চট্টগ্রাম: টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা; বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের জনজীবন। অনেক জায়গায় নৌকা নিয়েও চলাচল করতে দেখা গেছে। নগরের অর্ধেক এলাকা তলিয়ে গেছে কয়েকফুট পানির নিচে। শহরের ভেতরে যান চলাচল কার্যত বন্ধ। খাতুনগঞ্জ তলিয়ে যাওয়ায় শত শত কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনের পুরো এক তলা পানির নিচে চলে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। নগরীর বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী নির্ধারিত দিনে পরীক্ষা দিতে পারেনি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেশিরভাগই কাজে যেতে পারেননি। শহরের বিশাল এলাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীন হয়ে পড়েছে। অনেকের দিনভর কেটেছে উপোষ। চট্টগ্রামের সাথে বান্দরবানের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙ্গরে পণ্য খালাস হচ্ছে না। পণ্য নিয়ে শহর থেকে খুব কম সংখ্যক গাড়ি ছেড়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামের বাশঁখালির পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় এক মিনিট স্থায়ী টর্নেডো হানা দেয়। নিমিষেই এখানকার শতাধিক দোকান-পাট বিধ্বস্ত হয়। এ ধরনের বিপর্যয় এলাকাবাসী আর কখনও দেখেনি। বহুদুর পর্যন্ত দোকানের চাল উড়ে যায়।
চট্টগ্রামে এখন যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত তিনদিনে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে এমনিতে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় কাহিল অবস্থা। তার উপর এ পরিমান বৃষ্টিতে নেমে এসেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। চট্টগ্রাম শহরের কিছু উচু এলাকা ছাড়া বেশিরভাগ এলাকা এখন পানির নিচে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ দেখা দিয়েছে নগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকায়। এসব এলাকা জনবহুল। এতদিন বৃষ্টি যা হোক এসব এলাকার মানুষ সামলে নিয়েছিল। কিন্ত এবারই প্রথম মানুষ উপলদ্ধি করলো জোয়ারের পানি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি আর জোয়ারের পানির পরিমান ৬ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। এসব এলাকায় যে সব পরিবার একতলায় রয়েছে বা কাচাঁ ঘরে রয়েছে তাদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অনেকে বহুতলা ভবনের বিভিন্ন বাসিন্দাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ চলে গেছেন আত্মীয়স্বজনদের কাছে।
চলমান এ দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইতে। প্রতিদিন এখান থেকে হাজারো ট্রাক পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। সোমবার ছিল ব্যাতিক্রম। এখানকার মানুষ জোয়ারের পানি আর বৃষ্টির সাথে লড়াই করে দিন পার করে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নেতা সৈয়দ সগীর আহমেদ জানান, খাতুনগঞ্জের চালের আড়তে পানি ঢুকে টন টন চাল নষ্ট হয়েছে। চাক্তাই এলাকার বেশিরভাগ গুদামে পানি ঢুকে একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ৩০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হবে।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় রয়েছে বেসরকারী মা ও শিশু হাসপাতাল। এ হাসপাতালটি বিশাল এলাকার জনগোষ্টিকে সেবা দিয়ে আসছে। বর্তমানে এ হাসপাত লের নিচের তলায় কয়েকফুট পানি। ফলে রোগীদের কষ্ট চরম আকার ধারন করেছে। রোগী আনা যাচ্ছে না যানবাহনের অভাবে। কোমর পানির নিচে এলাকা তলিয়ে যাওয়ার ফলে ডাক্তার ও ছাত্র-ছাত্রীদের হাসপাতালে ঢুকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আগ্রাবাদে রয়েছে বেশিরবাগ কর অফিস। এ অফিসগুলো এখন পানির নিচে। অফিসে যাতায়াতের জন্য নৌকা কিনতে হয়েছে কর কর্মকতাদের। কর অঞ্চলের এলাকাটি বেশিরভাগ সময় পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারনে অফিসে যেতে কষ্ট হচ্ছে কর্মকর্তাদের। যেহেতু অফিস করতে হবে, কোন যানবাহন পানি ডিঙ্গিয়ে না যাওয়ার কারনে এবার ২৫ হাজার দিয়ে একটি বোট কিনেছেন কর কর্মকর্তারা। আর এটা দিয়ে আসা যাওয়া করছেন অনেকে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ভাটা পড়েছে। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারনে বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে বাইরে যেতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অস্বাভাবিক পানির কারনে যানবাহনের ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুন। বন্ধ রয়েছে বহিনোঙ্গরে পণ্য উঠানামা। সাগর উত্তাল হওয়ার কারনে সাগওে দাঁড়িয়ে থাকা বড় জাহাজগুলোর ধারে কাছে ভিড়তে পারেনি কার্গো জাহাজ। সাগর উত্তাল হওয়ার কারনে কেউ ঝুকি নিয়ে পণ্য খালাস করতে যায় নি। ফলে ঠাঁই দাড়িয়ে আছে জাহাজগুলো।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সুত্র জানায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে বিমান চলাচলের সিডিউল এলোমেলো হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বিমান সময় মতো ছাড়তে পারেনি। বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে অনেকে সিডিউল বাতিল করেছে।
নগরীর বেশিরভাগ স্কুল কলেজ ছিল কার্যত বন্ধ। অনেক স্কুলের ভেতওে পানিস ঢুকে যাওয়ার কারনে আগেভাগেই ছাত্র ছাত্রীদের এসএমএসের মাধ্যমে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা শেখ হারুনর রশিদ বলেন, মৌসুমী বায়ুর তারতম্যের আধিক্যের কারণে সাগরে বাতাসের তীব্রতা বেশি। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত অব্যাহত আছে। বেলা ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার।
এদিকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাহাড়ে যেসব মানুষ এখনো রয়ে গেছে তাদের এলাকা ছেড়ে নিরাপদে চলে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কাটা পাহাড়গুলোতে বড় ধরনের ধস নামতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছে প্রশাসন।