চট্টগ্রামে আ জ ম নাছিরের কর্মীদের কার কী অবস্থান


একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে কর্মী ও সমর্থকভিত্তিক রাজনীতির সংস্কৃতি নতুন নয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে দুদফায় এম এ মান্নান ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে দায়িত্ব পালনের সময় এমন ভাগাভাগির কর্মী অর্থাৎ ‘আমি উনার, তিনি তাঁর’ এমন ধ্যান-ধারণা বা সংস্কৃতি খুব বেশি চোখে পড়ার মতো ছিল না।

এম এ মান্নানের কর্মী যা, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কর্মীও তা। তবে এম এ মান্নানের ভদ্র, সজ্জন, নির্ঝঞ্জাট চলাফেরার কারণে কর্মীরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর দিকেই কিছুটা বেশি ঝুঁকতেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, দুই নেতার কর্মীদের মাঝে নাওয়া-খাওয়া ছিল না, গ্রুপিং ছিল। সে এক অন্য গল্প।

কিন্তু আজকের গল্পটা অনেকটা ভিন্ন। আ জ ম নাছির উদ্দীন ও প্রয়াত চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর রেখে যাওয়া কর্মীরা তার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের হয়ে চট্টগ্রাম নগর রাজনীতিতে পৃথক পৃথক গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে যুক্ত, সক্রিয়।

আজকের প্রতিবেদনে মূলত চট্টগ্রাম মহানগরে বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ে আ জ ম নাছির উদ্দীনের কর্মী কারা, সেখানে কারাই সক্রিয়, কার অবস্থান কেমন তা-ই আলোচনার বিষয়বস্তু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, বর্তমানে আ জ ম নাছির উদ্দীনের লাখো কর্মী-সমর্থকদের মাঝে আলোচনায় আসার মতো সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা হাতেগোনা। তবে তারা নিজস্ব শক্তিমত্তা তৈরির চেয়ে প্রায় সবাই আ জ ম নাছিরের শক্তিতে বলীয়ান, তার অলংকারে আলংকরিক –এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।

বোদ্ধাজনের অভিমত, নিচের লেভেলে আ জ ম নাছিরের এমন অনেক কর্মী আছে, যারা হয়তো তেমন পাদপ্রদীপের আলোয় নেই, সেই তারাই ক্ষেত্রবিশেষে বিনাপ্রাপ্তিতে আ জ ম নাছিরের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।

যাই হোক, এ মুহূর্তে আ জ ম নাছিরের দৃশ্যমাণ কর্মী হিসেবে যাদের নাম আসে তারা হলেন– ২৮ নং পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের; চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, লালখানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম; ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দুবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব; ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের দুবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক; দিদারুল আলম দিদার, ওয়াহিদুল আলম শিমুল, ২১ নং জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, পলিটেকনিক্যালের সাবেক ছাত্রনেতা ইঞ্জিনিয়ার আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন প্রমুখ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক মাঠে তাদের মধ্যে আ জ ম নাছিরের সুসংগঠিত কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয় ২৮ নং পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের ও দিদারুল আলম মাসুমকে। ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও গেলোবার নির্বাচন চলাকালীন ষড়যন্ত্রমূলক হত্যামামলায় জেলে যেতে হয়েছিল আবদুল কাদেরকে। পক্ষান্তরে আবদুল কাদেরবিহীন নির্বাচনে সহজে কাউন্সিলর হয়ে যান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বাহাদুর।

স্থানীয়রা জানান, এরপরও এখনো পূর্ব মাদারবাড়ি বা মোগলটুলিতে আবদুল কাদেরের শক্ত অবস্থান বিরাজমান। ডাক দিলে মুহূর্তের মধ্যে হাজার লোক জড়ো করার সক্ষমতা রাখেন আবদুল কাদের। অর্থনৈতিক অবস্থানও তার খারাপ নয়। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছেন। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নান শেখ বহু আগে এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, দিদারুল আলম মাসুমকে একনজর তিনি দেখতে চান বা তার সাথে পরিচিত হতে চান। তাকে ‘বীর’ আখ্যা দিয়ে তার জন্য চট্টগ্রামের প্রগতিশীল শক্তির পক্ষ থেকে সংবর্ধনারও আয়োজন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন; প্রয়োজনে তিনিও আর্থিকভাবে সেই সংবর্ধনায় অংশীজন হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু দেখা, পরিচয়, সংবর্ধনা- কোনোটা না হলেও পরবর্তীতে অবসরে যাওয়া সরকারের এ বড় কর্মকর্তা এখনো দিদারুল আলম মাসুমকে ভোলেননি।

তাঁর অভিমত, চট্টগ্রামে হেফাজতের তাণ্ডব সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই থামিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেটি। তা না হলে চট্টগ্রামেও হেফাজতিরা ভয়ংকর ফনা তুলতে পারতো।

বলাবাহুল্য, সেই ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচিত দিদারুল আলম মাসুমকে তুলনামূলকভাবে এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় দেখা যায়। তার কর্মীরাই এখন কাউন্সিলর। আর তিনি লালখানবাজার ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক হয়ে কোনোমতে অস্তিত্ব ধরে থাকার চেষ্টা করছেন। একসময় তার ডাকে পঙ্গপালের মতো হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক মুহূর্তে হাজির হতো। তবে সেই শনৈ শনৈ অবস্থা ধরে রাখতে না পারলেও লালখানবাজারে এখনো তিনি ফেলনা নন, দাঁড়িয়ে আছেন শক্ত ভিতের উপর।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাকে আরও বড় কিংবা যোগ্যতম স্থানে কাজে লাগাতে পারলে তিনি আরও বেশি জ্বলে উঠতে পারতেন। হতে পারতেন দলের শক্তি, আ জ ম নাছিরের শক্তি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাসুম হয়তো কাউন্সিলর নন, নন বড় পদের মালিক। কিন্তু দলের জন্য জীবনবাজি রেখে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা পাওয়া বিষয়টি অন্তত গত ৩-৪ বছরে গুছিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। আ জ ম নাছির ও একটি গণমাধ্যমের কল্যাণে সভ্যসমাজে দিদারুল আলম মাসুমের পরিচয় এখন ‘আওয়ামী লীগ নেতা’। এটাও কম প্রাপ্তিযোগ নয় বলে মনে করেন অনেকে।

এবার আসা যাক ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের দুদুবারের কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব-গল্পে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আ জ ম নাছিরের বলয় থেকে কমার্স কলেজভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে উত্থান হাসান মুরাদ বিপ্লবের জীবনে ত্যাগের চেয়ে প্রাপ্তিই বেশি। ২০১৫ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আ জ নাছির উদ্দীন; সে যাত্রায় নাছিরের তরীতে উঠে কাউন্সিলর হয়ে যান তরুণতম প্রার্থী বিপ্লব। তার প্রতিদ্বন্দ্বী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জানে আলম দোভাষের ছেলে চার চারবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর জহিরুল আলম দোভাষ প্রকাশ ডলফিন দোভাষ।

জনশ্রুতি আছে, ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় প্রকাশ্য প্রচারণায় মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষকে মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির সাথে রাখলেও চূড়ান্তভাবে তিনি চেয়েছিলেন তার কর্মী হাসান মুরাদ বিপ্লবই জিতে আসুক। আ জ ম নাছিরের ইঙ্গিত ও কোটায় হেভিওয়েট প্রার্থী জহিরুল আলম দোভাষকে পরাজিত করে বিপ্লবই শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে যান।

কেবল তা নয়, গেলো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-বঞ্চিত হন বিপ্লব। দলীয় মনোনয়ন জোটে নওফেল অনুসারী চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ভাগ্যে। দলের মনোনয়ন, সালাউদ্দিনের প্রতি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, সেবা-সুশ্রুশার পরও আ জ ম নাছিরের ম্যাকানিজমে, ঘামঝরানো চেষ্টায় দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলর হয়ে আসেন হাসান মুরাদ বিপ্লব।

আ জ ম নাছিরের প্রতি আনুগত্য আছে বটে। কিন্তু দুবার কাউন্সিলর হওয়ার পর বিপ্লবের চালচলনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে খোদ তার সাথে সংশ্লিষ্ট লোজজনও বলাবলি করছেন।

জানা যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তিনি নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সুপ্রতিষ্ঠিত ভাবতে শুরু করেছেন আরও আগে থেকেই। এলাকার সালিশবিচার, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য এসব নিয়েই তার সময় চলে যায়। জনশ্রুতি আছে, তার ঘরের ড্রয়িংরুমটিও বেশ চোখধাঁধানো, পরিপাটি; বড় রাজনীতিবিদের ড্রয়িং রুমের ছোঁয়া যেন সেখানে।

এসবে ব্যস্ত সময় কাটাতে গিয়ে একসময় এমন সময় ছিল একদিন নেতার (নাছির) সাথে দেখা না হলে পেটের ভাত হজম হতো না বিপ্লবের। আর সেই ‘বড় হয়ে যাওয়া’ বিপ্লবকে এখন তাও নিজের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে নেতার সাথে দেখা করতে যেতে দেখা যায়। মোদ্দাকথা, এখন তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজের পরিসর আরও বিস্তৃত করছেন, গোছাচ্ছেন। আর এই গোছাতে গিয়ে তিনি তার নেতা আ জ ম নাছিরের জন্য কতটা শক্তি জোগাচ্ছেন, কর্মী-সমর্থকবান্ধব হচ্ছেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউককে বলা হয় আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেধাবী আবিষ্কার। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে উত্থান ডিউককে আ জ ম নাছির ভদ্র, সজ্জন হিসেবে পছন্দ করেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফলে দুদুবার (দ্বিতীয়বার দলীয় মনোনয়নে) কাউন্সিলর করে আনেন তাকে। গত ৭ বছর ধরে এই কাজেই তার সময় কেটে যাচ্ছে। এখনো বড় কোনো বদনামের জন্ম না দিলেও তার বিরুদ্ধে ভুক্রভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ-অনুযোগ নেই একথা বলা যাবে না।

জানা যায়, যেনতেনভাবে টাকা কামানোর মনোবৃত্তি না থাকা নাজমুল হক ডিউক ‘কাউন্সিলরগিরিটা’ অন্তত মনোযোগ দিয়ে করছেন। ওয়ার্ডের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। এলাকার কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান মিস করেন না তিনি। তবে এ নগরে বা এলাকায় তার তেমন কোনো কর্মী-সমর্থক নেই।

কিন্তু নেতা আ জ ম নাছিরের প্রতি ডিউক শতভাগ আনুগত্যশীল এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তিনি বলেন, নেতা ছাড়া আমার কীইবা যোগ্যতা। তিনিই আমাকে দুদুবার কাউন্সিলর বানিয়েছেন। মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন।

আ জ ম নাছিরের আরেক কর্মী স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য দিদারুল আলম দিদার। নাছিরের কর্মী হিসেবে একসময় সক্রিয় থাকলেও আ জ ম নাছিরের কল্যাণে পরবর্তীতে বৃহৎ ব্যবসাবাণিজ্য বা ঠিকাদারিতে জড়ানোর পর দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে তিনি নিষ্ক্রিয়, অনুপস্থিত। দেশের বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী, বিপুল অর্থ ও অস্ত্রসহ রাজধানী থেকে গ্রেফতার হওয়া জি কে শামীমের সাথে দিদারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েল এসোসিয়েটসের সম্পৃক্ততাও পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সেই দিদারই গত বছরের ৩০ মে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী হয়ে বসেন। অভিযোগ আছে, আ জ ম নাছির কোটায় তিনি সভাপতি হতে চাইলেও তার সাঁটানো কোনো ব্যানার-পোস্টারে আ জ ম নাছিরের ছবি ছিল না। এরপরও সভাপতি হিসেবে কেন্দ্রে দিদারের নাম পাঠানোয় আ জ ম নাছিরের প্রতি তার দলের অনুগতদেরই ভেতরে ভেতরে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়।

সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে দিদারুল আলম দিদারের ফাঁস হওয়া এক ফোনালাপে দেখা যায়, তিনি প্রয়াত মন্ত্রী এম এ মান্নানপুত্র যুবলীগ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি পদ প্রত্যাশী দিদারুল আলম দিদারকে তুলোধুনো করছেন; অসম্মান করে কথা বলতে কুণ্ঠা করেননি কিংবদন্তিতুল্য নেতা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নানকে নিয়েও।

এছাড়া নিজেদের গ্রুপের নেতাদের যেমন মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিনকে চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু বলতে একটুও দ্বিধা করেননি। তীব্র বিষোদগার করেন নওফেল গ্রুপের মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আরশেদুল আলম বাচ্চুকে নিয়ে। আর জয়গান গেয়েছেন নওফেল গ্রুপের সংগঠক, চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিমের। তুমুল প্রশংসা করেন নগরের যুব রাজনীতিতে অনেকটা একক প্রচেষ্টায় উঠে আসা দেবাশীষ পাল দেবুর।

জানা গেছে, দিদারের এমন আপত্তিকর, আনস্মার্ট, অরুচিকর মন্তব্যের ভাইরাল হওয়া ফোনালাপটি যুবলীগের শীর্ষপর্যায়েও পৌঁছে গেছে। ফলে তার পদপ্রাপ্তির বিষয়টি এখন অনেকটা নড়বড়ে। অবশ্য এই ঘটনার পর নেতা আ জ ম নাছির দিদারকে ডেকে শাসিয়েছেন এবং বকাবকি করেছেন বলে জানা গেছে। পক্ষান্তরে মান্নান-পুত্র দিদারের কাছে আ জ ম নাছির এই ঘটনায় দু:খ প্রকাশ করেছেন।

এরপরও অভিযোগ ও প্রশ্ন উঠেছে, আ জ ম নাছির এখনো সভাপতি পদে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কিত হয়ে ওঠা দিদারকেই চাইছেন। এতকিছুর পরও দিদারের প্রতি আ জ ম নাছিরের কেন এই দুর্বলতা বা ‘সফটকর্নার’ সেই প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে।

নির্ভরযোগ্য ও ঘনিষ্ঠ সূত্র মতে, কিছুদিন আগে প্রাইভেট কারের ব্যাকডালাভর্তি নানা জাতের দামি ও বড় বড় মাছ দিদারুল আলম দিদারের হয়ে ঢাকায় যুবলীগের এক বড় নেতার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। দিদার-অনুসারী যিনি নিয়ে গেছেন, তিনি ওই নেতার বাসায় কেবল জানাতে সক্ষম হয়েছেন এই উপহার আ জ ম নাছির গ্রুপের দিদারুল আলম দিদার পাঠিয়েছেন। সেটি শোনার পর ওই নেতার পিএস ও বাসার পিয়ন ডগস্কোয়াড স্টাইলে চেক করে বাসায় মাছগুলো ঢোকান বটে, কিন্তু যিনি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ব্যাপক পরিশ্রম করে মাছ ও ফলমূল নিয়ে গেছেন তাকে এক কাপ চা খাওয়ানো দূর অস্ত, একটিবার বসতেও বলেননি কেউ। দু:খ করে সেই কথাগুলো চট্টগ্রাম ফিরে সতীর্থদের কাছে চাউর করেন তিনি।

একসময় ওয়াহিদুল আলম শিমুলের সাংগঠনিক অবস্থা এই নগরে খুব ভালো ছিল। তার ভাই ব্ল্যাক মিন্টুরও ছিল দলের জন্য ব্যাপক অবদান। একসময় শিমুল শুলকবহর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচন করে অত কম ভোট পাননি। পরে রাজনীতিতে হঠাৎই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন, জড়িয়ে পড়েন নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে। পরবর্তীতে আ জ ম নাছিরের কল্যাণে স্টেডিয়ামে বরাদ্দ পাওয়া শৈবাল দাশ সুমন একটি দোকানে শিমুলকে পার্টনারশিপ রাখেন। যৌথভাবে তারা সেখানে গড়ে তুলেন ‘লিটল লব স্টার’, যা এখন খুব জমজমাট। এটা পরিচালনার পাশাপাশি রাজনীতিতে ফের সক্রিয় হতে চাইছেন শিমুল। ব্যক্তিজীবনে নতুন করে সঙ্গী পেয়ে গতিতে ফিরছেন। তবে আগের মতো তেমন কর্মী-সমর্থক না থাকলেও আ জ ম নাছিরের প্রতি ব্যাপক আনুগত্যশীল চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী এ যুব সংগঠক।

জানা যায়, শৈবাল দাশ সুমন রাজনৈতিক প্লাটফর্মে খুব বড় জায়গায় না থাকলেও ‘৯০ দশকের গোড়ার দিকে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন, ব্যস এটুকুই। পরবর্তীতে গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত হলেও আ জ ম নাছিরের সাথে যোগোযোগ রক্ষা করতেন। অবশ্য আ জ ম নাছিরের সাথে সেতুবন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম ছিল নাছিরের কনিষ্ঠভ্রাতা তাসাদ্দুকের (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) সাথে শৈবালের বড়ভাই সুজার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সেই সূত্র ধরে শৈবাল দাশ সুমন আ জ ম নাছিরের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন। নাছিরের সহযোগিতায় স্টেডিয়াম থেকে পর পর দুটি স্পেস নিয়ে নেন। সেখানে গড়ে তুলেন আধুনিক মানের চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। বর্তমানে একটি স্পেস প্রিলানথো নামক নতুন একটি রেস্টুরেন্টকে ভাড়া দিলেও ‘লিটল লব স্টার’ পরিচালনা করছেন যৌথভাবে।

এদিকে, ২০১৫ সালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে টপকিয়ে মনোনয়ন ছিনিয়ে এনে মেয়র হন আ জ ম নাছির উদ্দীন। সেই যাত্রায় আ জ ম নাছিরের দলে ও কোটায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে হেভিওয়েট দুই প্রার্থীকে পরাজিত করে প্রথমবার কাউন্সিলর হন শৈবাল দাশ সুমন। দ্বিতীয়বার সকলকে চমকে দিয়ে সনাতন কোটায় আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে ফের কাউন্সিলর হন তিনি।

ফেসবুকবাতিকে আসক্ত শৈবাল দাশ সুমন ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়া যায় সুকৌশলে এমন কিছু লাইভ ও কন্টেন্টের অবতারণা করে ফেসবুক সেলিব্রেটি হয়ে উঠেন। ফেসবুক সেলিব্রেটি হয়ে উঠলেও বস্তুত তার কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। জামালখানভিত্তিক বরেণ্য ব্যক্তিদের কিছু ক্রিয়েটিভ ছবির কাজ ও ফেসবুকের ৪ লাখেরও কিছু বেশি ফলোয়ার নিয়ে মূলত শৈবাল দাশ সুমনের জগত।

দ্বিতীয়বার মনোনয়ন পাবার পর এক গণমাধ্যম অফিসে বসে সুমন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার জীবনের চাওয়া ছিল বড়জোর মাসে এক লক্ষ টাকা আয় থাকবে, ছোটখাট একটা গাড়ি মেইনটেইন করবো, স্বচ্ছল, সুখী জীবন কাটাবো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আজ আমাকে ঢেলে দিয়েছেন। যশ, খ্যাতি, অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামাজিক মর্যাদা কী নেই আমার। তবে এসবের জন্য আ জ ম নাছিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করেন তিনি।

আ জ ম নাছিরের আরেক একনিষ্ঠ কর্মী মো. হেলাল উদ্দিনও ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি নগর সংগঠনে মোটামুটি সক্রিয়। নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদটি পেতে পেতেও তার আর পাওয়া হলো না। সংগঠনের দুই শীর্ষ পদ নওফেল অনুসারীদের দিয়ে শেষ পর্যন্ত হেলালকে সিনিয়র সহ সভাপতি করা হয়। ফলে সভাপতি-বঞ্চিত হেলাল যেভাবে চট্টগ্রাম মহানগরে সাংগঠনিক শক্তি-ভিত্তি তৈরি করে নগরজুড়ে দল ও আ জ ম নাছিরের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে একটা ছক ও পরিকল্পনা করেছিলেন সেটির আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

অভিযোগ আছে, দলের কর্মসূচিগুলোতে সিনিয়র সহ সভাপতিকেই ডাকা হয় না। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নিজেদের খেয়াল খুশীমতো সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। যে কোনো শীর্ষ পদ মানুষকে নতুন মাত্রা দেয়, শক্তি এনে দেয়। কিন্তু শীর্ষ পদ থেকে ছিটকে পড়ার পর যেই হেলালের জ্বলে উঠার কথা ছিল, সেই তিনিই এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে টুকটাক সাংগঠনিক, সামাজিক কর্মসূচি ও ব্যবসা বাণিজ্যে সময় কাটাচ্ছেন।

হেলাল নিজেই একসময় এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, কমিটি ঘোষণার দুদিন আগে যখন নতুন মেরুকরণ দেখতে পান, তখন আ জ ম নাছিরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। আ জ ম নাছির তাকে সাফ জবাব দিয়েছিলেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে এলে আসবে, কিন্তু অনৈতিকতার পথে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আ জ ম নাছিরের একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত দুই কর্মী ইঞ্জিনিয়ার আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও সাইফুল আলম লিমন। প্রথমজনের উত্থান পলিটেকনিক্যাল কলেজভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। অপরজনের উত্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতিতে। দুইজনই ভালো ও সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা।

মেধাবী ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত লিমন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। আ জ ম নাছিরের সাথে রাজনীতি করতে গিয়ে বারে বারে দলের অভ্যন্তরে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তারা দুজনেই। গ্রেফতার ও কারাভোগ করেছেন একাধিকবার। এমনকি নানা বিভ্রান্তি ও গল্প ছড়িয়ে গায়ে সন্ত্রাসী, ক্যাডার ট্যাগ লাগিয়ে তাদের সামনে ক্রসফায়ারের খড়গও ঝোলাতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। অবশ্য সেদিন এখন আর নেই। মহিউদ্দিন-লিমন দুজনই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, ছাত্ররাজনীতিকালে তারা যাই করেছেন, দলের স্বার্থ ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নিরাপোষী এই দুই কর্মী বর্তমানে দৃশ্যমাণ কোনো পদে না থেকেও বিপুল, বিশাল কর্মীসমর্থক লালন করেন। এর মধ্যে দুজনেই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগে গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রত্যাশী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্মার্ট, ভদ্র, বিনয়ী, পাবলিক ডিলিংসে সক্ষম এই দুজনকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগালে দল নি:সন্দেহ শক্তিশালী হবে।