শরীফুল রুকন: কামরুল হাসান টিটু। তার ডান পা নেই। বাঁ পায়েও সমস্যা। একা চলাফেরা তো দূরের কথা, কারও সাহায্য ছাড়া হুইলচেয়ারে উঠা বসার উপায় নেই। তবু ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় পুলিশ তাকে করেছে আসামি। একটি পা হারিয়ে নতুন করে চার মামলা লাভ করেছে টিটু।
পুলিশের ভাষ্য, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয় টিটু। ওইদিন রাতে রাউজানে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। চিকিৎসার সময় একটি পা ও দুই হাতের একটি করে দুইটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয় তার। ১৬ দিন চিকিৎসা শেষে তাকে আদালতে হাজির করে রাউজান থানা পুলিশ।
ওই ঘটনায় টিটুর নামে নতুন করে যুক্ত হয় দুই মামলা; একটি বিস্ফোরক দ্রব্য, অন্যটি অস্ত্র আইনে। ২০১৬ সালে ৪ দিনের ব্যবধানে তার নামে যোগ হয় আরও দুই মামলা। ওই বছর ৬ আগস্ট পঙ্গু টিটুর বিরুদ্ধে দায়ের হয় ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা। ৯ আগস্ট নারী নির্যাতনের অভিযোগে টিটুর বিরুদ্ধে ‘মামলা করেন’ তার স্ত্রী পারভিন আক্তার।
২০১৬ সালে দায়েরকৃত এই দুটি মামলা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এরমধ্যে ডাকাতি মামলার বাদি রাউজান থানার এসআই শেখ মো. জাবেদ মিয়া; যার বিরুদ্ধে ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরুকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ১২ এপ্রিল নুরুর স্ত্রী সুমি আক্তার আদালতে মামলার আরজিতে এসআই জাবেদের নেতৃত্বে নুরুকে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেন।
এ বিষয়ে কামরুল হাসান টিটু বলেন, ‘এক পা নেই। আরেকটি পা অকেজো। আরও নানা শারীরিক সমস্যা আছে। দৌড়ে পালানো দূরের কথা, ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারি না। এরপরও ডাকাতি মামলায় আসামি করা হয়েছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে এসআই শেখ মো. জাবেদ মিয়া বলেন, ‘৬ আগস্ট রাত ১টায় নোয়াপাড়ায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গ্রেফতার হন সরোয়ার ও মমিন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে টিটুসহ আরও ২১ থেকে ২২ ডাকাত পালিয়ে যায় বলে গ্রেফতার দু’জন পুলিশকে জানায়। এ কারণে টিটুকে আসামি করা হয়।’
এদিকে নারী নির্যাতনের অভিযোগে টিটুর বিরুদ্ধে যে স্ত্রী মামলা করেছেন, তিনিই আবার গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন এই মামলা দায়ের হওয়া নিয়ে। টিটুর স্ত্রী পারভিন আক্তার বলেন, ‘চাষাবাদ ও মাছের পোনা চাষ করে তিনি (স্বামী) সংসার চালাতেন। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে পুলিশ আমার স্বামীকে গুলি করে। দেড় বছর পর কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় আটক করে রাউজান থানা পুলিশ। এরপর ওসি কেপায়েত সাহেব দেখেন যে পায়ের অবস্থা খারাপ। সেদিন স্বামীকে ছেড়ে দেবে বলে পুলিশ আমাকে একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে। ১০-১২ দিন পর জানতে পারি অসুস্থ স্বামীর বিরুদ্ধে আমি নাকি নির্যাতনের অভিযোগ করেছি। এরপর মামলাটিতে জামিন নেওয়ার জন্য আদালতে গিয়ে জানতে পারি, ডাকাতি মামলায়ও তাকে আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি আমি ও আমার ছেলে-মেয়ে আদালতে বলেছি। এরপর আদালত এই দুই মামলায় জামিন দিয়েছেন।’
এদিকে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট রাউজানে যুবলীগকর্মী মোবারক হোসেন হত্যার ঘটনায় আসামি করা হয় টিটুকে। সবমিলিয়ে পুলিশের খাতায় টিটুর নামের পাশে এখন পাঁচ মামলা।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতে কথা হয় টিটুর সঙ্গে; তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর বালুর ব্যবসা নিয়ে যুবলীগের মোবারকের সঙ্গে তার নিজ দলের লোকজনের বিরোধ ছিল। মোবারক হত্যার প্রধান আসামি ডালিম যুবলীগ করতেন। তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। এরপরও রাউজান বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছালামত আলীসহ আমাকেও আসামি করা হয়। উদ্দেশ্য শুধুই হয়রানি।’
কামরুল হাসান টিটু বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতি করতাম একসময়। এটাই একমাত্র দোষ। ১৯৯৬ সাল থেকে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলায় জড়ানো হয়েছে আমাকে। ’৯৬ সালে পুলিশের ওপর হামলা ও পুলিশ ক্যাম্প লুটের মামলায় আদালত খালাস দিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন অভিযোগই প্রমাণ হয়নি। সর্বশেষ খোকন হত্যা মামলা থেকেও আমি বেকসুর খালাস পেয়েছি।’
টিটুর ৩ মেয়ের মধ্যে দুইজনের বিয়ে হয়েছে; অন্যজন নবম শ্রেণীতে পড়ে। ১১ ও ৬ বছর বয়সী দুই ছেলেও আছে তার। পঙ্গু হওয়ার পর কাজকর্ম করতে পারেন না। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায়। টিটু বলেন, ‘পুলিশের হয়রানির ভয়ে এখন বাড়ি-ঘরেও যেতে পারি না। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমি বিক্রি করে চলছে সংসার। মানুষের দোয়া আছে বলেই হয়তো এখনও বেঁচে আছি; যে পরিস্থিতি পার করে এসেছি, আমার তো বেঁচে থাকারই কথা নয়।’
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘অনিয়ম-অপরাধ করে পুলিশ সদস্যরা পার পায় না। অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’