সাতকানিয়ার রাজনীতিতে ‘গায়েবি পীর’


একুশে প্রতিবেদক : একজন শিক্ষক থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, তারপর বনে গেছেন রাজনৈতিক নেতা। প্রথমে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরবর্তীতে নৌকা প্রতীকে হয়ে গেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। এ যেন রাতারাতি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের সন্ধান। হ্যাঁ, তাই। আলাদীনের এই আশ্চর্য প্রদীপ যিনি পেয়েছেন, তার নাম এম এ মোতালেব।

নব্বইয়ের দশকে তাকে ‘মোতালেব বিএসসি’ নামে সবাই চিনলেও এখন তিনি ‘মোতালেব সিআইপি’। তার মালিকানাধীন বনফুল ও কিষোয়ান (মিষ্টি ও বেকারি পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানগুলো) গ্রুপের মাধ্যমেই ব্যবসায়ীদের দেওয়া রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ খেতাবটি নিজের দখলে নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান। কারণ ২০১৯ সালে জামায়াতবিহীন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

তবে রাজনীতিতে মোতালেবের উত্থান শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে সর্বপ্রথম সাতকানিয়া সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচন করেন তিনি। তবে এসময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাস্টার ফারুক আহমদের কাছে হেরে যান।

যদিও মোতালেব বলে আসছেন, কলেজে পড়াকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, মাঠের রাজনীতিতে তেমন একটা দেখা যায়নি মোতালেবকে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তাকে সহ-সভাপতি করা হয়। জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন সময়ে দলের খরচ জোগানোর জন্য ব্যবসায়ী হিসেবে মোতালেবের নাম প্রস্তাব করেন কয়েকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ফলে তাকে সহ-সভাপতি করা হয়। কিন্তু তাকে তেমন কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি দলের জন্য।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে নিজে নির্বাচন পরিচালনা করে তারই ছোটভাই জামায়াত নেতা মাহমুদুল হককে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন।

এরপর ২০১৪ সালের শুরুতে তৎকালীন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু সাঈদকে পদোন্নতি দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করা হয়, তখন মোতালেবকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। অভিযোগ আছে, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ও মফিজুর রহমানকে ‘খুশি’ করার মাধ্যমেই এই পদ ভাগিয়ে নেন মোতালেব। এভাবেই রাজনীতিতে মোতালেবের উত্থান। উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদের উপর ভর করে ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়নও চান তিনি।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য মতে, ২০১১ সালের দিকে তৎকালীন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে মোতালেব কথা দেন তার ছোট ভাইকে জামায়াত বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিয়ে আসবেন। বিনিময়ে তাকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করার জন্য দলীয়ভাবে মনোনীত করতে হবে। কথা রাখেন বাবু। মোতালেবকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে সহযোগিতা করেন। কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার বেলায় হারিয়ে যান মোতালেব!

দলের সম্মান রক্ষার্থে তৎকালীন সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নুরুল আবছার চৌধুরী। কিন্তু ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়া সেই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে জয় এনে দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের কেন্দ্রেও বিজয়ী করতে পারেননি মোতালেব। উল্টো প্রচারণা চালাতে গিয়ে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের শিকার হন নুরুল আবছার। পক্ষান্তরে কারাবন্দি থেকেও বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বসেন জামায়াতের জসিম উদ্দীন।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একজন আওয়ামী লীগ নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘জামায়াত নেতা ভাইয়ের কথার বাইরে যেতে পারেন না এম এ মোতালেব। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত নেতা ভাইয়ের ছেলে তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন। যদিও কেন্দ্রটি নিজের এলাকার হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তারপরেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয় এনে দেবেন, দূরের কথা নিজের কেন্দ্রের অবস্থাই ছিল শোচনীয়।’

‘দলের জন্য তেমন কিছু না করার পরও ২০১৪ সালের শেষের দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাকে সভাপতি করা হয়। অভিযোগ উঠে, পুনরায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানকে ‘খুশি’ করার মাধ্যমে সভাপতির পদ ভাগিয়ে নেন ব্যবসায়ী মোতালেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে জামায়াতবিহীন উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান হন মোতালেব। অর্থ্যাৎ যদি জামায়াত-বিএনপি যদি নির্বাচন করে তাহলে মোতালেব নির্বাচন করবেন না। তার মানে হচ্ছে তিনি তৈরি মাঠে, প্রতিপক্ষ ছাড়া খেলতে প্রস্তুত। তিনি একজনকে ফোনে বলছেন, জামায়াত-বিএনপি শক্তিশালী। তারা নির্বাচন করলে তিনি করবেন না। সেই ফোনালাপ শুনে মনে হলো সুসময়ে সুবিধা নেবেন, দুঃসময়ে সরে যাবেন, এমনই অভিব্যক্তি মোতালেবের।’

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে মোতালেবের ডিগবাজিও কম নয়। আমিনুল ইসলাম আমিন কেন্দ্রীয় নেতা থাকাকালীন মোতালেবের রাজনীতি ছিল আমিনকেন্দ্রিক। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হলে মোতালেব ছুটে যান তার কাছে। কারণ এই আসন থেকে মোতালেব-আমিন উভয়েই সংসদ সদস্য হতে চান। যেহেতু বিপ্লবের নির্বাচন করার সুযোগ কম এবং বিপ্লব-আমিনের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেহেতু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চান মোতালেব। যদিও সাতকানিয়ায় জন্মসূত্রে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত আরও যোগ্য একাধিক নেতা থাকতে ব্যবসায়ী মোতালেবকেই কেন মনোনয়ন দেওয়া হবে, সেই প্রশ্ন এখন জনমনে।

সম্প্রতি সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার রাজনীতিতে এমপি নদভী ও বিপ্লব বড়ুয়ার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। গত ১০ মার্চ মোতালেব কলেজে নতুন ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয়নি এমপি নদভীকে। এমনকি একই ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়ার পরও দাওয়াত পাননি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তীব্র সমালোচনা ও অভিযোগের তীর ছোড়াছুড়ি। একদিকে মোতালেব-বিপ্লব ও অপরদিকে এমপি নদভী। তবে নীরব আছেন আমিন।

চলমান বিতর্কের রেশ ধরে শনিবার (১১ মার্চ) লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এসআই চৌধুরীর স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিপ্লব বড়ুয়ার প্রসঙ্গ তুলে সাংসদ আবু রেজা নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, ‘আপনি আমাকে বলেছেন আমার ভাইকে চেয়ারম্যান দিতে হবে। চেয়ারম্যান বানাই দিছি— বড়হাতিয়া। আপনি আমাকে বলছেন সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানাতে হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বানাই দিছি। তবে আমি ওনাকে শর্ত দিয়েছি, ঠিকাছে, আপনি মোতালেব সাহেবকে বলেন জামাত ছাড়তে। মোতালেবের সাহেবের ছোট ভাই মাহমুদুল হক জামাতের বড় হাড্ডি। মাহমুদুল হক কালকে মোতালেব কলেজের ওই প্রোগ্রামে মন্ত্রী মহোদয়কে বিপ্লব বড়ুয়াকে ওনাদেরকে রিসিভ করেছে।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিপ্লব বড়ুয়া বিভিন্ন মাধ্যমে এমপি নদভীর সঙ্গে বিরোধ আর বাড়াতে চান না। প্রয়োজনে যে কোনো উপায়ে সেটা কমাতে চান। এ নিয়ে গত পরশু ও গতকাল রাতেও নদভীর কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে এখনও নদভীর পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। মূলত বিপ্লব বড়ুয়ার সেই সমঝোতার চেষ্টা হিসেবেই ডাকা সংবাদ সম্মেলন উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হুট করেই বাদ দেন, আর কারণ হিসেবে পেট খারাপের কথা চাউর করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করছে।

এদিকে মোতালেব এখনো ছাড়তে পারেননি জামায়াত সম্পৃক্ততা। তার ভাই জামায়াত নেতা মাহমুদুল হকই এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যার প্রমাণ মিলে সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক সমিতি তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির নির্বাচনের মাধ্যমে। মোতালেব এই সমিতির প্রধান উপদেষ্টা হলেও নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ ছিল ভাই মাহমুদুল হকের হাতে। ফলে সেখানেও সভাপতি নির্বাচিত হয় জামায়াতের প্রার্থী ও ১৩টি নাশকতার মামলার আসামি সরওয়ার কামাল। তার পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন মোতালেবের ভাই মাহমুদুল হক।

এছাড়াও মোতালেব কলেজের ভবন উদ্বোধনের দিন সামনের সারিতে থেকে শিক্ষা উপমন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতাকর্মীদেরকে রিসিভ করতে দেখা যায় মোতালেবের জামায়াত নেতা ভাই মাহমুদুল হককে। শুধু তাই নয়, ২০১৩ সালের মার্চে সাঈদীর রায়ের পর সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের পর মোতালেবের ভাই মাহমুদুল হকের ছেলে ফরহাদ অস্ত্রসহ চকবাজার থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় নাশকতার অভিযোগে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার সকালে এম এ মোতালেবের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়; তখন তার ব্যক্তিগত সহকারী আবু তৈয়ব কল রিসিভ করে বলেন, ‘স্যার ব্যস্ত আছেন। কথা বলতে পারবেন না।’ পরে এম এ মোতালেবের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্নগুলো পাঠিয়ে মন্তব্য চাওয়া হয়; কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে মোতালেবের মুঠোফোন নাম্বারে একাধিকবার কল করেও সাড়া মিলেনি। আজ সন্ধ্যায় ব্যক্তিগত সহকারী আবু তৈয়বকে কল করা হলে, তিনি মোতালেবের কাছ থেকে দূরে আছেন বলে জানান।

মোতালেবকে নিয়ে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওনাকে (মোতালেব) টাকা দিয়ে নেতা কে বানিয়েছেন? আমার জানা মতে ওনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত। আক্তারুজ্জামান বাবু ভাইয়ের সময়ে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে নেত্রী মনোনয়ন দিয়েছেন। তার ভাই জামায়াত করে, ভাতিজা অস্ত্রসহ চকবাজারে পুলিশের হাতে আটক হওয়া, তামাকুমন্ডি লেইন ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানো, এসব তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। সংবাদ সম্মেলন তারা (মোতালেব) ডেকেছেন, স্থগিতও করেছেন তারা। এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য নাই।’