এম কে মনির : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হয়। কিন্তু এসএসসির গণ্ডি পার হতে না পারা এক আওয়ামী লীগ নেতাকে আবার চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী থানাধীন ঘাটফরহাদবেগ সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বানানো হচ্ছে।
সভাপতি হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো দায়িত্ব পেতে যাওয়া শিহাব উদ্দিন ২০ নং দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
শিহাবকে সভাপতি পদে রেখে ১১ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির খসড়া তালিকা ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহনাজ আফরোজা।
জানা যায়, ঘাটফরহাদবেগ সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদের জন্য ২ নারী ও ১ জন পুরুষ সদস্য বায়োডাটা জমা দেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই স্নাতক ডিগ্রীর সনদ ছিলো না। নির্ধারিত সময়ে সনদ উপস্থাপন করতে না পারায় তাদেরকে আবেদন প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়। কিন্তু দুজন নারী প্রার্থী আবেদন প্রত্যাহার করে নিলেও তা করেননি শিহাব উদ্দিন। উল্টো জাল সনদ তৈরি করে বিদ্যালয় বরাবর জমা দেন।
পরবর্তীতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলে শিহাব উদ্দিনের সনদগুলো যাচাই-বাছাই করেন স্থানীয় কাউন্সিলর চৌধুরী হাছান মাহমুদ হাসনী। এতে সরকারি মুসলিম হাইস্কুল কর্তৃক শিহাব উদ্দিনের এসএসসি সনদ ভুয়া বলে প্রতিয়মান হয়। বিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্নের আশঙ্কায় কাউন্সিলর সভাপতি প্রার্থী শিহাব উদ্দিনের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। একইসাথে তিনি স্নাতক ডিগ্রীধারী নয় এমন কাউকে কমিটিতে সভাপতি না করার অনুরোধ জানান। অন্যথায় কমিটিতে নিজের নাম যুক্ত না করারও অনুরোধ করেন তিনি।
কিন্তু গত ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ঘাটফরহাদবেগ সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় শিহাব উদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি ও সনদ জালিয়াতির প্রতিবাদ করে সভা ছেড়ে যান কাউন্সিলর। কিন্তু পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহনাজ আফরোজা শিহাব উদ্দিনকে দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতি করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কাছে পাঠান। এ কমিটিতে পদাধিকার বলে প্রধান শিক্ষককে সদস্য সচিব ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সদস্য করা হয়েছে।
অপরদিকে কমিটির ১০ জন সদস্য খসড়া তালিকায় স্বাক্ষর করলেও কমিটির তৃতীয় ব্যক্তি ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী হাছান মাহমুদ হাসনী কমিটি বর্জন করে স্বাক্ষর প্রদান করেননি। একইসাথে তিনি কোতয়ালী থানা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের নিকট কমিটি বর্জনের ব্যাখ্যা দিয়ে চিঠিও লিখেছেন। চিঠিতে কাউন্সিলর হাসনী উল্লেখ করেছেন, কমিটির সভাপতি শিহাব উদ্দিন মাধ্যমিক পাশ করেননি। তার জমা দেয়া এসএসসি, এইচএসসি ও স্নাতক পাশের সবকটি সনদই জালিয়াতি করে তৈরি করা। চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, কমিটিতে স্নাতক ডিগ্রীধারী ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করলে তাকে সদস্য না করার জন্য তিনি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র উপেক্ষা করে শিহাব উদ্দিনকে পুনরায় সভাপতি করা হয়েছে। যিনি মাধ্যমিক পাসও করেননি। এমনকি তার বিরুদ্ধে জাল শিক্ষা সনদ তৈরির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিহাব উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছি। তখন অনলাইন এন্ট্রি ছিলো না। তাই হয়তো নেই। সেসময় যারা শিক্ষক ছিলেন তারা এখন নেই। তাই হয়তো জানাতে পারছেন না।’
এসময় শিক্ষক যেই থাকুক অথবা অনলাইন এন্ট্রি না থাকলেও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সব বছরের শিক্ষার্থীদের পাসের তালিকা বিদ্যালয় রেজিস্ট্রারে উল্লেখ থাকার কথা জানানো হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
এদিকে জাল সনদধারীকে পুনরায় সভাপতি করার বিষয়ে জানতে চাইলে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শহীদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কমিটির বিষয়টি দেখবেন থানা শিক্ষা অফিসার। এসব বিষয় তিনি যাচাই-বাছাই করে আমাদের কাছে জমা দেবেন। তিনি যদি সভাপতির সনদ জাল বলে প্রতিবেদন দেন, তাহলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
ঘাটফরহাদবেগ সরকারি বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শাহনাজ আফরোজা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার কোন এখতিয়ার নেই। সব এখতিয়ার থানা শিক্ষা অফিসারের। তিনি আমাকে যেভাবে দিতে বলেছেন আমি ঠিক সেভাবেই দিয়েছি। কে জাল সনদধারী কে আসল সনদধারী এসব দেখার ক্ষমতা আমার নেই। সব দায়িত্ব থানা শিক্ষা অফিসার হারুনুর রশীদের।’
এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানা শিক্ষা অফিসার হারুনুর রশিদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সভাপতির সনদ জালের বিষয়ে এলাকাবাসী বা জনপ্রতিনিধি কেউ আমাদের কাছে লিখিত কোন অভিযোগ দেননি। অভিযোগ না দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব না। এতে আমাদের কিছু করার নেই। কাউন্সিলরও আমাদের কোন অভিযোগ দেননি৷’
যদিও কাউন্সিলর চৌধুরী হাছান মাহমুদ হাসনীর দাবি, তিনি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি গত ২ মাস ধরে বলে আসছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে তিনি বেশ কয়েকবার জানিয়েছেন বিষয়টি। সর্বশেষ থানা শিক্ষা অফিসারকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
দেওয়ান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী হাছান মাহমুদ হাসনী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে কয়েকবার বলে এসেছি স্নাতক ডিগ্রীধারী ছাড়া কাউকে যেন সভাপতি করা না হয়। সরকারি পরিপত্র যেন মানা হয়। কিন্তু কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সনদ জালিয়াতি করা বিতর্কিত ব্যক্তিকে পুনরায় সভাপতি করা হয়েছে। আমি এ কমিটির সঙ্গে থাকতে চাই না। এসবের দায় নিতে আমি রাজি নই ‘