মা’র ঠিকানায় চিঠি…

:: আজাদ তালুকদার ::

কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আমার তোলা মা’র ছবি, ২০০১

কোলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আমার তোলা মা’র ছবি, ২০০১

তুমি তো জানোÑ ‘ফাইব্রোমালজিয়া’য় আমি কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। শীতেই বেশি কাবু হয়ে যেতাম। হাড়, মাংসপেশিতে কী ব্যথা! একবার শীতে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে কী বিপদেই না পড়েছিলাম! ব্যথার ছোটে রাস্তাতেই শুয়ে পড়েছিলাম। এসময় সাংবাদিক বন্ধু রশীদ মামুন, আলমগীর সবুজ, আশরাফ উল্লাহ রুবেলই ছিলেন আমার সহায়। আমার এই কষ্ট শুনে তুমি পাগল হয়ে গিয়েছিলে।

মনে আছে, ৫শ-১ হাজার করে সন্তানেরা যে টাকা তোমার হাতে গুঁজে দিতো সেরকম জমানো ১ লাখ টাকা হাতে তুলে দিয়ে আমাকে ব্যাঙ্কক হসপিটালে পাঠিয়েছিলে। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এক্সারসাইজ আর নিয়মিত সুইমিং করলেই সুস্থ হয়ে যাবো। কিন্তু আমার সেই সময় কোথায়! একদিনের জন্যও সুইমিং করিনি, এক্সারসাইজে যাইনি। অথচ গেল দুইবছরে একটিবারও এমন ব্যথা আর হয়নি।

আমি টের পাই ‘জীবিত’র চেয়ে ‘মৃত’ তুমি অনেক বেশি শক্তিশালী। তোমার প্রার্থনা, তোমার চাওয়া ঐশ্বরিকভাবে কী নিখুঁত করেই না মিলে যাচ্ছে, পূরণ হয়ে যাচ্ছে। তুমি মনপ্রাণ উজাড় করে চাইতে আমি যেন সহাস্যে থাকি, নিরাপদে থাকি। আর এখন সেটাই হচ্ছে। জীবদ্দশায় সেটা তোমার কতটা ধ্যান-জ্ঞান ছিলো আমি দেখেছি।

এত অনিয়ম করি, অনিয়ম চলি, অনিয়মে খাই; তবুও ঢের আছি, সুস্থ আছি। জানি সবই তোমার অবদান, তোমার আধ্যাত্মিক শক্তির ক্যারিশমা। প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমত্তা সর্বোপরি ‘পাইয়াস লেডি’ হিসেবে তোমার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল পাড়া-প্রতিবেশি, স্বজন-শুভার্থী মহলে। যে কোনো কাজের ‘রেজাল্ট’ তুমি আগাম বলে দিতে পারতে। যা বলতে, যা ভাবতে তাই হুবহু মিলে যেতো। দোয়া-দরুদ পড়ে পানিতে ফুঁক দিলে, আর সে পানি খেলে আমাদের পেটের পীড়া, অসুখ নিমিশে উধাও হয়ে যেতো।

তুমি নেই, কিন্তু নিরন্তর তোমার ছায়া, অস্তিত্ব বয়ে বেড়াই। যে কোনো বিপদে, সঙ্কটে তোমাকে একটু ভাবলেই ব্যস! মুহূর্তেই বিপদ হাওয়া। সঙ্কট উধাও। তোমার অনুপস্থিতিতে বিষয়টি আমি হারে হারে টের পেয়েছি, পাচ্ছি। কী আশ্চর্যরকম শক্তি তোমার!

জীবদ্দশায় বারবার তুমি বলতে, তোমার চলে যাওয়ার পর ‘আমার’ অর্থাৎ আজাদ-এর কী হবে! আমার ‘ভুলোমন’, নিজের প্রতি চরম উদাসীন্য, স্বাস্থ্যগত অত্যাচারে প্রায়শঃ তুমি হাফিয়ে উঠতে, অতিশে চিন্তামগ্ন হতে।

তুমি জেনে খুশি হবে যে, গত দুবছরে কোনো অনাকাক্সিক্ষত বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ছোটখাটো বিপদ এলেও তোমার আধ্যাত্মিকতার জোরে সেই ‘বিপদ’ পালাতে বাধ্য হয়েছে। আমাকে নিয়ে ‘ষড়যন্ত্রও’ অনেক হয়, হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না ষড়যন্ত্রকারীরা। আমার উত্থানপর্বে শত্রুরা নাখোশ হন, ক্ষুব্ধ হন। সুযোগ পেলে ক্ষতিও করতে চান। কিন্তু তারা সফল হতে পারেন না। কিন্তু তারা কি জানে, তোমার শক্তি সাবমেরিনের চেয়েও যে শক্তিশালী!

জীবনকালে ভেবেছিলে তুমি চলে যাওয়ার পর ঠিকমতো খেতে, ঘুমোতে, বিশ্রাম নিতে, ওষুধ খাওয়ার বিষয়গুলোতে কে আমায় বাতলে দেবে, স্মরণ করিয়ে দেবে! এই চিন্তায় অস্থির হয়ে যেতে তুমি। আজ তুমি খুশি হবে জেনে, তোমার যাওয়ার পর এসবে আমার একদমই ব্যত্যয় ঘটছে না। তোমার যোগ্য উত্তরসুরি, তোমার কন্যা মুন্নীই (অন্তরার মা) এখন আমার সব দেখভাল করে। সকাল-বিকেল ফোন করে এসবের ফলোআপ করা তার যেন নিত্য কাজ। ভালো কিছু খেলে তোমার সেই মেয়েটি আমাকে স্মরণ করেই। আমি নিজের বেলায় উদাসীন বলে মাঝে মাঝে সে নিজেই আমার নিয়মিত সেবনের ওষুধগুলো নিয়ে হাজির হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সে যেন তোমারই প্রতিচ্ছবি, একেবারে তোমার কার্বণ কপি। তোমার দিয়ে যাওয়া দায়িত্ব সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।

তুমি জেনে আনন্দিত হবে, গত দুবছরে তোমার সন্তানের অর্জন কম নয়। মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছি, পেয়েছি পরিচিতি আর সম্মান। পেশাগত উন্নতিও হয়েছে ঢের। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুই তোমার কল্যাণভাবনা, অন্তর্নিহিত দোয়ার ফল। আমি তোমার অত যোগ্যসন্তান নই। অনেক অক্ষমতা আমার। তবুও দারুণ সম্মানে চলি, মর্যাদায় থাকি। বিশ্বাস করি আমার আষ্ঠে-পৃষ্ঠে তুমি আছো বলেই আমি আজ এতটা হয়েছি।

একটা কাজ এখনো অনেক বাকি। আর সেটা হচ্ছে ‘প্রকৃত মানুষ’ হওয়া। তুমি তো জানো, এই সমাজের অনেকেই অনেক প্রতিযোগিতা দেন। যেমন ধরো-বিত্তের প্রতিযোগিতা, অর্থের প্রতিযোগিতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও কত কী! হয়তো তোমাদের সন্তান বলে সেই প্রতিযোগিতায় আমরা শামিল হতে পারি না। তুমি, তোমরাই তো বলেছিলে, মানুষ হওয়ার প্রতিযোগী হতে! তুমি জেনে আবারও খুশি হবে, সেই প্রতিযোগিতায় এখনো লেগে আছি মা। দোয়া করো-মানুষ হওয়ার এই কঠিন প্রতিযোগিতায় যেন টিকে থাকতে পারি। তোমার কবরে গিয়ে যেন বলতে পারিÑ ‘মা আমি মানুষ হয়েছি, সত্যিকারের মানুষ।’

দ্রষ্টব্য : ২০১৩ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে আজকের ১ লা অক্টোবর। এই ৭৩০ দিনে এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভোলা যায়নি, ভুলতে পারিনি। অনেক ভালো থেকো মা…।