শেখ শফিউল আজম : তিনি চিকিৎসকদের নেতা, আবার আইনজীবীও!


এম কে মনির : ডা. শেখ শফিউল আজম। তিনি চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম বিভাগের সহ-সভাপতি। আবার সেই তিনিই ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ বার কাউন্সিলর প্রণীত ‘পেশাগত আচরণ ও শিষ্ঠাচার বিধিমালা’ ভঙ্গ করে ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য বা আইনজীবী হয়েছেন; যা এখনো বহাল রয়েছে।

জানা যায়, ১৯৫৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে জন্ম নেওয়া ডা. শেখ শফিউল আজমের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের উরকিরচর গ্রামে। তিনি ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি, ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস (সমাজবিজ্ঞান) ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর ১৯৮৮ সালে বার কাউন্সিলের আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন শেখ শফিউল আজম। এরপর ১৯৮৯ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন তিনি।

১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন ডা. শেখ শফিউল আজম। এমবিবিএস পাস করার পর তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন এবং সেখানে বিভিন্ন বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার ডা. শেখ শফিউল আজম। এছাড়া একুশে হাসপাতাল ও সেবা হাসপাতালের পরিচালক এবং চার তারকা মানের হোটেল পেনিনসুলার স্বাধীন পরিচালকসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন তিনি।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত ডাইরেক্টরিতে ৪৮৪ নাম্বার ক্রমিকে ডা. শেখ শফিউল আজমের ছবিসহ নাম, ঠিকানা ও মোবাইল উল্লেখ আছে; তার লিন (আইনজীবী শনাক্তকরণ নাম্বার) হচ্ছে ১৯৮৯১১০৭১৯।

অন্যদিকে ডা. শেখ শফিউল আজমের বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) মেম্বারশিপ নাম্বার হচ্ছে ১০০০১৬৯। তিনি এক সময় বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে বিএমএ কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্র্যাকটিশনার্স এসোসিয়েশনেরও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

অথচ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলর প্রণীত ‘পেশাগত আচরণ ও শিষ্ঠাচার বিধিমালার’ চতুর্থ অধ্যায়ের ৮ম ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাভাবিক বিধি এই যে, একজন আইনজীবী অন্য কোনো পেশা অবলম্বন কিংবা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না। এমনকি অংশীদার হিসেবেও কোনো পেশা অবলম্বন কিংবা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না কিংবা বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবেও কোথাও কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।’

সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে, একজন চিকিৎসক আইন অনুযায়ী, আইনি পেশায় থাকতে পারেন না। কেউ চাইলেই একই সময়ে ডাক্তার হিসেবে বিএমএ থেকে এবং আইনজীবী হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি থেকে সুবিধা নিতে পারেন না। অথচ দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে একই সাথে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্র ও সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘন করে সুবিধা গ্রহণ করছেন ডা. শেখ শফিউল আজম।

চট্টগ্রামের একজন আইনজীবী জানান, ওকালতনামা, বার ফরম বিক্রি ও দোকানঘর ভাড়াসহ বিভিন্ন খাত থেকে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি প্রচুর আয় করে থাকে। এই টাকা সমিতির সদস্যদের হিসাবে জমা হয়। কোনো আইনজীবী মারা গেলে বা সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিলে জমা হওয়া টাকাগুলো পাওয়া যায়। ডা. শেখ শফিউল আজম ১৯৮৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আইনজীবী সমিতির সদস্য; ধারণা করছি তার হিসাবে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা ইতিমধ্যে জমা হয়েছে। তিনি এখনই সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিলে এই টাকাগুলো পাবেন।

নিয়ম লঙ্ঘন করে একই সাথে ডাক্তার ও আইনজীবীদের দুটি পেশাজীবী সংগঠনে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শেখ শফিউল আজম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি আইনজীবী না, এখন ওই পেশায় নাই। প্র্যাকটিসও করি না।’ এরপরও আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ বহাল রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন অসুস্থ, শরীরটা খুব খারাপ। দেশের বাইরে আছি। দেশে আসলে আপনার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবো।’

এ বিষয়ে জাগ্রত আইনজীবী পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট টি আর খান তাহিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি নীতি-নৈতিকতার বিষয়ও। তিনি (ডা. শেখ শফিউল আজম) যদি বিএমএ’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হয়ে থাকেন তাহলে ওনার নিজ থেকে আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। কেউ যদি অন্য পেশায় থাকেন তাহলে আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ তাকে অবশ্যই স্থগিত করতে হবে। অনেকের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। ডা. শেখ মোহাম্মদ শফিউল আজম সেটি করেছেন কিনা আমি জানি না। যদি না করে থাকেন তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও আমাদের সমিতির বিধি লঙ্ঘন করেছেন তিনি। কেউ যদি ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় তাহলে ওনার হিসাবে যত টাকা জমা আছে সবগুলো বাতিল করা হতে পারে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এ এস এম বজলুর রশিদ মিন্টু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বার কাউন্সিলের সনদ দেওয়ার আগেই এসব বিষয় বার কাউন্সিল তদন্ত করে থাকে। আমাদের সমিতির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিই। বর্তমানে অনেকের সদস্যপদ স্থগিত আছে। ডা. শেখ মোহাম্মদ শফিউল আজমের সদস্যপদ স্থগিত আছে কিনা আপাতত বলতে পারছি না। তবে ডুয়েল (দ্বৈত) পেশায় থাকার সুযোগ নেই।’