ওপারে অনেক ভালো থাকুন বীর মহিউদ্দিন


আজাদ তালুকদার : সেনাবাহিনীর পাসিং আউট অনুষ্ঠান ২০১৬ সালের জানুয়ারির শেষটায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। আমি তখন একাত্তর টেলিভিশনে। চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব শুরু থেকেই আমি পালন করি। সেদিনও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পাসিং আউট অনুষ্ঠান কভার করতে যাই প্রেসক্লাব থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি চেপে।

চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপি, মেয়র, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সেবাসংস্থার প্রধান, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও উপস্থিত অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে কম্পিউটার ও প্রযুক্তি বিষয়ক কিছু একটা উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন সেনানিবাসের ভেতরেই আরেকটি ভবনে। পরিমরি করে সবাই ছুটছেন প্রধানমন্ত্রীর পেছনে। ব্যতিক্রম শুধু নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। বলে রাখি, তাঁর আতিথেয়তা, খুনসুটি, দুষ্টুমি কিংবা রম্য বরাবরই আমার কাছে উপভোগ্য।

পিটিসি দিয়ে (প্যাকেজের শেষ অংশ) ঘাড় ফেরাতেই চোখ আটকে যায় প্রবীণ এ নেতার দিকে। অনুষ্ঠানের সময় যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই ঠাঁই বসে তিনি। আমি আর বাংলাভিশনের নাসির উদ্দিন তোতা এগিয়ে যেতেই বললেন, উজুর বসতক (হুজুর বসুন)।

যাননি কেন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন-পর্বে? বললেন- আঁই ঠেলাঠেলি গরিবার মানুষ ন বাজি, এই অভ্যেস আঁত্তে নাই। গঅত বলও নাই (আমি ঠেলাঠেলি করার মানুষ না বাবা, এই অভ্যাস আমার নাই। শরীরে শক্তিও এখন নাই)!

মানুষকে উদরপূর্তি করে খাওয়ানোয় অপরিসীম আনন্দ খোঁজা মানুষটাকে এবার ঠাট্টাচ্ছলে বললাম-উজুর অনর ঘরত ভাত হাইদে দেরি অইয়্যি। সাথে সাথে জবাব– হানারলাই মানা আছে না বাজি। হত্তে হাইবা? হালিয়া দুইরগে হ তইলি (খাবারে মানা আছে নাকি? কখন খাবে? কাল দুপুরে খাও তবে)। আমি আর তোতা ভালোবাসার আবেগে বলেই ফেললাম ঠিক আছে-হাইল্যে হাইয়ুম (কাল খাবো)। মনত গরি চলি আইবা কিন্তু, উঁয়ারে হাইয়ুম–চৌধুরীর চূড়ান্ত রিমাইন্ডার।

আমরা ভেবেছিলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমা হিলের লঙ্গরখানায় দিনে-রাতে কত শত মানুষই তো খায়। ব্যস্ততায় আমরা দুজন যেতে না পারলে কীবা হবে! চৌধুরীও হয়তো ভুলে যাবেন। কিন্তু না, আমরা ভুলে গেলেও তিনি ভোলেননি। অপেক্ষার কাঁটা ৩ টার ঘর অতিক্রম করতেই মোবাইল ফোন (০১৭৩…) থেকে চৌধুরীর কল–কীরে ওবা আঁই কি তোয়ার চর না, অসুখ্যে মানুষ উগগরে উয়াইস্যা বোয়াই রাইখ্যু দা কিইল্লাই (আমি তোমার চাকর নাকি, অসুস্থ মানুষ একটাকে অনাহারে বসিয়ে রাখলা কেন?) আহা, মহিউদ্দিন চৌধুরী!

এই পর্বত-শহরে জাতিধর্ম নির্বিশেষে লঙ্গরখানা একটাই ছিল– চশমাহিলের বাড়িটাই। সকাল থেকে মধ্যরাত- চলে সেই লঙ্গর কিংবা দরবারের খাবার। কত খেয়েছি আমিও! দিন নেই রাত নেই বাড়িটাতে গেলেই ‘এসো বসো আহারে’ মিলিত হওয়া একপ্রকার বাধ্যতামূলক। না হলে চৌধুরী রাগ করেন। গালমন্দও করেন কখনো-সখনো।

মাঠের সাংবাদিকতা করাকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন আতিথেয়তা দারুণ উপভোগ করতাম। যতই ব্যস্ততা, কাজের চাপ থাকুক মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রেস কনফারেন্স মিস করতাম না। তাঁর প্রেস কনফারেন্স মানে গরম গরম সংবাদ, সাথে রম্য কথার ঝাঁপি, খুনসুটি আর মেজবানি আহার, বাহারি ফলমুল, মিষ্টান্ন তো আছেই! আহা কী দারুণ স্মৃতি!

আচ্ছা, চশমাহিলের সেই লঙ্গরখানা কি আছে এখনো? মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রয়াণের পর আমার আর যাওয়াই হয়নি বাড়িটাতে! মানুষকে খাওয়াতে অসম্ভব রকমের আনন্দ-ভালোলাগায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা মানুষটার ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ওপারে অনেক ভালো থাকুন চাঁটগাবাসীর ভালোবাসার সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বীর মহিউদ্দিন…

লেখক: সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।