রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

মেরিডিয়ানের বর্জ্যে অতিষ্ঠ জীবন, নেই ইটিপি ও পরিবেশ ছাড়পত্র

প্রকাশিতঃ ২২ মার্চ ২০২৩ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন


এম কে মনির : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মেরিডিয়ান গ্রুপের চিপস কারখানার অপরিশোধিত পানি ও বর্জ্য যাচ্ছে পাশ্ববর্তী শতবর্ষী একটি খালে। এতে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির, ব্যাহত হচ্ছে মৎস্য চাষ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মেরিডিয়ান কারখানা কর্তৃপক্ষ অপরিশোধিত বর্জ্য খালে ফেলছে। আর এসব বর্জ্য পঁচে-গলে ওই খালের পানিকে বিষিয়ে তুলেছে। কালো রঙ ধারণ করা বিষাক্ত এসব পানি থেকে ছড়াচ্ছে মশা, মাছি আর তীব্র দুর্গন্ধ। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও পথচারীরা। তীব্র পঁচা দুর্গন্ধ আশপাশের এক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে; দুর্গন্ধের কারণে পাশ্ববর্তী একটি ফিলিং স্টেশনে প্রতিনিয়ত আসা পরিবহনের যাত্রীদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

সরেজমিন সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড সারেং পাড়া টেকনো ফিলিং স্টেশন সংলগ্ন ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফিলিং স্টেশনের উত্তর পাশেই মেরিডিয়ানের চিপস কারখানার অবস্থান। এ কারখানায় মেরিডিয়ানের কিন চিপসসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদন করা হয়। আর এটির পেছন দিয়ে পাহাড় থেকে বয়ে আসা শত বছরের একটি খাল সোজা চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে।

খালটি সেখানকার কয়েক গ্রামের পানি চলাচলের একমাত্র পথ। বর্ষাকালে এ খাল দিয়েই পাহাড়ি ঢল ও গ্রামের পুকুর ডোবায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি সাগরে নামে। এতে বন্যার কবল থেকে রক্ষা পায় গ্রামবাসী। তবে সময়ের সাথে সাথে ওই এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় দখল-দূষণে খালটির আকার ক্রমশ ছোট হয়ে পড়েছে। এখন আর আগের মতো পানির প্রবাহও ঠিক নেই এটির। পাশের পরান পুকুর ও মহাসড়ক সংস্কারের সময় খালটি আপন গতি হারিয়েছে। এসব কারণে খালটি এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

পানি নিষ্কাশনের জন্য স্থানীয়রা নানাভাবে খালটি জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘ ১ দশক ধরে এ খালেই কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলছে মেরিডিয়ান। এতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পানি চলাচলের একমাত্র ভরসা এ খালটি। বিশেষ করে মেরিডিয়ানের চিপস তৈরির কাঁচামাল আলু পঁচে যাওয়ার পর সেগুলো বস্তায় বস্তায় ফেলা হয় এ খালে। এছাড়াও কারখানার কালো পানি দেদারছে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে খালটিতে। যা টেকনো ফিলিং স্টেশন সংলগ্ন মহাসড়কের কালভার্টের মুখে এসে জমা হচ্ছে। এসব বর্জ্য পঁচে-গলে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ বাড়িয়েছে রোগজীবাণু, মশা, মাছির উপদ্রব। এতে জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকিতে পড়েছে তেমনি পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, মেরিডিয়ান চিসপ কারখানা চালু হওয়ার পর থেকে এলাকার কৃষি জমি ও ফল বাগানে কাজ করা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। বর্জ্যের তীব্র পঁচা দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এলাকার মানুষজন। একই কথা বলেন, ব্যবসায়ী নুর হোসেন ও মৎস্য চাষী জামাল। তারা বলেন, এসব দুর্গন্ধ নাকে নিতে নিতে আমাদের অনেকেই হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। বর্ষাকালে খালে পানি প্রবাহিত না হলেও পঁচা বর্জ্যগুলো মানুষের ঘরবাড়িতে ও পুকুরে গিয়ে পড়ে। যা অসহ্যকর। এতে একদিকে মাছ চাষ ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে মাছ মরে গিয়ে আমরা লোকসানে পড়ছি। এলাকার দোকানগুলোতে বসতে পারি না ঠিকমতো। বাধ্য হয়ে বাজে দুর্গন্ধ সহ্য করে যেতে হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাফায়াত হোসেন জাহেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমাদের পানি চলাচলের একটি ড্রেন মেরিডিয়ান চিপস কারখানার বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে। যা আগে সম্পূর্ণ সচল ছিল। এতে পানি নিষ্কাশনের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা সীতাকুণ্ড পৌরসভাকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছি। এছাড়া মেরিডিয়ান কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে। রাসায়নিক পদার্থে যে পরিমাণ মেডিসিন দেয়ার দরকার তা তারা দিচ্ছে না, অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলে দিচ্ছে। এটি তারা করতে পারেন না। প্রতিষ্ঠানটি নিঃসৃত বর্জ্যের জন্য ইটিপি ব্যবহার করে কিনা আমার সন্দেহ।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবু জাফর একুশে পত্রিকাকে বলেন, দুর্গন্ধে বাড়িঘরে টেকা দায় হয়ে পড়ে। বারবার পৌরসভাকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। খালটি মেরিডিয়ানের বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে আমাদের ডুবে মরতে হবে। পানি যাওয়ার আর কোনো পথ রইলো না। মেরিডিয়ান কারখানায় কোনো ধরণের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আছে কিনা আমার জানা নেই। থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।

জানতে চাইলে মেরিডিয়ান চিপস কারখানার ম্যানেজার রাজিব চাকমা একুশে পত্রিকাকে বলেন, আসলে খালটিতে শুধু আমাদের বর্জ্য নিঃসরণ করা হয় না, সেখানে স্থানীয়রাও বর্জ্য ফেলে। আমরা যে পানিগুলো ফেলি তাতে ব্লিচিং (ক্যামিকেল) পাউডার দিয়ে দেয়া হয়। পানি পরিশোধন করেই খালে ফেলা হয়। এ ফ্যাক্টরি এখানে ১০ বছর ধরে। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এসেছেন এবং দেখেও গেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও ইটিপি ব্যবহার করা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ইটিপি নেই। আমরা কেবল পাউডার দিয়ে পানিগুলো পরিশোধন করি। ছাড়পত্রের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, মেরিডিয়ান নামে সীতাকুণ্ডে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এ নামে কোনো ফাইলও নেই আমাদের অফিসে। এতে ধরে নিতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তারা অবস্থানগত, পরিবেশগত কোন প্রকাশ ছাড়পত্র নেয়নি। ছাড়পত্র ছাড়াই উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বলেন, আমি এর আগে একবার তাদেরকে (মেরিডিয়ান) নোটিশ দিয়ে ডেকেছিলাম। তারা বলেছেন বর্জ্য নাকি খালে ফেলা হয় না। তারা শুধু পানি ফেলে। আসলে এদের পানিটাই দূষিত। খালে ফেলা এসব পানি কালো বর্ণ ধারণ করে দুর্গন্ধ ছড়ায়। স্থানীয়রা যদি লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে আমরা মেরিডিয়ানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।