জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একটি মসজিদের ইমাম আব্দুল লতিফ চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চান। এজন্য সহজে পাসপোর্ট পাওয়ার আশায় যোগাযোগ করেন নগরের লালদিঘিস্থ আল সাফা ট্রাভেল এজেন্সির সাথে। এজেন্সিটির এজেন্ট মিন্টু ১০ বছর মেয়াদের ৪৮ পাতা পাসপোর্টের জন্য ১০ হাজার টাকা (যদিও সরকার নির্ধারিত ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা) দাবি করেন। তবে দর কষাকষির পর সাড়ে ৮ হাজার টাকায় পাসপোর্ট করে দিতে রাজি হন মিন্টু। ওই দিনই সেই টাকা মিন্টুকে পরিশোধ করে দেন লতিফ।
গত ১২ জানুয়ারি আব্দুল লতিফের পাসপোর্ট আবেদন অনলাইনে সম্পন্ন করেন মিন্টু। চারদিন পর পেমেন্ট স্লিপ ও যাবতীয় ডকুমেন্টস নিয়ে চট্টগ্রামের মনসুরাবাদস্থ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গেলে কাউন্টার থেকে লতিফকে জানানো হয় তার ‘পেমেন্ট লক’ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে তাকে ২০২ নং কক্ষে (পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী) যেতে বলা হয়। সেখানে গেলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা লতিফকে জানান, এটা পেমেন্ট সংক্রান্ত সমস্যা। যেখান থেকে ফি জমা দেওয়া হয়েছে সেখানে বিষয়টা জানাতে বলা হয় আব্দুল লতিফকে।
অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি এবার ছুটে যান এজেন্ট মিন্টুর কাছে। মিন্টু জানান, পেমেন্ট সঠিকভাবে করা হয়েছে। পেমেন্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্ট প্রিন্ট করে তাকে দেখান, বোঝাতে চেষ্টা করেন- এখানে তার কোনো ভুল নেই। তিনি এর দায়ভার চাপিয়ে দেন পাসপোর্ট অফিসের উপর। এ বিষয়ে এজেন্সি থেকে কোনো সহায়তা করা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দেয় এজেন্ট মিন্টু। উপায়ান্তর না পেয়ে পুনরায় পাসপোর্ট অফিসে গেলে তাকে জানানো হয় এটি পাসপোর্ট অফিস থেকে নয় বরং পেমেন্ট প্রক্রিয়ায় গলদের কারণে হচ্ছে।
তারপরও পেমেন্ট লক হওয়া ভুক্তভোগীদের বিষয়টি উল্লেখ করে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে মেইল পাঠায় মনসুরাবাদস্থ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস। আব্দুল লতিফের জন্যও এমন একটি মেইল পাঠানো হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এ সংক্রান্ত আপডেট তাকে জানানো হবে বলে আশ্বস্ত করেন ওই কর্মকর্তা। মাসখানেক আগে তাকে পাসপোর্ট অফিস থেকে ফোন করে জানানো হয় তার সমস্যাটির সুরাহা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সমাধানের একমাত্র উপায় পুনরায় ফি পরিশোধ করা। শেষ পর্যন্ত পুনরায় ফি পরিশোধ করে গত সপ্তাহে পাসপোর্টের পরবর্তী ধাপ সম্পন্ন করেন আব্দুল লতিফ।
ভুক্তভোগী আব্দুল লতিফের মতো পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘পেমেন্ট লক’ সমস্যা। সারাদেশের প্রায় প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসেই বেশ কিছু আবেদনকারীকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেওয়ার পরও অজানা কারণে পেমেন্ট লক হয়ে যাওয়া নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই আবেদনকারীদের। ব্যাংক-পাসপোর্ট অফিস একে অপরকে দোষারোপ করলেও সুরাহা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে বেশিরভাগ আবেদনকারীকেই পুনরায় পেমেন্ট করতে হচ্ছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় অফিসে প্রতিমাসে প্রায় শ’খানেক এবং আঞ্চলিক অফিসে ১০ থেকে ১৫ জন আবেদনকারীর পেমেন্ট লক সমস্যা হয়ে থাকে। প্রশ্ন উঠেছে, নিয়মমাফিক পাসপোর্ট ফরম পূরণ, আবেদন ও ব্যাংকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়েও কেন এই ভোগান্তি? এর সুরাহা কী? যদিও কেন এমনটা হচ্ছে বা এর সমাধান কী তা সেবাদাতা কিংবা সেবাগ্রহীতা কেউই জানতে পারেন না।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মূলত মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) মাধ্যমে পাসপোর্ট ফি পরিশোধে এ ধরনের সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি। অনভিজ্ঞতা, ভুল নিয়মে ফি জমা দেওয়াসহ নানা কারণে এমনটা হয়ে থাকে। শুধু যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ফি পরিশোধ করে এমনটা হচ্ছে তা নয়, ব্যাংক থেকে ফি পরিশোধ করে পেমেন্ট লক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন অনেকেই।
জানা গেছে, শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে সর্বশেষ ৮০ জন আবেদনকারীর পেমেন্ট লক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আবু সাইদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যদিও এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না, তারপরও যারা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাদের আইডিগুলো আমরা ঢাকায় পাঠাই। যেসব আইডিগুলোর পেমেন্ট সার্ভার জটিলতার কারণে হয় সেগুলো সমাধান করে দেওয়া হয়। কিন্তু ভুল আইডিতে পেমেন্ট হলে কিছু করার থাকে না।’
পেমেন্ট লক সমস্যার কথা উল্লেখ করে বরিশাল বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপ-পরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রতি মাসে ৬-৭টি পেমেন্ট লক সমস্যা সংক্রান্ত আবেদন আমাদের কাছে আসে। সেগুলো আমরা ঢাকায় টেকনিক্যাল টিমের কাছে ফরোয়ার্ড করি, যেগুলো সমাধান করা সম্ভব হয় সেগুলো আমরা প্রসেসিং করে দেই। আর যেগুলো সমাধানযোগ্য নয় সেগুলোর ক্ষেত্রে পুনরায় পেমেন্ট করতে হয়ে।’
ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি, মাসখানেক হবে। এসময়ের মধ্যে আমার জানা মতে পেমেন্ট লক সমস্যা সংক্রান্ত আবেদন আসেনি। তবে এর আগে এ ধরনের বেশকিছু অভিযোগ জমা পড়েছিল বলে জানতে পেরেছি। তবে অনেক অফিসেই এ ধরনের সমস্যাটি হচ্ছে, পেমেন্ট লক সমস্যাটি সেবাপ্রত্যাশীদের বেশ ভোগাচ্ছে।’
উপরোল্লিখিত অফিস ছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, ফেনীসহ প্রায় প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসেই এই সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। টেকনিক্যাল টিমের কাছে জানতে পেরেছি সমস্যাটি পেমেন্টে গলদের কারণে হচ্ছে। তারপরও ভুক্তভোগীদের আইডিগুলো পাসপোর্ট অফিস থেকে মেইল করে পাঠালে আমরা চেষ্টা করি সমস্যা ফাইন্ড আউট করার।’
পেমেন্ট লক সমস্যা এড়াতে সেবাপ্রত্যাশীদের করণীয় কী জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা জানান, একই নামে একাধিক ব্যক্তির পাসপোর্ট আবেদন থাকে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ভুলক্রমে অন্য ব্যক্তির আইডিতে পেমেন্ট করলে তা সিস্টেম থেকে লক হয়ে যায়। পেমেন্ট লক সমস্যা এড়াতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) মাধ্যমে পাসপোর্ট ফি পরিশোধ না করার নির্দেশনা দিচ্ছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। সরকারি ব্যাংক থেকে ফি জমা দিলে সমস্যাটি অনেকাংশে এড়ানো যায়। ব্যাংক থেকে ফি জমা দেওয়ার পর যদি এমন কোনো সমস্যা হয় তবে তা সমাধান করা যায়।
গ্রাহক ব্যাংক থেকে ফি পরিশোধের পর যদি জানতে পারেন তার পেমেন্ট লক হয়েছে তাহলে যে ব্যাংক থেকে ফি পরিশোধ করেছেন সেখানে গিয়ে বিষয়টি জানাবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডকুমেন্ট রিপ্রিন্ট করে কোন আইডিতে টাকাগুলো ব্যবহার হয়েছে তা যাচাই করে দেখবেন। ভুল যদি ব্যাংক থেকে হয় তাহলে সেখান থেকেই এর সমাধান করে দেওয়া সম্ভব। সার্ভার জটিলতার কারণেও অনেকসময় এমন সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও পাসপোর্ট অফিস থেকে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব।