাকে একদল লোক জোরজবরদস্তি করে সিএনজি অটোরিকশায় উঠিয়ে নেয়। চান্দগাঁওয়ের জনমানবহীন একটি এলাকায় নিয়ে অস্ত্র ধরে মোবাইল, টাকা কেড়ে নেয় এবং মারধর করে। এরপর তারা পরিবারকে ফোন করে বিকাশে আরও ৫০ হাজার টাকা দিতে বলে। বিকাশে তাদেরকে টাকাও পাঠানো হয়। পরবর্তীতে তারা মামাকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় একটি মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী।
ওই পোস্টেই কমেন্ট করে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তুলে ধরেছেন অনেকেই। আব্দুস সালাম নামে একজন লিখেছেন, ৩ বছর আগে বহদ্দারহাটের ওয়েলফুডের সামনে থেকে একই কায়দায় আমার ছোটভাইকে সিএনজি অটোরিকশায় উঠিয়ে সব হাতিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেয়। এই জায়গাটা ছিনতাইকারী, ডাকাতদের আস্তানা।
মালিহা বিনতে ইরশাদ লিখেছেন, আমার বাবার সাথেও হয়েছিলো এমন। বাবা ট্যাক্সি করে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা নির্জন জায়গায় ট্যাক্সি স্লো করে দিয়েছিলো ড্রাইভার। মুহূর্তের মধ্যে ট্যাক্সিতে তিনটা মানুষ ঢুকে পড়ে। একজন মুখ চেপে ধরেছে, আর দুইজন দুই পাশে বসে টাকা–পয়সা, মোবাইল নিয়ে সামনে গিয়ে চোখে মরিচ দিয়ে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়।
আব্দুল মাযিদ লিখেছেন, একই অবস্থা আমারও হয়েছে গত ৩ মাস আগে। আমাকে প্রচুর মারধর করেছিল, ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ফেলেছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। দীর্ঘ ২ মাস হাঁটতে পারিনি, কথা বলতে পারিনি, খেতে পারিনি।
অন্য একটি গ্রুপে পোস্ট করে নিজের সামনে হওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনার বর্ণনা দেন আরেক ব্যক্তি। তিনি লিখেন, ‘১৫ মে রাত সাড়ে ৮টার দিকে চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর সানোয়ারা কনভেনশনের সামনে সিএনজি অটোরিকশা করে ৪–৫ জন লোক এসে একটি ছেলেকে ডাক দেয়। মুহূর্তেই তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে সিএনজি নিয়ে চলে যায়। এই ছেলেটা সিএনজির পিছনে দৌঁড়েও শেষ পর্যন্ত তার মোবাইলটা নিতে পারেনি।’
সাধারণ ঈদুল ফিতর–ঈদুল আজহা, কিংবা অন্যান্য উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনা ভাবাচ্ছে থানা পুলিশকেও।
ডাবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বর্তমানেও একটি ছিনতাইয়ের কেইস নিয়ে আমরা কাজ করছি। গত কয়েক মাসেই আমরা ২০টির মত ছিনতাইয়ের ঘটনা হ্যান্ডেল করেছি। এই এলাকায় ২–৩টি গ্রুপ আছে যারা ছিনতাইগুলো করে থাকে। যারা এসব অপরাধ করছে প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ডাবলমুরিং থানায় একাধিক মামলা আছে। দেখা যায়, জামিনে বের হয়েই এরা পুনরায় একই কাজ করছে।’
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের মজুমদার বলেন, ‘ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করছি। আমরা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করছি। যারা পূর্বে ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত ছিল তাদেরও অবজারভেশনে রেখেছি। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই আমরা জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। সিএমপির কিছু সিসিটিভি ক্যামেরা অকেজো থাকলেও এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যক্তি মালিকানাধীন সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারছি।’
সিএমপির অচল সিসিটিভি ক্যামেরার ফায়দা নিচ্ছে অপরাধীরা :
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ২০১৪ সালে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয় সিএমপি। সেসময় প্রথম ধাপে নগরের ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১১০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় ক্যামেরার সংখ্যা কম হলেও ওই উদ্যোগ বেশ প্রশংসা কুড়ায়। যদিও স্থাপনের কিছুদিন পরই এসব ক্যামেরার বেশির ভাগ অকেজো হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর নগরীর অপরাধপ্রবণ ও গুরুত্বপূর্ণ ৭০ স্পটে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৭০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় সিএমপি। সেসময় ৪১১টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। সেসময় সিএমপি কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ দ্বারা সার্বক্ষণিক ‘আইস অব সিএমপি’–র মাধ্যমে সিসি ক্যামেরায় নজরদারির আওতায় আনা হবে। ৪১১টি সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকবে ৭০টি স্পট। ২টি টেকনিক্যাল টিম ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকবে। যার মধ্যে ১টি টিম ফিল্ডের টেকনিক্যাল ত্রুটি সংশোধনে নিয়োজিত থাকবে এবং অন্যটি মনিটরিং করবে কন্ট্রোল রুম থেকে।’
সিএমপি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে এসব সিসি ক্যামেরার প্রায়ই রক্ষণাবেক্ষণসহ মেরামতের অভাবে অকেজো পড়ে আছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় নষ্ট ক্যামেরাগুলো সচল করা যাচ্ছে না। যার ফলে অপরাধী শনাক্তে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের অভাবে ছিনতাইমত ঘটনার কুলকিনারা পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশের। যার ফলে পুনরায় পুরো শহরকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার জন্য একটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সিএমপি। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে এবিষয়ে বৈঠকও করেছেন সিএমপি কমিশনার।
যদিও সিএমপির ব্যবস্থাপনায় স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে সচল ক্যামেরার সংখ্যা জানাতে পারেনি সিএমপি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা এডিসি স্পীনা রাণী প্রামাণিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, সেসময় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ওইসব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। সিএমপির পক্ষ থেকে কিছু ক্যামেরা লাগানো হয়েছিলো। আর কিছু ব্যক্তিগত ক্যামেরার এক্সেস আমরা তাদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম। তবে বর্তমান কমিশনার স্যার সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ে কিছু পরিকল্পনা নিয়েছেন।’
অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (অপরাধ) এএসএম মাহাতাব উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ছিনতাই হলে থানাকে জানাতে করতে হবে। যদি কেউ না জানায়, তাহলে আমরা কী করতে পারি? থানায় নির্দেশনা দেওয়া আছে এসব ঘটনা ক্লোজ মনিটরিং করতে। কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে যে থানায় মামলা করতে গেছে কিন্তু মামলা নেয়নি তাহলে আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবো। গত মাসে ১২টি ছিনতাই হয়েছে। যার মধ্যে আমরা ১০টি ডিটেক্ট করতে পেরেছি। কয়েকদিন হচ্ছে, সিএনজি অটোরিকশা থেকে ২৭ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমরা সেগুলো উদ্ধার করে দিয়েছি। তাহলে বুঝতে পারছেন পুলিশের তৎপরতা কত দ্রুত।’
সিসিটিভি ক্যামেরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে সিএমপির ব্যবস্থাপনার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। অপরাধী শনাক্তে এসব ক্যামেরা বড় গুরুত্ব বহন করে। সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যার আওতায় বিভিন্ন পয়েন্টে নষ্ট–অকেজো ক্যামেরা আছে সেগুলো আমরা মেরামত করছি। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমরা নতুন কিছু ক্যামেরা বসাবো। যার ফলে আমরা আরও ভালোভাবে অপরাধী শনাক্ত করতে পারবো।’
ছিনতাইকারীর হালনাগাদ তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছিনতাইকারীর তালিকা কখনও ছিল না কিংবা করা হয়নি। তবে গত ৫–৭ বছরের মামলার রেকর্ড ধরে শনাক্ত করা হয় কারা আসামি, যাদের ধরা হয়েছিল তাদের মধ্যে কারা জেলে আছে আর কারা বাইরে আছে। কোনো একটা এলাকায় ঘটনা ঘটলে আমরা এই তালিকা দেখে যাচাই করি যে কারা এই ঘটনা ঘটাতে পারে, ইতিপূর্বে যারা এমন ঘটনায় জড়িয়ে আটক হয়েছিল তাদের অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আমরা কাজ করি।’