চট্টগ্রাম : ১৯৭৯, ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৩ সালে ফের বাকশাল (রাজ্জাক) গঠন করে এরশাদের পতনের পরপরই ১৯৯১ সালের শুরুতে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। বলাবাহুল্য, ১৯৯১ সালে ৫ম সংসদে আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচন করে দুটি আসনেই জয়লাভ করেন আবদুর রাজ্জাক।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য হন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে পানিসম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৮ম সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে ৫ম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন (এর আগে ‘৭০ এ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ১৯৭৩ এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের সদস্য)। অষ্টম সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন আবদুর রাজ্জাক।
পরবর্তীতে শূন্য আসনে তাঁর সন্তান নাহিম রাজ্জাককে মনোনয়ন দিয়ে এমপি হওয়ার সুযোগ করে দেন শেখ হাসিনা। সেই ধারাবাহিকতায় নবম ও দশম সংসদেও নৌকা প্রতীকে এমপি হন নাহিম রাজ্জাক।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৮ বছর পৃথক রাজনৈতিক দল (বাকশাল) গঠন করা আবদুর রাজ্জাককে আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে এনে একপ্রকার পুরস্কৃত করা হলেও তার সাথে বাকশাল ও অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ করা নেতৃবৃন্দকে যেন এখনো ক্ষমা করেননি আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী। অথচ তারাও আবদুর রাজ্জাকের সাথে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে ফিরেছেন, পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পদপদবী ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হয়েছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সারাদেশেই বাকশাল থেকে আওয়ামী লীগে ফেরা নেতাকর্মীদের নিয়ে কমবেশি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে এই নেতিবাচক মনোভাব যেন প্রকট। কেউ কেউ অতিরঞ্জন করে এটাকে গালাগালে পরিণত করেছেন। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ‘বাকশাইল্যা’ বলে গালমন্দ করতেও দ্বিধা করে না আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ একটি অংশ।
স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত জাতীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালে মারা যান। ‘৯১ থেকে ২০১২– দীর্ঘ ২১ বছর ছাত্ররাজনীতির সিংহপুরুষ খ্যাত জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে দলীয় ও সরকারিভাবে কোনো কাজে লাগানো হয়নি। আর এর কারণ হিসেবে বাকশাল করাকেই দায়ী করা হয় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে। একধাপ এগিয়ে গিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বাকশাল করা নেতৃবৃন্দকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এখনো মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি বলেও একধরনের অপপ্রচার চালানো হয়।
স্মর্তব্য যে, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে জাতীয় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের মনোনয়ন ইস্যুতে তাকে নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একটা অপপ্রচার দানা বাঁধে।
একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, বাকশাল-তকমার কারণে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নাকি বলেছেন ‘বাকশাল করা লোককে অনেক দিয়েছি। আর নয়। এবার সালাম বাদ। এটিএম পেয়ারুল ইসলামকেই জেলা পরিষদে মনোনয়ন দেব।’ সেই মহলটি চাউর করে যে, ‘শেষপর্যন্ত তাই হয়েছে। বাকশালি গন্ধে সালামকে বাদ দিয়ে পেয়ারুলের হাতেই মনোনয়ন তুলে দেন শেখ হাসিনা।’
অথচ এই গল্প যারা বানিয়েছেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন যাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেই এটিএম পেয়ারুল ইসলামও আবদুর রাজ্জাকের বাকশাল করতেন। ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্বে।
শুধু তা নয়, গায়ে বাকশাল গন্ধ থাকায় এম এ সালামকে জীবনে একটিবারের জন্য এমপি হওয়ার সুযোগ দেননি শেখ হাসিনা। আগামিতে সালাম আর কোনো সুযোগ পাবেন না- এমন নেতিবাচক কথাও উঠে আসে মহলবিশেষের আলোচনায়।
বাস্তবে দেখা যায়, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এম এ সালামের অর্জনই অপেক্ষাকৃত বেশি। ১৯৯২ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে এম এ সালাম উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম বৃহৎ ইউনিট চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৩৭ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে অল্প ভোটে পরাজিত হন। সেবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের ফলে পরাজিত হয়েও ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে হাটহাজারীর প্রভূত উন্নয়নে শরীক হন এম এ সালাম।
সে সময় রাজনৈতিক বোদ্ধাদের এমনও বলতে শোনা গেছে, ২০০১ সালে হাটহাজারী আসনে এম এ সালামের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। কারণ, ‘৯৬ -এর পর তিনি এক মুহূর্তের জন্যও মাঠ ছেড়ে যাননি।
কিন্তু ২০০১ সালের ৭ম সংসদ নির্বাচনে দেখা গেল, সালামের আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলকে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন অর রশিদের আত্মীয় বাবুলকে বিশেষ বিবেচনায় হাটহাজারী আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলেও সালামের লাগানো গাছের ফল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হন বাবুল। ফলে হাটহাজারীর আসনটি আবারও চলে যায় বিএনপির ঘরে।
এদিকে ২০১১ সাল থেকে ২০২২– টানা ১০ বছর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক ও চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের সুবাদে চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ পান এম এ সালাম। দীর্ঘ এই সময়ে তার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠা দূরঅস্ত, বরং দিনশেষে প্রশংসার জোয়ারে ভেসেছেন এম এ সালাম।
এছাড়াও ২০১৯ সালে কাউন্সিলরদের বিপুল ভোটে চারবারের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এম এ সালাম। সব ছাপিয়ে সৎ, সজ্জন, কর্মীবান্ধব, নিয়মিত পড়াশোনা করা ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে এম এ সালাম চট্টগ্রামের রাজনীতিতে স্বকীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন বলে ব্যাপক আলোচনা আছে চট্টগ্রামে রাজনীতি-সচেতন মহলে।
একইভাবে জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, একসময়ের ডাকসাঁইটে ছাত্রনেতা খোরশেদ আলম সুজনকে নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্যের কমতি নেই চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির বিশেষ মহলে। এমনও বলা হয়, বাকশাল করার কারণে তিনি উপেক্ষিত।
রাজনৈতিক সচেতন মহলের মতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাবল মাস্টার্স করা খোরশেদ আলম সুজন চট্টগ্রামের কয়েকজন মেধাবী রাজনীতিকের অন্যতম। রাজনীতি ছাড়া সাহিত্যের প্রতিও তাঁর প্রবল ঝোক। বঙ্গবন্ধুর কবরে খোদাই করা এপিটাফ তার নিজের লেখা। ২০০৮ সালের ৮ম সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গা আসনে শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত আওয়ামী লীগের মনোনয়নের চূড়ান্ত চিঠি পেয়েও বিশেষ ‘হিসাবনিকাশে’ রাতারাতি তার মনোনয়ন পাল্টে যায়।
২০২০ সালে করোনার কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হলে সরকার সুজনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়। ৬ মাসের দায়িত্ব পালনে কিছু ভুলভ্রান্তি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও খোরশেদ আলম সুজনের নেওয়া কিছু উদ্যোগ দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ সভাপতি সুজন।
বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীও বাকশালের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বাকশাল বিলুপ্ত করে আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও বাকশালের হয়ে তৎকালীন চট্টগ্রাম-১০ (বর্তমানে চট্টগ্রাম-৮) নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফাইনালি সরে পড়েন।
একইভাবে জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বর্তমানে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা গিয়াস উদ্দিন (সাবেক মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান), জাতীয় ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি মশিউর রহমান (বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক), জাতীয় ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি জালাল উদ্দিন ইকবাল (চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক), জাতীয় ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী (চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক), জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী (চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য), জাতীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলমকে (চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক) চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে বাকশাল-তকমায় জড়িত করা হলেও স্ব স্ব ক্ষেত্রে উল্লিখিত নেতারা নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
তবে বিপরীত মেরুর মূল আওয়ামী লীগারদের একটি অংশের দাবি, আওয়ামী লীগের পরিচয় গায়ে মাখলেও তাদের ভেতরে এখনো বাকশালীয় চেতনা। আওয়ামী লীগের পদপদবী ব্যবহার করে নিজেদের গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা আওয়ামী লীগে বিভাজন ও অন্তর্কলহে বিশ্বাসী।
পক্ষান্তরে বাকশাল-ট্যাগ গায়ে থাকা নেতাদের কেউ কেউ এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তারা বলছেন, যারা মেধার রাজনীতির সাথে টিকতে পারেন না, তারাই আর কিছু না পেয়ে কথায় কথায় বাকশাল-তকমা জুড়ে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করেন।