এম কে মনির : চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের প্রধান ফটকে দাঁড়াতেই চোখে পড়বে একটি পাঁচতলা ভবন। ‘প্রশাসনিক ভবন’ হিসেবে পরিচিত পুরাতন ওই ভবনটি ভেঙে বিক্রি করে ফেলার উদ্যোগ নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়।
এতে অংশ নিয়ে অবিশ্বাস্য কম দামে ভবনটি কিনেছেন ৩১ নং আলকরণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুম। পাঁচতলার ভবনটি কিনতে কাউন্সিলর মাসুমের খরচ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। অথচ ভবনটির শুধু রড ও ইটের মূল্যই রয়েছে ৩০ লাখ টাকা।
অভিযোগ, ভবনটির দরপত্রে সর্বোচ্চ দর ৩০ লাখ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর ২৭ লাখ টাকা উঠলেও প্রভাব খাটিয়ে দরপত্র ড্রপ করা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছেন কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুম। ফলে সরকারি কোষাগারে ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে জমা হবে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
জানা যায়, সরকারি সিটি কলেজের পুরাতন পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে সেটি ভাঙার জন্য দরপত্র আহ্বান করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। উন্মুক্ত টেন্ডার পদ্ধতিতে গত ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই টেন্ডারে অংশ নেয়।
এতে আরএসপি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩০ লাখ টাকা দর তোলে; যা সর্বোচ্চ দর। এছাড়াও সজিব কর্পোরেশন দর তোলে ২৬ লাখ টাকা ও এনাম এন্টারপ্রাইজ তোলে ১২ লাখ টাকা। অন্যদিকে কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুমের প্রতিষ্ঠান আলিফ ট্রেডার্স তোলে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, গত ১৮ ডিসেম্বর টেন্ডার বক্স খোলার দিন সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমঝোতার কথা বলে ডেকে নিয়ে যান কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুম। এসময় চাপ প্রয়োগ করে তাদেরকে দরপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করেন তিনি। ফলে ৩টি প্রতিষ্ঠান লোকসানের অজুহাতে দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়।
শেষে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। এতে একটি প্রতিষ্ঠান আব্দুস সালাম মাসুমের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কিছু টাকা কম দর তোলে। অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার আবেদনে কাগজপত্রের ঘাটতি থাকায় সেটির আবেদন বাতিল করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় টেন্ডারটি পেয়ে যান কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুম।
সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ও নিলাম কমিটির আহ্বায়কের স্বাক্ষর করা দুটি নথি একুশে পত্রিকার হাতে এসেছে। যেগুলোর একটিতে পুরাতন ওই পাঁচতলা ভবনটির মালামাল অপসারণ ও উদ্ধারকৃত মালামালের পরিমাণ ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। তবে মালামালের বাজার মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
এ প্রতিবেদক একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে মালামালগুলোর সর্বনিম্ন বাজার মূল্য হিসাব করার চেষ্টা করেন। এতে জানা যায়, ভবনটিতে মোট ৩১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা মূল্যের বিক্রয়যোগ্য মালামাল রয়েছে। যেখানে ১০ ইঞ্জি গাঁথুনির দেয়ালে প্রায় ৭০ হাজার ইট রয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এছাড়াও ভবনটি ভাঙার পর প্রায় ২৬ হাজার ঘনফুট রাবিশ ও ব্যাটস পাওয়া যাবে। যেগুলোর সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ১ লাখ টাকা।
ভবনটিতে পুরাতন রড পাওয়া যাবে ৪৬ হাজার কেজি। যার বাজার মূল্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। একইসাথে জ্বালানি কাঠ, লোহার গ্রিল, লোহার কলাপসিবল গেইট, কাঠের দরজা পাল্লা, জিআই পাইপ রয়েছে আনুমানিক ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার। সর্বমোট ওই ভবনটিতে উদ্ধারযোগ্য তথা বিক্রয়যোগ্য মালামালের বাজার মূল্য প্রায় ৩১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই কাজ কাউন্সিলরকে পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ সুদীপা দত্ত। ফলে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় পাঁচতলা একটি ভবন পেয়ে গেছেন কাউন্সিলর। অথচ ভবনটির ভ্যালুয়েশন ৪৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে এ কথা মানতে নারাজ সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ও নিলাম কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. সুদীপা দত্ত। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘৪৫ লাখ টাকা নয়, ভবনটির ভ্যালুয়েশন ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা।’ যদিও এ সংক্রান্ত কোন ডকুমেন্টস তিনি এ প্রতিবেদককে দিতে পারেননি। এসময় তিনি প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনার কি মনে হয় ওই পাঁচতলা ভবনটিতে ৩০ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে? এটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ ও পুরাতন ভবন। এতো টাকার মালামাল সেখানে থাকবে না।’
এসময় কেবল রড ও ইটের মূল্যই রয়েছে ৩০ লাখ টাকা; সেক্ষেত্রে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজারে কেন টেন্ডার দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সুদীপা দত্ত বলেন, ‘এগুলো আমি জানি না। মালামালের মূল্য সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। শিক্ষা প্রকৌশলের প্রকৌশলীরা দাম নির্ধারণ করেছেন। আমি তো প্রকৌশলী নয় যে দাম নির্ধারণ করতে পারব। কেন ৪৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে সেটি আমি জানব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে আলিফ ট্রেডার্সকে ১ লাখ ২০ হাজারে কাজটি দেয়া হয়। অবশ্য টেন্ডার বক্স খোলার আগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়। সেসময় আমি কারণ জানতে চাইলে তারা বলেছেন, কাজটি নিলে তাদের নাকি লোকসান হবে। তারা যদি দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে তাতে আমার করার কিছু নেই। তারা দরপত্রে ৩০ লাখ উল্লেখ করেছে নাকি ২৭ লাখ উল্লেখ করেছে তা আমি খুলে দিখিনি। শুনেছি তাদের মধ্যে (ঠিকাদার) একটি সমঝোতা হয়েছে। সবাই তো ছাত্রলীগ। কেউ তো আর বাইরের নয়। তবে কি ধরণের সমঝোতা হয়েছে সেসব আমি জানি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ ঠিকাদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পুরাতন পাঁচতলা ভবনটি ভাঙতে ঠিকাদারের খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা। এর বেশি হওয়ার কথা নয়। কম দামে কাজ পছন্দের ঠিকাদারকে পাইয়ে দিতে সংশ্লিষ্টরা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন। এ ধরণের একটি ভবন ভাঙার কাজ কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকায় দেয়া যেত। সেক্ষেত্রে সরকারি কোষাগারে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ জমা হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাগাভাগি করতে ভ্যালুয়েশন কম করিয়ে নেয়া হয়েছে হয়তো। পাঁচতলা ভবনের ভ্যালুয়েশন মাত্র ৪৫ হাজার টাকা, বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেখানে কেবল রড ও ইটের দামই প্রায় ৩০ লাখ টাকা।’
জানতে চাইলে ৩১ নং আলকরণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সালাম মাসুম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার এসব করার সময় নেই। আমার ফার্মটি বেশ স্বনামধন্য হওয়ায় ছেলেরা আমার প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার নিতে চায়। তারা চেয়েছে তাই দিয়েছি। আর ভবনটির ভ্যালুয়েশন ৪৫ লাখ নয়, ৪৫ হাজার টাকা।’ প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের দরপত্র প্রত্যাহার করিয়ে নিতে তার চাপ প্রয়োগের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম না সেখানে। আর আমি কেন প্রভাব খাটাব? ছোট ভাইয়েরা টেন্ডার নিয়েছে। কী হয়েছে তারাই ভালো জানে।’ আপনার প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া মানেই আপনি নিয়েছেন উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিয়েছি। আমি সর্বোচ্চ দর দিয়ে নিয়েছি। এর বেশি কেউ দর তোলেনি।’
এ বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার সরকার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সব ক্ষেত্রেই ভবনের একটি ইস্টিমেট করে দিই। এটিও আমরা করে দিয়েছি। ভবনের মোট মালামালের বিক্রয় মূল্য থেকে ভাঙার খরচ বাদ দিয়ে যে অঙ্ক আসে তাই হবে ভ্যালুয়েশন। তবে সিটি কলেজের ওই ভবনের ক্ষেত্রে সেটা ঠিক কত তা এ মুহূর্তে জানাতে পারছি না। ৩০ লাখ টাকার মালামাল যদি সেখানে থাকে তাহলে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় টেন্ডার দেয়া হলে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ হারাবে।’ এ বিষয়ে তিনি সিটি কলেজের পুরাতন পাঁচতলা ভবনের মালামালের ইস্টিমেট প্রস্তুতকারী উপ-সহকারী প্রকৌশলী দিলিপ কুমার নাথের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী দিলিপ কুমার নাথ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অনেক আগে ভবনটির ইস্টিমেট করা হয়েছে। সেটি কত ছিল তা মনে পড়ছে না। তবে সরকারি রেটে প্রতি এক হাজার ইটের মূল্য ৪ হাজার টাকা। এছাড়াও প্রতি টন রডের দাম ৩০ হাজার টাকা। আমরা ইস্টিমেট দিয়ে দিয়েছি। এখন ওনারা টেন্ডার করে যদি আমাদের উপর দায় চাপায় তাহলে তো হবে না। কোন অনিয়ম হলে সেটি তাদের কাছে জানতে চান। টেন্ডার আমরা দিইনি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অবিলম্বে এ টেন্ডার বাতিল করা দরকার। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের অনিয়ম চলতে থাকলে শিক্ষক সমাজের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের যে সম্মান, শ্রদ্ধা আছে, সেটি শূন্যের কৌটায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটি আমাদের জন্য লজ্জার, চরম বেদনার হবে।’