সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

পারকি সৈকতে সমস্যা অনেক, সমাধান নেই

প্রকাশিতঃ ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ | ৪:৫৩ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাতজিন্নাত আয়ুব, পারকি (আনোয়ারা) থেকে ফিরে : ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারার পারকি সৈকতে বেড়াতে এসেছেন আরিফ আহমেদ। পরিচিতদের মুখে শুনেছিলেন এখানকার সৌন্দর্যের কথা। কিন্তু লোকমুখে শোনা কথার সঙ্গে সৈকতের মিল খুঁজে পেলেন না। কারণ সৈকতজুড়ে পড়ে আছে প্লাস্টিক-বর্জ্য। অন্যদিকে অসংখ্য কাটা গাছের গোড়া।

সরেজমিনে দেখা যায়, সৈকতের পুরো এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্লাস্টিক-বর্জ্য। সৈকতের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ডাবের ছোবড়া, খড়ের স্তূপ, চিপসের খালি প্যাকেটসহ নানা ধরনের আবর্জনা জমে আছে। সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ময়লা–আবর্জনা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিয়েছে। আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত পারকি সৈকত পরিষ্কার রাখার ব্যাপারটি সংশ্লিষ্টদের নজরেই নেই।

শুধু তাই নয়, আছে বখাটেদের উৎপাত। স্থানীয় বখাটে তরুণেরা মোটরসাইকেল নিয়ে সৈকতে দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করে। এতে পর্যটকেরা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারেন না। এছাড়া প্রকাশ্যে জুয়ার আসর, মাদক বেচা-কেনা, অবৈধ দোকান বাণিজ্যও চলছে সৈকতজুড়ে। যথাযথ তদারকি ও অব্যবস্থাপনার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সম্ভাবনাময় পারকি সমুদ্র সৈকত। অভিযোগ, পারকি সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও কার্যত কোনো ভূমিকাই পালন করতে দেখা যায় না দায়িত্বরতদের।

জানা যায়, পারকি সমুদ্র সৈকত রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিততে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্য সচিব এবং বারশত ও রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যানকে সদস্য করে সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটিও করা হয়েছে। যদিও রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সৈকতে চলছে অনিয়ম। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি অনেকটা দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। শনিবার সরেজমিন পরিদর্শনে পারকি সৈকতের অসংখ্য অনিয়ম প্রতিবেদকের চোখেও পড়ে।

গত শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, সৈকতে প্রকাশ্যে বসানো হয়েছে জুয়ার আসর। এছাড়া সৈকতে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংঘবদ্ধ চক্র প্রকাশ্যে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার প্রেক্ষিতে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

এদিকে পারকি সৈকতে অপরিচ্ছন্নতায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পর্যটকদের। সৈকতের পদে পদে ময়লা-আবর্জনা। যা দেখে সৈকতকে যে কেউ মনে করতেই পারেন ময়লার ভাগাড়। সময় কাটাতে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে সৈকতের এমন অবস্থায় অনেককেই ফিরে যেতে দেখা যায়। ভ্রাম্যমাণ ভ্যান গাড়িতে ডাব, চিপস, চা-কফিসহ নানা জিনিস বিক্রি করতে আসা বিক্রেতাদের সকল ময়লা আবর্জনা সৈকতেই ফেলতে দেখা যায়।

বেশ কয়েকজন বিক্রেতার সাথে কথা হলে তারা বলেন, প্রশাসনের মৌখিক অনুমতিতেই তারা সৈকতে এসব বিক্রি করছেন। সৈকতে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার বিষয়ে তাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলেও দাবি তাদের।

সৈকতে পর্যটকদের ভোগাচ্ছে বেপরোয়া ফটোগ্রাফার চক্র : পর্যটকদের ভোগান্তি এড়াতে পতেঙ্গা ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফটোগ্রাফারদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা (আলাদা পোশাক, ইউনিক আইডি কার্ড ও ছবির তোলার মূল্য নির্ধারণ) দেওয়া থাকলেও পারকি সৈকতে এমন কোনো নিয়মকানুনই নেই। ছবি তোলার পর পর্যটকদের কাছ থেকে ছবি প্রতি ১০ টাকা দাবি করে বসে পারকির ফটোগ্রাফাররা। পছন্দের ছবি বাছাইয়েরও সুযোগ নেই এখানেই। যত ছবি তোলা হয়েছে তার সবই নিতে হবে এমনটাই দাবি করেন তারা।

ঝাউবন উজাড়: পারকি সৈকতের মূল সৌন্দর্য ঝাউবন। কিন্তু গত কয়েক বছরে হাজারো ঝাউগাছ কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। কিছু গাছ উপড়ে পড়েছে। সৈকতের আশপাশ থেকে বালু তোলা ও ঢেউয়ের কারণে ঝাউগাছের গোড়ার বালু সরে গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

নেই পর্যটক ও মালামালের নিরাপত্তা : সমুদ্রে নামার সময় পর্যটকদের জিনিসপত্র-মালামাল রক্ষায় পতেঙ্গা ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লকারের সুবিধা থাকলেও পারকি সৈকতে বালিয়াড়ির উপরের নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র রাখতে হয়। যার ফলে প্রায় সময় অলংকার, মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিস খোয়া যায় এই সৈকতে। বেশিরভাগ সময় চোর চক্র এসব জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পর্যটকদের নিরাপত্তায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তেমন তদারকি নেই পারকি সৈকতে; যার কারণে পর্যটকদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি।

খাবার হোটেলের অভাব: পারকি সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকায় বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান থাকলেও মানসম্মত রেস্তোরাঁ নেই। সৈকতের রেস্তোরাঁগুলো নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি অতিরিক্ত দাম রাখে বলে অভিযোগ আছে।

সৈকত থেকে বালু উত্তোলন : পারকি সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় বারশত ইউনিয়নের একটি প্রভাবশালী চক্র। নেই প্রশাসনের নজরদারি। সৈকতের বুকের বড় পাইপ দিয়ে সে বালুয় চলছে জমি ভরাটের কাজ। এতে যেমন সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সৈকতও ঝুঁকির মুখেও পড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে আনোয়ারা পারকি সৈকতকে ‘পর্যটন এলাকা’ ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সাবেক বর্ষীয়ান নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল এই সৈকতকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা। রাশেদ খান মেনন পর্যটনমন্ত্রী থাকাকালে পারকি সৈকত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে এ এলাকার ৬২৯ দশমিক ৬৬ একর জমি পর্যটন করপোরেশনের নামে গেজেটভুক্ত হয়।

এলাকার একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, সৈকতের বালু উত্তোলনের পর এখন সরকারি খাস জমি থেকে প্রকাশ্যে মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। এলাকার প্রভাবশালীরা এ কাজ করছেন। প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না বলে তারা জানান।

এ দিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘সৈকতের বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। বালু উত্তোলনের কারণে সৈকতের সবুজ বেষ্টনী (ঝাউ বাগান) ধ্বংস হতে পারে।’ পারকি সমুদ্র সৈকত থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে কেউ পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমতি বা ছাড়পত্র নেয়নি বলে জানান তিনি।

জসিম উদ্দিন নামের এক পর্যটক বলেন, ‘এটাকে কি একটা পর্যটন কেন্দ্রে বলা যায়? চারিদিকে এতো আবর্জনা। প্রকাশ্যে জুয়া ও মাদক বেচা-কেনা হচ্ছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের একজন লোকও নেই। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলে আমাদের জিম্মি করে রাখছে। এসবের দিকে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া উচিত। না হলে সম্ভাবনাময় এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিবে।’

সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও বারশত ইউপি চেয়ারম্যান কাইয়ুম শাহ বলেন, ‘সৈকতের অনিয়ম অসংগতির বিষয়টি আমি জানি। যারা এসব অন্যায় কাজ করছে তাদের পেছনে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির হাত আছে। এসকল অনিয়মের বিষয়ে কথা বলার কারণে ৩ বছর আগে আমাকে খুবই বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে আমাকে বিভিন্নভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। যার কারণে শুরুর দিকে যেভাবে আগ্রহ নিয়ে তদারকি করতাম সেদিক থেকে সরে এসেছি৷’

‘সাবেক ইউএনও মহোদয়ও চেয়েছিলেন সৈকতটি সুশৃঙ্খল ও তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে। এজন্য তিনি কিছু পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। কিন্তু বেশকিছু বাধার মুখে পড়ে তিনিও আর আগ্রহ দেখাননি। নতুন ইউএনও বেশ ডায়নামিক লোক। আশা করি তার কঠোর পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনায় আমরা এই সৈকতকে মানসম্পন্ন পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে পারবো। এক্ষেত্রে আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা চাই।’ বলেন সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কাইয়ুম শাহ।

এ প্রসঙ্গে আনোয়ারার নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক ইমন বলেন, ‘জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনায় ইতোমধ্যে আমরা পারকি সৈকতকে মানসম্পন্ন পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করছি। পর্যটন কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয় করে আমরা প্ল্যানটা বাস্তবায়ন করবো। আশা করছি, তখন এই সমস্যাগুলো থাকবে না। তবে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত কীভাবে এসব অনিয়ম, অসংগতির লাগাম টানা যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করবো। আমি এবং এসি-ল্যান্ড মিলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’