ফ্লাশব্যাক : জয় হোক সম্প্রীতির

:: নিবারণ বড়ুয়া ::
writing২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সাল। শনিবার মধ্যরাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল শান্ত বৌদ্ধ জনপদ। ভরা পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোতে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল বৌদ্ধ পলী। বৌদ্ধ ধর্মীবলম্বীদের মন। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল শত বছরের বিশ্বাসের ভিত। পুড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকশত বছরের বৌদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষি ১৩টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। প্রতিবেশি, বন্ধুত্ব এবং শত বছরের বন্ধন ভেঙ্গে মুহুর্তেই প নিয়েছিল ভয়ের, আর্তনাদের। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল রামুর বৌদ্ধরা। নিজের চোখ-কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বিশ্বাসে চিড় ধরল সবার মনে। শুধুমাত্র ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ তুলে তা-বের শুরু হয়। তা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়াতে। এক রাতেই রামুর ২৭টি বৌদ্ধমন্দিরের মধ্যে ২০টিই পুড়িয়ে দেয়া হল। মন্দিরগুলোতে রক্ষিত ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান, চীন, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের ব্রোঞ্জ, অষ্টধাতু, শ্বেতপাথরসহ মূল্যবান ধাতুর তৈরি ছোট-বড় সহস্রাধিক মূর্তি ছিল। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক মূর্তি আগুনে পুড়ে গেছে, বড় মূর্তিগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে আর পিতলের কিছু মূর্তি লুট করা হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় বার্মিজ, পালি, বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার দু®প্রাপ্য ত্রিপিটক।
৩০ সেপ্টেম্বর সকালে ঘটনার জানাজানি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গুজব। আমি তখন নিজস্ব প্রতিবেদক হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিদিনে কর্মরত। সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ব্রিফিং ছিল সচিবালয়ে। আমি অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করে বের হতেই আমাকে ফোন করলেন ব্যারিস্টার বিপব বড়–য়া। আসতে বললেন বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশানের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কর কমিশনার (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত) অশোক বড়–য়ার সেগুনবাগিছাস্থ অফিসে। তখন সাড়ে ১১ টা। আমরা তিন জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কী করা যেতে পারে। ডেইলি সানের সিনিয়র আর্টিস্ট কল্লোল বড়–য়াকে ফোন করে পাঠানো হলো ডিজিটাল ব্যানার তৈরি করতে। আর আমি গেলাম ডিএমপিতে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং মানববন্ধন করার অনুমতি নিতে। গিয়েই পেয়ে গেলাম বন্ধুবর এএসপি মাশরুখকে। তিনি আমাকে সাহায্য করলেন। ফোন করলাম এপি, রয়টার্স, বিবিসি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বেশ কিছু গণমাধ্যমের বন্ধুদের। তারা কোনো কথা না বাড়িয়েই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে চলে আসলেন। গণমাধ্যমের সবাই আমাদের পাশে দাঁড়ালেন। সাহস দিলেন কোনো ভয় নেই। স্বাধীন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনোভাবেই নষ্ট হতে পারে না। সেই দিন সব গণমাধ্যমেই প্রতিবাদমুখর। রামুর খবরটি প্রধান খবর হিসাবে ছাপানো হয়েছিল। দেশের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে গেল। প্রথম আলোর কামরুল ভাই, আর ডেইলি স্টারের জুলফিকার আলী মানিক ভাই, রয়টার্সের ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপির) দুই ফটো সাংবাদিক রামু চলে গেলেন। রামু পৌঁছে দুই ফটো সাংবাদিক আমাকে ফোন করলেন। আমি রামুর সাংবাদিক সুনীল বড়–য়াকে ফোন করে বললাম তাদের সহযোগিতা করতে। এর কিছুক্ষণ পরপরই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিশ্বের মানুষ দেখতে লাগলো পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধ বিহার, বুদ্ধমূর্তি এবং আতঙ্কিত মানুষের ছবি। বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গেলেন রামু। পরিদর্শন করলেন। হামলার শিকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিলেন। সেই দিনই রামুবাসিকে কথা দিলেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ করে দেওয়া হবে সব কিছু। আপনাদের ভয় নেই।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সফরসঙ্গী হয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম বাংলাদেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের শিক্ষাবিটের কয়েকজন সাংবাদিক। মন্ত্রী কক্সবাজারের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে শিক্ষক বাতায়ন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে আমাকে বললেন আপনার বাড়িতো এই এলাকায়। চলেন কয়েকটি স্কুল এবং কলেজ পরিদর্শন করতে রামুর দিকে যাই। রামু এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মন্ত্রীর গাড়ির পিছনে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং আমাদের গাড়ি। রামু পৌঁছানোর পর দেখলাম অচেনা এক দৃশ্য। সম্পূর্ণ অচেনা একটি জায়গা। আগের সেই ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে বিহারগুলো তৈরি হয়েছে এক-একটা দালানে। সামনে পিছনে ফুল বাগান। মনে হলো এ যেন বিহার নয় কোনো পার্ক কিংবা সরকারের উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার বাসভবন। পর্যটকের ভিড়। সরকারের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষামন্ত্রী রামু যাওয়াতে রামুবাসিরাও ভিড় করলেন। মন্ত্রী মহোদয় রামু বালিকা উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শনের পরে স্থানীয় সাংবাদিক দুলাল বড়–য়া আমাদের নিয়ে গেলেন একশত ফুট লম্বা সিংহ শয্যা বুদ্ধমূর্তির কাছে। সেটি আরো দৃষ্টিনন্দন। সেখানে প্রবেশের পর মনে হয়েছে এটা কি সত্যিকারের রামু না কি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠি শাসিত কোনো রাষ্ট্র।
সেখান থেকে ফেরার পথে সাংবাদিকদের গাড়িতে না উঠে আমি কক্সবাজারের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদের গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে চলতে তিনি আমাকে বললেন হীনম্মন্যতা আর ধর্মান্ধতার কারণে রামুর মত ঘটনাগুলো হয়। এক সময় এই এলাকায় পারস্পরিক সহাবস্থান ছিলো। মাঝখান দিয়ে সেই সম্পর্কের চিড় ধরলেও এখনো রামুতে নৌকাবাইচ, জাহাজ ভাসানোর মতো অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে।
রামুর বৌদ্ধ পলীতে হামলার প্রতিবাদে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল সচেতন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। কলম ধরেছিল প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, বরেণ্য শিক্ষক ও সাংবাদিকেরা। আলোড়ন উঠেছিল বিশ্বজুড়ে। সাম্প্রদায়িক হামলা এবং দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপর হামলা কেউ মেনে নিতে পারেনি। এর এক বছরের মাঝে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরতœ শেখহাসিনার আন্তরিকতায় এবং নিজের হস্তক্ষেপে বদলে যায় রামুর ধ্বংসস্তুপের চেহারা। ক্ষতিগ্রস্ত বিহার নির্মাণ করা হয় নতুন আঙ্গিকে, নতুন নকশায়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এক বছরের মধ্যেই নির্মাণ করা হয় সমস্থ বৌদ্ধ বিহার। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের বাড়ি পাকা করে দেওয়া হয়। আগের ঘিঞ্জি পরিবেশ বদলে রামু পরবেশ বদলে যায়। দৃষ্টিনন্দন বিহারের কারণে রামু হয়ে উঠে পর্যটন এলাকায়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে এসব মন্দির দেখতে।
তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায়, ভালবাসায় রামুতে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার গড়ে উঠলেও রাতের নৃশংসতা, দুস্কৃতিকারীদের ঘৃণ্য চেহারা এবং বিহারে আগুন দেওয়ার প্রত্যক্ষ দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক হতে পারছে না রামুর বড়–য়া সম্প্রদায়। কারণ তাদের শত বছরের বিশ্বাসের ভিত, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ভেঙে গেছে সেই রাতে। এর পরেও তারা আবারও পথ চলছে। প্রতিদিন উঠা বসা হচ্ছে পাড়া প্রতিবেশিদের সঙ্গে। যাদের বিকৃত চেহারা ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে তারা দেখেছিল। সত্যিকার অর্থে দেশের কোনো মানুষই সাম্প্রদায়িক হানাহানি চায় না। ফলে এই হানাহানি বন্ধ করতে সরকার যে উদ্যোগ নেবে, তাতে মানুষের সমর্থন থাকবে। সত্যিকার অর্থে আমরা বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে দেখতে চাই। আমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চাই না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ ও লালনকারী এই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যতিনের খবর, জমি দখলের খবর আমাদের দেখতে হয়। আবার বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় আসলেও একই নির্যাতন আমাদের সইতে হয়। একদল আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছি বলে নির্যাতন করে। আরেক দল শোষণ করে সংখ্যালঘু বলে। আমরা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াই। এই দেশ সকল সম্প্রদায়ের। এই দেশ আমাদের সবার। ১৯৭৮ সালে যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু, ২০১১ সালে এসে সেই সংখ্যা নেমে গেছে ৯ শতাংশের নিচে। এই পরিসংখ্যান আমাদের লজ্জিত করে, মর্মাহত করে। যাঁরা বাংলাদেশকে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’ বলে বিশ্বসভায় পরিচয় করিয়ে দিতে চান, তাঁদের এই পরিসংখ্যান পরিহাস করে।
অস্বীকার করার উপায় নাই ধর্মান্ধতা- রাজনীতি, প্রশাসন ও আমাদের যাপিত জীবনে এমনভাবে প্রোথিত যে সেটাকে আর আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক প্রচারে আমরা মধ্যপন্থী নামে পরিচিত হলেও বাস্তব অবস্থা ছিল ভিন্ন। শিক্ষিত মহলের একাংশ ভাবতে ভালবাসেন যে, বাংলাদেশ একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র এবং সেখানে সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করছে। এই ভাবনার সমস্যা হলো এই যে, তাতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া সমস্ত নির্যাতনকে অস্বীকার করা হয়। এই সাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, সমাজ জীবনে, অর্থনীতিতে, এমনকি দৈনন্দিন প্রাত্যহিকতায়। আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে। রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেছে সাম্প্রদায়িকতা। ভেদবুদ্ধি মানুষকে সম্প্রদায় দিয়ে চিহ্নিত করছে। বাস্তবে চিন্তা করলে দেখা যায়, ধর্ম ও ধার্মিকতা পৃথিবীকে শান্তি দিতে পারে। এর প্রমাণ সিলেটের শাহজালাল, শাহপরান, খুলনার খানজাহান আলী, চট্টগ্রামের বার আউলিয়া, গৌতম বুদ্ধ, রাম কৃষ্ণ পরম হংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, লোকনাথ ব্রক্ষ্যচারী তারা সবাই যুগে যুগে ধর্মীয় সমপ্রীতি রক্ষা করেছেন। মানুষকে শান্তি দিয়েছেন। অথচ এই ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজে অশান্তি আনা হচ্ছে। এই স্বাধীন দেশে আমরা আর চাই না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হানাহানি। আমরা বাঙালি। আমরা বাঙলা মায়ের সন্তান। জয় হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। জয় হোক মানবতার।
নিবারণ বড়ুয়া, সাংবাদিক