কম লাভে এফডিআর রাখছে চট্টগ্রাম ওয়াসা, কমিশন ছাড়া মেলে না চেক!


এম কে মনির : বার্ষিক ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মুনাফায় ফিক্সড ডিপোজিট রেট (এফডিআর) বা স্থায়ী আমানত রাখতে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে গত মার্চ মাসে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা। কিন্তু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে চট্টগ্রাম ওয়াসা ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মুনাফায় এফডিআর করেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দেওয়ানহাট শাখায়! অর্থ্যাৎ একই ব্যাংক হলেও দেওয়ানহাট শাখায় কম লাভে টাকা রেখেছে ওয়াসা।

একইভাবে গত মার্চ মাসে বার্ষিক ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় এফডিআরই রাখা হয়নি। অথচ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ মুনাফায় টাকা রাখা হয়েছে এক্সিম ব্যাংকের সিইপিজেড শাখায়। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় এফডিআর রাখা হয়েছে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মুনাফায়। উক্ত এফডিআরগুলো চলতি এপ্রিল মাসে রাখা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে কম লাভে ব্যাংকে এফডিআর রেখেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা; এর মাধ্যমে হচ্ছে রাষ্ট্রের বিপুল আর্থিক ক্ষতি। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত আছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফডিআর রাখা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলছে চট্টগ্রাম ওয়াসায়। কয়েক বছর আগেও পাকিস্তানের ব্যাংকে পর্যন্ত এফডিআর রাখার ঘটনা ঘটেছে। এফডিআর রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ‘স্থায়ী কমিটি’ গঠন করা গেলে, এ বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পের চুক্তিমূল্য অনুসারে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন দাবি ও নানাভাবে তাদেরকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে গত ১১ এপ্রিল ওয়াসার এমডি এ কে এম ফয়জুল্লাহর কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা ঠিকাদার সমিতি।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার ঠিকাদাররা বিভিন্ন প্রকল্পে অংশ নিয়ে পানি সরবরাহ ও পানি উৎপাদনে সহযোগিতা করে আসছে। পাশাপাশি এনআরডব্লিউ কম রাখতে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পের পাইপ লাইন মেরামত, চুনা ও ক্যামিকেল সরবরাহ, প্লান্টে এলার্মসহ নানাভাবে কাজ করে আসছেন তারা। কিন্তু ঠিকাদারদের কাজের বিল হিসাব শাখায় আনার পর চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করছেন। তার দপ্তর থেকে প্রতিটি ফাইল ছাড়িয়ে নিতে কমপক্ষে ৫-৬ দিন সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এসব বিষয়ে ঠিকাদার সমিতি বারবার তার দপ্তরে যোগাযোগ করলেও কোনো প্রকার প্রতিকার মেলেনি। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা ওয়াসার এমডির কাছে নালিশ করেছেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলাম ঠিকাদারদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন এবং চুক্তিমূল্য অনুসারে অনৈতিকভাবে কমিশন দাবি করেন। তার চাহিদা মতো সুবিধা দিতে ব্যর্থ হলে তিনি ফাইল নিয়ে ঘোরান। অনেক সময় বিলের ফাইলে সই করলেও চেকে স্বাক্ষর না করে হয়রানি করেন। এমনকি একটি চেক স্বাক্ষর করতে এক সপ্তাহ সময় নিয়েছেন আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলাম, এমন নজিরও রয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ঠিকাদার সমিতি দিয়েছিল। কিন্তু সেটিরও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

ঠিকাদার সমিতির দেওয়া অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সিডিউল দর অনেক পুরাতন। বর্তমানে ওই দরের সাথে বাজারের দরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তার উপর এসব বাড়তি খরচ মিটানো খুব বেশি চাপের। অনেক সময় তাদেরকে লোকসান দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। উপরন্তু হয়রানির শিকার হয়ে অনেক ঠিকাদার ক্ষুব্ধ হয়ে বাৎসরিক কাজ বন্ধ করে দিতে চান। চট্টগ্রাম ওয়াসা ঠিকাদার সমিতি তাদেরকে মানিয়ে রেখেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসা ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মির্জা মোহাম্মদ মনসুরুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এমডি স্যারের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছি। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা প্রেস কনফারেন্স করব।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করিনি এবং দাবিও করিনি। তাছাড়া চেক ও বিল দিতে বিলম্বের কারণ হচ্ছে, এগুলো যাচাই-বাছাই করতে হয়। এজন্য সময় লাগে।’

যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কাজে ঠিকাদার বা অন্য কেউ অনিয়ম করলে সেটার দায় বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের ওপর স্বাভাবিকভাবে আসে না; এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব অন্য কর্মকর্তাদের। এরপরও চেক ও বিল দিতে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক গড়িমসির অভিযোগ, ঠিকাদারদের অভিযোগকেই ভিত্তি দেয়।

কম মুনাফায় এফডিআর রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক আবু শাফায়াত মো. শাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে এমডি স্যার সিদ্ধান্ত দেন৷ তার সিদ্ধান্তেই এফডিআর রাখা হয়।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম ফজলুল্লাহ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘একজন সম্মানিত মানুষ হয়ে তিনি (বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক) এটা (এফডিআর রাখা নিয়ে অনিয়ম) করবেন না। তবুও আপনি যেহেতু বলছেন আমি বিষয়টি দেখব। অনিয়ম করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবো। আমি এসব বিষয়ে খুবই দায়িত্বশীল ও সতর্ক।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ৯ শতাংশ মুনাফায়ও এফডিআর রাখি। এক্ষেত্রে আমরা বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিই।’

ঠিকাদারদের অভিযোগের বিষয়ে একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘আমি ঠিকাদারদের অভিযোগটি পেয়েছি। ওয়াসার সচিবকে বিষয়টি তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কম লাভে এফডিআর রাখা ও কমিশন ছাড়া ঠিকাদারদের চেক না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এসব বিষয় আমার কাছে আসবে সবার শেষে। এসব বিষয় বোর্ডে তোলা হলে জানতে পারব।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘একদিকে চট্টগ্রাম নগর জুড়ে পানির জন্য হাহাকার চলছে। অন্যদিকে ওয়াসার কিছু কর্মকর্তা ব্যস্ত অনিয়ম-দুর্নীতিতে। এফডিআর রাখা নিয়ে অনিয়ম ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। তদন্তের ক্ষেত্রে ওয়াসার কর্মকর্তারা যেন যুক্ত না থাকেন, এ ধরনের তদন্ত ওয়াসার বাইরের কর্মকর্তা ও দুদক দিয়ে করানোর দাবি জানাচ্ছি।’