চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘জাতীয় নেতা-ভীতি’


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় পদ লাভে চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতাদের মধ্যে কোন ধরনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আগামী সম্মেলনে সভাপতি পদে আগ্রহ আছে আ জ ম নাছির উদ্দীনের। মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীও চান না কেন্দ্রীয় কোনো পদ!

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বর্তমান পদ ছেড়ে যেতে চান না কেন্দ্রীয় কমিটিতে! যদিও এক দশক ধরে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক পদে থাকা মফিজুর রহমান বলেছেন, এবার তিনি প্রার্থী নন। তাই কোথাও তিনি তদবির-লবিং করেননি। তবে দল যদি চায় এবং তাকে যোগ্য মনে করে তবে অবশ্যই তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।

অভিন্ন অবস্থানে আছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান; কেন্দ্রীয় নেতা হতে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই এ নেতাদের কেউই যেতে চান না কেন্দ্রীয় কমিটিতে। চট্টগ্রামের নেতা হওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজি অনেকেই। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা ঘিরে সেসব নেতা সক্রিয় থাকবেন, তাদের আগামী সম্মেলনে মূল্যায়ন করা হবে কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।

এই বার্তা পাওয়ার পর ‘পরীক্ষায় পাস’ করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন নেতারা। ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুনে চারপাশ ছেয়ে ফেলেন বিভিন্ন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীরা। পাশাপাশি বিপুল জনসমাগম ঘটিয়ে অনেকেই সেই পরীক্ষায় পাসও করেন। এসব কাজে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন চট্টগ্রামের নেতারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলের প্রবীণ নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাবেন, নবীনরা স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে আস্তে আস্তে পোক্ত হবে- এটাই রাজনীতির নিয়ম। কিন্তু ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে যখন কেউ উপরে যেতে চান না, একজন দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলে সৃষ্টি হয় না নতুন নেতৃত্বও। এ বিষয়টি রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘রাজনীতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন যেমন স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তেমনি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের রদবদলের প্রয়োজন আছে। যদিও স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে অনেকেই কেন্দ্রে সম্পৃক্ত হতে চান না। আবার কেউ কেউ অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি-প্রীতির কারণে কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও যান না।’

২০০৬ সালের ২৬ জুন কাউন্সিলের মাধ্যমে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি এবং কাজী ইনামুল হক দানুকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি ঘোষিত হয়েছিল। এরপর ২০১৩ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতেও সভাপতির দায়িত্ব পান মহিউদ্দিন চৌধুরী। নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চমক হিসেবে সাধারণ সম্পাদকের পদে আসেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ২০০৬ সালের আগে নগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনবার সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়া মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত হওয়াতেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম পদে বিবেচনা করা হয় তাকে। কেন্দ্র থেকেও এটি তাকে জানানো হয়েছিল। তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। ফলে তাকে কেন্দ্রীয় পদ দেওয়া হয়নি।

২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদে দায়িত্ব পালন করা প্রয়াত জহুর আহমদ চৌধুরীর সন্তান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার বার্তা পাঠান। যা পরবর্তীতে এম এ হান্নানসহ অনেকে প্রচার করেন।

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়; তবে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দলের জন্য যদি কিছু করতে চাইলে যেকোনো জায়গা থেকেই করা যায়। এম এ আজিজ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম এ মান্নান- ওনারা তো চট্টগ্রামে থেকেই রাজনীতি করেছেন, দলের জন্য কনট্রিবিউট করেছেন। আর চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। আমি এই জনপদের সন্তান, এখানের জন্য কিছু করতে পারাটা আমার জন্য গর্বের। আমি মনে করি ইচ্ছে থাকলে চট্টগ্রাম থেকেও দলের জন্য কাজ করা যায়। তবে নেত্রী যদি কেন্দ্রে আমাকে প্রয়োজন মনে করেন তাহলে আমি অবশ্যই তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নেব।’

শুধু মহানগর আওয়ামী লীগ নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যাপারে আগ্রহ নেই উত্তর কিংবা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদেরও। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত আকতারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে প্রায় ২৭ বছর ধরে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। ২০১২ সালে আকতারুজ্জামানের মৃত্যুর পর সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ওই পদে এক দশক ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সবমিলিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই পদে ঘুরে-ফিরে প্রায় চার দশক ছিলেন মোছলেম উদ্দিন। তারপরও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেতে আগ্রহ নেই তার। সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানও কমিটিতে স্থান পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চুপ।

এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নেত্রী আমাকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি করেছেন। এমপি মনোনয়নও দিয়েছেন। এজন্য আমি তাঁর কাছে সবসময়ই কৃতজ্ঞ। এই জনপদে প্রায় ৫৫ বছর রাজনীতি করেছি, এখন আসলেই কেন্দ্রে যাওয়ার কথা। এক্ষেত্রে নেত্রী যদি আমাদের কেন্দ্রে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন তাহলে নেবেন, জেলার দায়িত্ব দিতে চাইলে তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। যেখানেই রাজনীতি করি, দলের জন্যই তো করবো। নেত্রীর প্রতি, দলের প্রতি আমার আনুগত্য আছে, থাকবে।’

উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে আছেন এমএ সালাম। ২২ বছর ধরে উত্তর জেলার সভাপতি পদে থাকা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে অনেকটা জোর করেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বানানোর পর ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট সভাপতির দায়িত্ব পান নুরুল আলম চৌধুরী। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন উত্তর জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তার সঙ্গে সম্পাদক ছিলেন এমএ সালাম।

এরপর সম্মেলনের ১৫ মাসের মাথায় ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এম এ সালামকে সভাপতি ও আতাউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ৭৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।

বর্তমান পদ নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা, কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার আগ্রহ আছে কিনা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি এমএ সালাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নেত্রী আমাকে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করেছেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং প্রশাসকও করেছেন। আমার চাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি দিয়েছেন। আর কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ তাঁর নির্দেশনার উপর নির্ভর করছে। তিনি যদি মনে করেন আমাকে কেন্দ্রে প্রয়োজন আছে তাহলে আমি অবশ্যই তার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবো। যেহেতু একটা জায়গায় আছি, এখন যদি কেন্দ্রের রাজনীতি করতে চাই, অনেকে সমালোচনাও করতে পারেন। আমি এই সমালোচনায় পড়তে চাই না।’