এম কে মনির : মো. সোহেল উদ্দিন। তিনি কুড়িগ্রামের রৌমারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)। এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অর্থ আত্মসাৎ, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতনসহ অসংখ্য অভিযোগ করেছেন একাধিক নারী।
শুধু তাই নয়, সোহেলের বিরুদ্ধে রয়েছে আগের বিয়ে গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ের অভিযোগ। আবার দ্বিতীয় বিয়ে গোপন রেখে একাধিক অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে সোহেলের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের দায়ের করা মামলা ও পুলিশ সদর দপ্তরে জমা হওয়া লিখিত অভিযোগগুলোতে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এএসপি সোহেল উদ্দিন ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একটি থানার এক নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে একজন নারী কর কর্মকর্তাকে বদ্ধকক্ষে শ্বাসরোধ করে হত্যাচেষ্টা ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তার অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল উদ্দিন প্রেমের সম্পর্কের পর বারবার বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও প্রতারণা করে আসছেন। একদিন রাজধানীর মালিবাগে সোহেলের ভাড়া বাসায় ওই নারী এসআইকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেললে তারা দুজন মিলে তাকে হত্যার চেষ্টা, ছুরিকাঘাত, মারধর করে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।
এ ঘটনায় গত বছরের নভেম্বরে সোহেল ও নারী এসআইকে আসামি করে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই নারী কর কর্মকর্তা। আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করতে শাহজানপুর থানার ওসিকে আদেশ দেন, পাশাপাশি মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় অভিযুক্ত মো. সোহেল উদ্দিন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার মনতলা এলাকার মৃত মো. হাবিব উল্ল্যার ছেলে। মামলা দায়েরের সময় আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন (এপিবিএন) হেডকোয়ার্টার্সের সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে কর্মরত ছিলেন। গত বছরের ২৭ নভেম্বর তাকে কুড়িগ্রামের রৌমারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মামলার অপর আসামি নারী এসআই ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার বাসিন্দা।
মামলার আর্জিতে উল্লেখ করা হয়, সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. সোহেল উদ্দিন ও ভুক্তভোগী সহকারী কর কমিশনার দুজনই বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে রাজধানীতে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালে বিসিএস পরীক্ষার সময় তাদের পরিচয় হয়। সেখান থেকে দুজনের বন্ধুত্ব, অতঃপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় সোহেল উদ্দিন ভুক্তভোগী নারীকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করানোর কথা বলে তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে দীর্ঘ ৪ বছরের অধিক প্রেমের সম্পর্ক চলমান ছিল। এসময়ের মধ্যে সোহেল ভুক্তভোগীকে বিয়ের প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এমনকি বিশ্বাস জোগাতে সোহেল ওই নারীর বাসার নিকটে ঢাকার শাহজানপুর থানার মালিবাগের পাবনা কলোনীতে বাসা নেন। পরবর্তীতে তাদের সম্পর্কের অবনতি হলে সোহেল উদ্দিন ভুক্তভোগীকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন।
মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি সোহেল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্য তাকে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল ও খুদেবার্তা পাঠাতে থাকেন ভুক্তভোগী। পরে ওইদিন রাত আটটায় সোহেলের মালিবাগের পাবনা কলোনীর ষষ্ঠ তলার বাসায় গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দরজায় কড়া নাড়লেও সোহেল দরজা খুলেননি। সেদিন সোহেল দরজা না খুলে ভুক্তভোগীকে ফিরতি খুদেবার্তায় জানিয়ে দেন, তার পক্ষে দরজা খোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর সোহেল দরজা খুলে দিলে ভুক্তভোগী কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে সিএমপির এক নারী এসআইকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। এসময় তাদের উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী, তা জানতে চাইলে সোহেল উদ্দিন ও নারী এসআই তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। ভুক্তভোগীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করেন আসামিরা এবং নারী এসআই ফুলের টব দিয়ে ভুক্তভোগীকে সজোরে আঘাত করেন।
মামলায় তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, সেদিনের ঘটনার একপর্যায়ে নারী এসআইয়ের উসকানিতে সোহেল রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে এসে ভুক্তভোগীকে হত্যা করতে উদ্যত হলে তিনি দৌড়ে বাসার বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেন। বাথরুমে অবস্থানকালে তিনি তার পরিচিত একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে মুঠোফোনে কল করে নির্যাতনের বর্ণনা জানিয়ে দেন। এ খবর এএসপি সোহেল ও নারী এসআই জানতে পেরে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেন। ওইদিন তার পা কেটে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হয়।
ভুক্তভোগী মামলায় আরও অভিযোগ করেছেন, বদ্ধকক্ষে এএসপি সোহেল ও নারী এসআইয়ের আক্রমণের কারণে তার ঠোঁট, নাক ফেটে-ফুলে রক্তক্ষরণ ও মারাত্মক জখম হয়। এতে তার শরীরে ৫টি সেলাই দেয়াসহ তাকে ১৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে।
ভুক্তভোগীর ভাষ্য, তার উপর নির্যাতনের ঘটনা ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হলেও উভয়ের সামাজিক মানমর্যাদা ও চাকরির কথা চিন্তা করে ঘটনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তিনি কাউকে কিছু জানানো থেকে বিরত ছিলেন।
পরে ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করে শাহজানপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি, ১০ মার্চ সোহেলের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে ও ১৩ মার্চ নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে সিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তা। তবে এসব অভিযোগের তেমন কোনও প্রতিকার পাননি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ, থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হলেও সেটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়নি। মারধর ও জখমের যথেষ্ট প্রমাণ হিসেবে চিকিৎসা সনদ উপস্থাপন করলেও সোহেলের পক্ষে একপেশে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। সেসময় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কারণ জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়েছিল, উপর মহলের প্রচুর চাপ রয়েছে। তাই তাদের কিছু করার নেই। যথাযথ প্রতিকার পেতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে আদালতে মামলার পরামর্শ দেন।
পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে একই বছরের ২৩ নভেম্বর ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এএসপি সোহেল ও নারী এসআইয়ের বিরুদ্ধে খুন করার উদ্দেশ্যে মারধর ও গুরুতর জখম করার অভিযোগ তুলে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। আদালত ঢাকার শাহজানপুর থানাকে মামলাটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে মারধরের ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করলেও সোহেল তদন্তে প্রভাব বিস্তার করে প্রতিবেদন নিজের পক্ষে নিয়েছেন। আমাকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সর্বশেষ আমি আদালতের শরণাপন্ন হলে সোহেল আমাকে নানাভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি দিয়ে ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন। আমি যেন তার সাথে আপস করে সব অভিযোগ তুলে নিই। তার বিরুদ্ধে কোথাও নালিশ না করি। আমি বর্তমানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সোহেলের সাথে আমার দীর্ঘ চার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ সময়ের মধ্যে সে আমার অর্থ, ইজ্জত, মানসম্মান সবকিছু লুটে নিয়েছে। বিয়ের কথা বলে আমাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছে। আসলে সে একটা প্রতারক ও নারীলোভী এবং সেইসাথে মদ্যপও। এসব ঘটনায় আমি তার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা করেছি।’
জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. সোহেল উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তার (ভুক্তভোগী) সাথে আমার পরিচয় ২০১৭ সালে নয়, ২০২০ সালে। সে আমার বন্ধু ছিল। তার সঙ্গে যৌথ মালিকানায় আমি কিছু জমি কিনি। আমার স্বাক্ষর জালিয়াতি করে সে আমার জমিগুলো আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে। আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করলে সে ষড়যন্ত্র শুরু করে। নারী এসআই মূলত আমার সাক্ষী। সে সাক্ষী দিয়েছে তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সে আমার সাক্ষীকে আমার সঙ্গে জড়িয়ে মিথ্যাচার করছে এবং এসব ঘটনার নাটক সাজিয়েছে। ২৮ জানুয়ারি এ ধরনেরর কোনো ঘটনা ঘটেনি। জিডিতে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি।’
এরপরই তিনি ওই জিডির তদন্ত প্রতিবেদনের একটি ‘খসড়া কপি’ এ প্রতিবেদককে হোয়াটসঅ্যাপে সরবরাহ করেন; যেখানে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। জিডির অভিযুক্তের কাছে এভাবে ‘তদন্ত প্রতিবেদনের খসড়া’ কপি চলে যাওয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এতে লেখা হয়েছে, ‘তদন্ত কর্মকর্তা তার তদন্তে জানতে পেরেছেন ২০১৭ সাল থেকেই বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলের পর সোহেল ও ভুক্তভোগীর পরিচয়।’ অথচ সোহেল এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছেন, ভুক্তভোগীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল ২০২০ সালে!
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২৮ জানুয়ারি সোহেল বন্ধু-বান্ধবদের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানোর দাওয়াত করলেও ভুক্তভোগীকে দাওয়াত করেননি। ভুক্তভোগী সেদিন সোহেলের কক্ষে প্রবেশের পর নারী এসআইকে দেখতে পান। পরবর্তীতে সোহেল মুঠোফোনে কল করে তার বন্ধু শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে বাসায় ডেকে আনেন। ওইদিন মোর্শেদা মিম নামে তাদের আরেক বন্ধুকে সঙ্গী করে সোহেলের বাসায় হাজির হন শেখ মোস্তাফিজুর রহমান।
সোহেলেরই পাঠানো সেই তদন্ত প্রতিবেদনেও ভুক্তভোগীর দাবির পক্ষে উল্লেখ করা হয়, এএসপি সোহেল ও নারী এসআই আগে থেকে ওই বাসায় একা ছিলেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তাকে সেদিন সোহেলের বাড়ির দারোয়ান ঢোকার সময় সুস্থ অবস্থায় দেখলেও বের হওয়ার সময় খুড়িয়ে হাঁটতে দেখেন। ভুক্তভোগীর প্রদর্শিত চিকিৎসা সনদে তার জখমের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সেদিনের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা যায়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এএসপি সোহেল সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি আবু তোরাব পরশকে দিয়ে এ প্রতিবেদককে ফোন করান। পরশ এ প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন সিএমপির সেই নারী এসআই। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ২০১৮ সালে সোহেলের সঙ্গে রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে তার পরিচয়। যদিও সোহেল এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, তার সঙ্গে নারী এসআইয়ের পরিচয় ২০১৭ সালে।
নারী এসআই বলেন, ‘উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নারী কর কর্মকর্তা। তিনি ভাবছেন সোহেলের সঙ্গে আমার অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। যদিও সেদিন সোহেলের বাসায় আরও দুজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাদের কাউকে আসামি করা হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে নারী এসআই স্বীকার করে নেন, তিনি ও সোহেল আগে থেকে ওই বাসায় অবস্থান করছিলেন এবং নারী কর কর্মকর্তা বাসায় প্রবেশের সময় তিনি পেছনের কক্ষে ছিলেন। নারী কর কর্মকর্তা বাসায় আসার পর অন্য দুজন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
নারী এসআই আরও বলেন, ‘সোহেলের সঙ্গে আমার পরিচয় সোহেলের বোনের মাধ্যমে।’ অথচ নারী এসআইয়ের স্বামীকে, সোহেল তার সংগঠনের ছোট ভাই বলে জানিয়েছিলেন এ প্রতিবেদককে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী কিংবা বোনের বান্ধবী, সোহেলের বাসায় একা কী করছিলেন? আবার পৃথক আলাপে সোহেল উদ্দিনও নারী এসআইকে তার সংগঠনের ছোট বোন হিসেবে পরিচয় দেন। অথচ নারী এসআই একুশে পত্রিকাকে পরে বলেছিলেন, ‘তাদের পরিচয় প্রথমে ফেসবুকে, পরে সারদা পুলিশ একাডেমীতে।’
অন্যদিকে ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তার মামলায় জামিন নেননি সিএমপির উক্ত নারী এসআই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা পালিয়ে যায়, তারাই জামিন নেন। আমি তো পালিয়ে যাবো না।’
এদিকে সোহেলের বিরুদ্ধে একটি বিয়ে গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগ উঠেছে। আবার সেই দ্বিতীয় স্ত্রীকে মাত্র ১৯ দিনের মাথায় তালাকও দিয়েছেন সোহেল। এসবের মধ্যেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন ভুক্তভোগী নারী কর কর্মকর্তার সঙ্গে। সোহেলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ৩টি মামলা করেছেন নারী কর কর্মকর্তা, আর দ্বিতীয় স্ত্রী যৌতুক দাবির অভিযোগে মামলা করেছেন একটি।
সোহেলের দ্বিতীয় স্ত্রী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সোহেল উদ্দিনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রথম বিয়ের কথা গোপন করেই তিনি আমাকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় মনভোলানো সব কথা বলে সোহেল আমাদের মন জয় করে নেন। এমনকি বিশ্বাস জোগাতে বিয়ের সময় কোনওকিছুই দাবি করেননি তিনি। কিন্তু বিয়ের পরই শুরু হয় তার চাওয়া-পাওয়া। গাড়ি কেনার বায়না ধরে তিনি আমাদের কাছ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা যৌতুক দাবি করে বসেন। আমরা এত টাকা দিতে পারব না জানালে তিনি আমাকে ঘরেও তুলে নেননি। দেননি স্ত্রীর স্বীকৃতিও। তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে ঠিক। কিন্তু একদিনও সংসার করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরমধ্যে সংসারের স্বার্থে তাকে আমরা ৮৯ হাজার টাকায় ডায়মন্ড রিং কিনে দিই এবং ৩ লাখ টাকা নগদ বুঝিয়ে দিই। কিন্তু ২৫ লাখ টাকার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিচ্ছিলেন না। এসব নিয়ে আগস্টে আমাদের ঝামেলা হয়। আমরা আদালতে মামলা করি। তখনই জানতে পারি, তিনি আমাকে বিয়ের মাত্র ১৯ দিন পর অর্থাৎ মে মাসের ১৯ তারিখ ডিভোর্স দিয়ে দেন। অথচ আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ডিভোর্স সংক্রান্ত কোনো নোটিশ পাননি এবং আমরাও পাইনি। তিনি আমাকে ডিভোর্স দিয়েও সম্পর্ক চালিয়ে নিয়েছেন।’
সোহেলের দ্বিতীয় স্ত্রী আরও বলেন, ‘সোহেল মূলত একজন প্রতারক, টাকা ও নারী লোভী, অসৎ পুলিশ অফিসার। তার উপরের রূপ এক, ভেতরের রূপ অন্য। গত ৩১ আগস্ট আমি তার বিরুদ্ধে যৌতুক আইনে মামলা করেছি। এ মামলায় সোহেল অক্টোবরে জামিন নেয়। ১০ নভেম্বর মামলাটির চার্জগঠন হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সোহেল আমার সঙ্গে মারাত্মক প্রতারণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে আরও একটি প্রতারণা মামলার প্রস্তুতি চলছে। তিনি আদালতকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন নিয়েছেন। জামিন নেয়ার সময় টঙ্গি উপ-ডাকঘর থেকে আমাদের নোটিশ পাঠিয়েছেন বলে আদালতকে জানিয়েছিলেন সোহেল। আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, সেখান থেকে কোনো ধরনের নোটিশ পাঠানো হয়নি।’
এদিকে গত ২৯ জানুয়ারি ‘চাকরির শুরুতেই ৫ কোটি টাকার মালিক এএসপি সোহেল’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এএসপি সোহেলের মোট সম্পদ সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি। এই হিসাব পৈতৃক কৃষি সম্পত্তি ও অলঙ্কারাদির বাইরে। মোট সাড়ে ৫ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের মধ্যে ৬৯ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ টাকা শেয়ার/ডিবেঞ্চারে (ঋণপত্র) বিনিয়োগ করেন তিনি। এছাড়া সঞ্চয়পত্র/ইউনিট সার্টিফিকেট/বন্ডে ২০ লাখ টাকা, প্রাইজ বন্ড/সঞ্চয় স্কিমে ২০ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন খাতে আরও আড়াই কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। মোট টাকা থেকে ঋণ প্রদান করেন সাড়ে চার লাখ টাকা। তবে মোট সম্পদের মধ্যে তার দায় রয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকারও বেশি। ২০২১-২২ কর বর্ষের রিটার্নে তিনি এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন। মোট দায়ের এই অর্থ নিয়েও নয়ছয় করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির (পিওএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এএসপি সোহেল যৌথ মালিকানায় পুলিশ অফিসার্স সমবায় সমিতি-৩ এর অধীনে ২০ কাঠা জমি গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে তার নামে রয়েছে আড়াই কাঠা জমি। বাকি সাড়ে ১৭ কাঠা জমি মোসা. রানী নামের এক নারীর নামে। এই জমির মোট মূল্য ২ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সমিতিতে সোহেলের সদস্য নম্বর-১২৮৬। এই নম্বরের বিপরীতে কিস্তির মাধ্যমে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে টাকাগুলো পরিশোধ করা হচ্ছিল। কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টের বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৯১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭০ টাকা প্রদানের তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে এএসপি মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া, অর্থ আত্মসাৎ, যৌতুক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ যে অভিযোগগুলো এসেছে তার কোনোটিই সত্য নয়। নারী কর্মকর্তা তাকে ফাঁসাতে এই অভিযোগগুলো করেছেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. মনজুর রহমান বলেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে সেটি সম্পর্কে তদন্ত হয়। এটিও তদন্তের পর্যায়ে আছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার চাকরির স্বল্প সময়ে এত বিশাল সম্পদের মালিক হওয়া অস্বাভাবিক। এর পেছনে নিশ্চয়ই বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়ের একটা সম্পর্ক আছে। কাজেই নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় পুলিশের উচিত তাকে জবাবদিহির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তাছাড়া পুলিশের বিভাগীয় তদন্তের বাইরেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি খতিয়ে দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। যত বড় কর্মকর্তাই হোক, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ আদালতের নজরে আনা প্রয়োজন।