:: তসলিমা নাসরিন ::
‘…ঈদের সকালে কলপাড়ে এক এক করে বাড়ির সবাই লাল কসকো সাবান মেখে ঠান্ডা জলে গোসল সারেন। আমাকে নতুন জামা জুতো পরিয়ে দেওয়া হয়। লাল ফিতেয় চুল বেঁধে দেওয়া হয়, গায়ে আতর মেখে কানে আতরের তুলো গুঁজে দেওয়া হয়। বাড়ির ছেলেরা শাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরে নেন। তাঁদের কানেও আতরের তুলো। সারা বাড়ি সুগন্ধে ছেয়ে যায়। বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে আমিও রওনা দিই ঈদের মাঠে। সে কি বিশাল মাঠ! বড় বড় বিছানার চাদর ঘাসে বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ান বাবা। দাদা ছোটদা, আর সব মামারা, বড় মামা ছাড়া। মাঠে মানুষ গিজ গিজ করছে।
নামাজ শুরু হলে যখন সবাই উবু হন, দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখি সেই দৃশ্য। অনেকটা আমাদের ইস্কুলের অ্যাসেম্বলিতে পিটি করার মত। উবু হয়ে পায়ের আঙুল ছুঁই যখন, এরকম লাগে হয়ত দেখতে। নামাজ সেরে বাবারা চেনা মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। কোলাকুলি করার নিয়ম কেবল ছেলেদের। বাড়ি ফিরে মা’কে বলেছিলাম চল ঈদেও কোলাকুলি করি। মা মাথা নেড়ে বলেছেন মেয়েদের করতে হয় না। ক্যান করতে হয় না? প্রশ্ন করলে বলেছেন নিয়ম নাই। কেন নিয়ম নেই? প্রশ্নটি চুলবুল করে মনে। মাঠে গরু কোরবানি দেওয়ার আয়োজন শুরু হয়। তিন দিন আগের কেনা কালো ষাঁড়টি বাঁধা কড়ইগাছে, কালো চোখ দুটো থেকে জল গড়াচ্ছে। দেখে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে আমার। কী জীবন্ত একটি প্রাণী জাবর কাটছে লেজ নাড়ছে। আর কিছুক্ষণ পরই হয়ে উঠবে বালতি বালতি মাংসের টুকরো।
কড়ই গাছের গোড়ায় বসে ছুরি ধারান মসজিদের ইমাম। হাশেম মামা বাঁশ যোগাড় করে আনেন। বাবা পাটি বিছিয়ে দেন উঠোনে, বসে মাংস কাটা হবে। ছুরি ধারিয়ে মাঠ থেকে হাঁক দিলেন ইমাম। এক হাঁকেই হাশেম মামা, বাবা আর পাড়ার কিছু লোক ষাঁড়কে দড়িতে বেঁধে বাঁশে আটকে পায়ে হোঁচট খাইয়ে মাটিতে ফেললেন। ষাঁড় হাম্বা ডেকে কাঁদছিল। মা আর খালারা জানালায় দাঁড়িয়েছেন কোরবানি দেখতে। আনন্দ নাচছে সবার চোখে। লুঙ্গি পরা, গায়ে আতর না মাখা বড় মামা মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে বললেন- এইভাবে নৃশংসভাবে একটা বোবা জীবরে মাইরা ফালতাছে, আর মানুষ কি না এইসব দেইখা মজা পায়, দয়া মায়া বলতে কারও কিছু নাই আসলে।
কোরবানির বিভৎসতা থেকে সরে যান বড় মামা। আমি দাঁড়িয়েই থাকি। হাত পা ছুঁড়ে ষাঁড় কাঁদে। সাত সাতটি তাগড়া লোককে ফেলে ষাঁড় উঠে দাঁড়ায়, আবারও তাকে পায়ে হোঁচট খাইয়ে ফেলা হয়। ফেলেই ইমাম তাঁর ধারালো ছুরিটি আল্লাহু আকবর বলে বসিয়ে দেন ষাঁড়ের গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। আধখানা গলা কাটা পড়লেও ষাঁড় হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে। বুকের ভেতর আমার চিনচিন করে একরকম ব্যথা হতে থাকে। এটুকু দায়িত্বই আমার ছিল, দাঁড়িয়ে কোরবানি দেখা। মা তাই বলেছিলেন, বলেন প্রতি কোরবানির ঈদের সকালে। ইমাম যখন চামড়া ছাড়াচ্ছিলেন, তখনও ষাঁড়ের চোখভরা জল। শরাফ মামা আর ফেলু মামা দৃশ্যটির পাশ থেকে মোটে সরতে চান না। আমি চলে যাই মনুমিয়ার দোকানে বাঁশিবেলুন কিনতে। গরুর মাংসের সাতটি ভাগ হয়। তিন ভাগ নানিদের, তিন ভাগ আমাদের, এক ভাগ বিলোনো হয় ভিখিরি আর পাড়া পড়শিদের। ঈদের দিনের মজা এই, বাবা সারাদিনই মোলায়েম স্বরে কথা বলেন, পড়তে বসতে বলেন না, মারধোর করেন না।
সারাদিন সেমাই জর্দা খেয়ে, পোলাও কোরমা খেয়ে হৈ হৈ করে বেড়ানো হয়। সাত খুন মাফ সেদিন। সারাদিন মাংস কাটা চলে। বড় বড় চুলোয় বড় বড় পাতিলে গরুর মাংস রান্না হতে থাকে। বিকেলে রান্নাবান্না সেরে গোসল সেরে মা আর নানি ঈদের শাড়ি পরেন। রুনু খালা আর ঝুনু খালা সেজেগুজে ফাঁক খোঁজেন বান্ধবীদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার। বাড়িতে অতিথি আসতে থাকে। বড় মামা লুঙ্গি আর পুরোনো এক শার্ট পরে পাড়া ঘুরে এসে বলেন, সারা পাড়া রক্তে ভাইসা গেছে। কতগুলা যে গরু মারা হইল, হিসাব নাই। এই গরুগুলা কৃষকদেরে দিয়া দিলে ত চাষবাস কইরা চলতে পারত। কত কৃষকের গরু নাই। মানুষ এত রাক্ষস কেন, বুঝলাম না। পুরা গরু মাইরা এক পরিবার খাইব গোসত। এইদিকে কত মানুষ ভাতই পায় না।
বড় মামাকে গোসল করে ঈদের জামা কাপড় পরতে তাগাদা দিয়ে লাভ নেই। হাল ছেড়ে নানি বলেন- ঈদ ত করলি না। এল্লা খাইবিও না? খাইয়া ল।
Ñ না খাওয়ার কী আছে, খাওন দেন। গরুর গোসত ছাড়া অন্য কিছু থাকলে দেন।
বড় মামা লম্বা শ্বাস ফেলে বলেন।
চোখে জল জমছিল নানির। বড়মামা কোরবানির ঈদে গরুর মাংস খাবেন না, এ তিনি কী করে সইবেন! নানি আঁচলে চোখ মোছেন এই পণ করে যে তিনিও মাংস ছোঁবেন না। ছেলের মুখে না দিয়ে মায়েরা আবার খায় কী করে কিছু!
বড় মামার মাংস না খাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ল বাড়িতে। শুরু হল বড়দের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি। মা আমাদের পাতে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেন-মিয়াবাই ঈদের গোসত না খাইয়া ঢাকায় ফিইরা যাইব। গরু জবো করা নাকি তার সহ্য হয় নাই। গরুর গোসত যে বাজার থেইকা কিইনা খাওয়া হয়, সেই গোসত কি গরু না মাইরা হয়…!’
তসলিমা নাসরিনের মেয়েবেলা থেকে