৫১ বছরেও মেলেনি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি


সেকান্দর আলম বাবর, বোয়ালখালী (চট্টগ্রাম) : মুক্তিযুদ্ধের সময় বোয়ালখালীতে রাজাকার আর পাক বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হন এখলাছুর রহমান। তবে শহীদের স্বীকৃতি মেলেনি ৫১ বছরেও।

শহীদ হিসেবে এখলাছুর রহমানের নাম নেই উপজেলা সমাজসেবা অফিসের সমন্বিত তালিকায়। তাই, সকল ধরণের ভাতা থেকে বঞ্চিত এখলাছের পরিবার।

এখলাছকে ‘শহীদ’ এর তালিকায় যুক্ত করতে বছরের পর বছর দৌঁড়ঝাঁপ করে, এখন হাঁপিয়ে উঠেছেন তার পরিবার। এখলাছের মা সৈয়দা মছুদা খাতুন ২০১৬ সালে মারা যান, ছেলের ‘শহীদ’ স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে।

শহীদ এখলাছের ভাগিনা মোজাম্মেল হক এরশাদ বলেন, আমার দুই জীবিত মামা প্রবাসে থাকেন। এখলাস মামার শহীদ স্বীকৃতি আদায় করতে আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হয়রান। প্লিজ মামার সঠিক ইতিহাসটা সকলের সামনে তুলে ধরুন।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ না করেও অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধা। আর আমরা শহীদ পরিবার হয়েও আইনি আর অদৃশ্য জটিলতায় জর্জরিত।

মোজাম্মেল বলেন, আমার মামা এখলাছুর রহমান ক্যাপ্টেন করিমের গড়া বাহিনীর সদস্য ছিলেন। স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের অধ্যাপক (পাক বাহিনীর হাতে শহীদ) দিলীপ চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধে অংশ নেন।

স্থানীয়রা জানান, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এখলাছের আত্মত্যাগ স্মরণ করে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় সাধারণ জনতা শহীদ এখলাছের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতা ছিল কয়েক বছর। ৭৫’ পরবর্তী সব হারিয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যাপীঠ কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনকে নামকরণ করা হয় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ মিলনায়তন’।

হাজিরহাট ইকবাল পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিলো ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ পার্ক’। কালের বিবর্তনে এগুলো এখন হারিয়েই গেছে। ২০১৮ সালের ৭ জুলাই পোপাদিয়া ইউনিয়নের আকুবদন্ডী মিনাগাজী দরগাহ্ গেইটে শহীদের নামে সড়কের উদ্বোধন করেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন আহমদ খান বাদল। ব্যাস, অতটুকুুতেই শেষ! ২০২২ সালে এসেও নামফলকে তার নামই উঠেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট বোয়ালখালীর কধুরখীলের খোকার দোকানে সম্মুখযুদ্ধ হয় পাক বাহিনি ও এ দেশীয় রাজাকারদের সাথে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ওই যুদ্ধে গ্রেনেড ছুঁড়ে পাক আর রাজাকার বাহিনীর ভীতে কম্পন ধরিয়েছিলেন এখলাছুর রহমান। পরিণামে উৎসর্গ করতে হয় নিজের জীবন। ওইদিন পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। ১০ আগস্ট তার লাশ পাওয়া যায় চট্টগ্রাম শহরে। রাজাকার প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন এলাকায় এসব তথ্য জানিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ বশর।

১০ তারিখেই লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে বৈলতলী মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে এ মহান যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পরও মুখে মুখে ‘শহীদ’ কাগজে কলমে ‘মরহুম’। অবশেষে ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মিলে। তাও আবার ‘শহীদ’ হিসেবে নয় ‘মরহুম’ হিসেবে। ২০২১ সালের ২৭ জুন ৩৩২৯ নং গেজেটমূলে তাকে শহীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে তাতেও টানাপোড়েন শেষ হয়নি। ২০২২ সালে এসেও সব ধরণের ভাতা ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা বঞ্চিত এ শহীদের পরিবার। সর্বশেষ গত ২ মাস আগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার কবর পাকাকরণের কাজ শুরু হয়। কাজ এখনও চলমান। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল (মুক্তি/কবর/বো-১১৮) ১৯৯৭ সালে তার কবরটি পোপাদিয়ার আকুবদন্ডীর বৈলতলী দরগাহ্ সংলগ্ন স্থানে চিহ্নিত করে।

পরিবার ও সহযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭০ সালে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন এখলাছ। তখন ছাত্র ইউনিয়নের সংবাদবাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে অহসযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। স্বাধীনতা সংগ্রামেও তিনি সংবাদবাহকের কাজ করে করেন। কধুরখীলে খোকার দোকান এলাকায় পাক ও রাজাকার বাহিনীর আক্রমনের সংবাদে তিনি আর সংবাদবাহক রইলেন না। ছুটে যান পার্টির মহিলা কর্মী মায়া চৌধুরীর কাছে। তার কাছে পার্টির গোলা-বারুদ মজুদ থাকত। তার কাছ থেকে তিনটি হাত গ্রেনেড সংগ্রহ করেন তিনি। কধুরখীল খোকার দোকান এলাকায় একটি চায়ের দোকানে বসে রাজাকারের অপেক্ষা করেন। রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের আসতে দেখে ৫০ গজ দূর থেকে তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে রাস্তার ধারে খাদে বিস্ফোরিত হয়। আর দুটি গ্রেনেডে কয়েকজন রাজাকার ও পাক সেনা আহত হয়। আর গ্রেনেড না থাকায় তিনি পালিয়ে একটি পুকুরের কচুরিপানায় ডুব দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। রাজাকারেরা তাকে ধরে বিবস্ত্র অবস্থায় রিকশা চেপে নিয়ে যায় গোমদন্ডী সদরের রাজাকার ঘাঁটিতে। নির্মম নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়। রেজিস্ট্রেশনে তার মৃত্যু তারিখ নিবন্ধিত হয় ৪ আগস্ট, ১৯৭১।

জানতে চাইলে বোয়ালখালী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সেলিম বলেন, কত কবর পাকা হলো, অথচ এখলাছের কবরটি পাকাকরণে দীর্ঘসূত্রিতা কেন? তা খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কোন কর্মসূচি কেন রাখা হয় না, তা বোধগম্য নয়। কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারি সুবিধা পাচ্ছে কিন্তু শহীদ এখলাছ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ-তার প্রতি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা পীড়া দিচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা স্মৃতিসৌধে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামের তালিকায় যে আটজনের নাম স্পষ্ট উল্লেখ আছে, সেখানে শহিদ এখলাছুর রহমান ৭ নম্বরে আছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মামুন বলেন, স্মৃতিসৌধে নাম থাকলে হবে না, তালিকায় থাকতে হবে। তাকে তালিকাভুক্তির আবেদন করতে হবে।

তালিকাভুক্তির আবেদন করা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, এখানে স্থানীয় প্রশাসনের কিছু করার নেই। জামুকা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যথাযথ আবেদন করতে হবে।