সেই নারী এসআইকে গ্রেফতারে পিবিআইয়ে আবেদন

একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত থাকাকালে ২০২২ সালের ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি অনুমতি ছাড়াই ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন একজন নারী এসআই। কিন্তু ওই সময়ে অন্যের সহায়তায় তিনি সিএমপিতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন।

এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি ঢাকার একটি বাসায় কুড়িগ্রামের রৌমারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সোহেল উদ্দিনের সঙ্গে মিলেমিশে একজন নারী কর কর্মকর্তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যাচেষ্টা ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও উঠে ওই নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে।

এসব জালিয়াতি ও মারধরের অভিযোগের তদন্তে নেমে সত্যতাও পেয়েছেন সিএমপির ডিসি (বন্দর) শাকিলা সুলতানা। এই তদন্ত কর্মকর্তার জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উক্ত নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে ঢাকায় অবস্থান করে চট্টগ্রামের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার ও নারী কর কর্মকর্তাকে মারধরের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। এ ঘটনায় নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে সিএমপিতে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে।

একই ঘটনায় গত বছরের নভেম্বরে এএসপি সোহেল উদ্দিন ও নারী এসআইকে আসামি করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন ওই নারী কর কর্মকর্তা। আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করতে ঢাকার শাহজানপুর থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। একইসাথে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন।

মামলার পর এএসপি সোহেল উদ্দিন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিলেও জামিন নেননি সিএমপির হালিশহর থানার ওই নারী এসআই। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। করছেন পুলিশের চাকরিও। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আমি কেন জামিন নেব, আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? জামিন তো নিবে তারা, যারা পালিয়ে যায়।’

অথচ একই মামলার ১ নং আসামি এএসপি সোহেল উদ্দিন আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নারী এসআইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘সোহেল উদ্দিন কেন জামিন নিয়েছেন সেটি তিনি ভালো বলতে পারবেন।’

এ নারী এসআইকে গ্রেফতারে এবার পুলিশের কাছে আবেদন করেছেন মামলার বাদী নারী কর কর্মকর্তা। গত ২৩ মার্চ তিনি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। আবেদনে তিনি নারী এসআইকে গ্রেফতারে পদক্ষেপ কামনা করেছেন।

আবেদনের অনুলিপি আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি (এডমিন), পিবিআই প্রধান, সিএমপি কমিশনার, সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (এডমিন) ও হালিশহর থানার ওসির কাছে পাঠানো হয়েছে।

আবেদনে নারী কর কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনি এএসপি সোহেল উদ্দিন ও নারী এসআইকে আসামি করে দণ্ডবিধির ৩২৩, ৩২৬, ৩০৭ ও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা করেছেন। যা শাহজানপুর থানার মামলা নং ২০(১১)২২ হিসেবে রেকর্ডভুক্ত। তার মামলাটি বর্তমানে পিবিআই ঢাকা মহানগর দক্ষিণে তদন্তাধীন।

তিনি আবেদনে আরও উল্লেখ করেছেন, গত ৬ ডিসেম্বর মামলার ১নং আসামি সোহেল উদ্দিন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনপ্রাপ্ত হন। কিন্তু মামলার ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো জামিন নেননি ২নং আসামি নারী এসআই। তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ফেসবুকে পোস্ট করছেন, তিনি নিজেকে লেডি ডন হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হওয়ায় এই বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করছেন। পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না এবং তিনি এই সুযোগে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। ২ নং আসামিকে গ্রেফতারে তদন্তকারী কর্মকর্তা অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

নারী কর কর্মকর্তা তার আবেদনে মামলার আসামি নারী এসআই ও সোহেল উদ্দিন তদন্তকারী সংস্থা থেকে বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার অভিযোগ, আসামিকে গ্রেফতারের জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অনুরোধ করা হলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। সিএমপিতে নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। সেই অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।

নারী কর কর্মকর্তা আরও অভিযোগ করেন, নারী এসআইকে পিবিআই গ্রেপ্তার না করায় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আসামি নারী এসআই নারী কর কর্মকর্তার বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে অরুচিকর ও হুমকিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতে তিনি একদিকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন, অন্যদিকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

নারী কর কর্মকর্তার দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, নারী কর কর্মকর্তা ও এএসপি সোহেল উদ্দিন দুজনেই বিসিএস কর্মকর্তা। ২০১৭ সালে বিসিএস পরীক্ষার সময় তাদের পরিচয় হয়। পরে বন্ধুত্ব, অতঃপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। একসময় সোহেল উদ্দিন ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তাকে পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয়ের কথা বলে তার চাঁদপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে দীর্ঘ ৪ বছরের অধিক প্রেমের সম্পর্ক চলমান ছিল। এসময়ে ভুক্তভোগীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সোহেল উদ্দিন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এমনকি বিশ্বাস জোগাতে সোহেল উদ্দিন ওই নারীর বাসার পাশে ঢাকার মালিবাগে ভাড়া বাসা নেন। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে সোহেল উদ্দিন নারী কর কর্মকর্তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন।

২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগী বেশ কয়েকবার কল ও ক্ষুদেবার্তা পাঠাতে থাকেন। পরে সোহেল উদ্দিনের মালিবাগের পাবনা কলোনীর ষষ্ঠ তলার বাসায় গিয়ে বেশ কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়লেও সোহেল দরজা খুলেননি। সেদিন দরজা না খুলে সোহেল ভুক্তভোগীকে ক্ষুদেবার্তায় জানিয়ে দেন, দরজা খোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর সোহেল দরজা খুলে দিলে ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তা ভেতরে প্রবেশ করে সিএমপির নারী এসআইকে তার সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। এসময় তাদের উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী জানতে চাইলে সোহেল উদ্দিন ও নারী এসআই অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। তারা নারী কর কর্মকর্তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করেন এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন চালান। মারাত্মক জখম, ছুরিকাঘাত ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।

মামলায় অভিযুক্ত সোহেল উদ্দিন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার মনতলা গ্রামের মৃত হাবিব উল্লাহর ছেলে। মামলা দায়েরের সময় তিনি আমর্ড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন (এবিপিএন) হেডকোয়ার্টার্সের সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন।

গত বছরের ২৭ নভেম্বর তাকে কুড়িগ্রামের রৌমারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে এএসপি মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া, অর্থ আত্মসাৎ, যৌতুক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ যে অভিযোগগুলো এসেছে তার কোনোটিই সত্য নয়। নারী কর্মকর্তা তাকে ফাঁসাতে এই অভিযোগগুলো করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানজিনা আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি একটি সেনসেটিভ মামলা। বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করছি। মামলার এক নম্বর আসামি আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। আমি সেটার পেপারস পেয়েছি।’

দুই নম্বর আসামিকে গ্রেপ্তার করা হবে কিনা কিংবা কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, পুলিশ হওয়ায় আসামি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হননি।

# পুলিশের এএসপি সোহেলের বিরুদ্ধে নারীদের যত অভিযোগ
# সিএমপির এক নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে নারী করকর্মকর্তাকে মারধরের সত্যতা মিলেছে