দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কি পরিবর্তন আসছে?


একুশে প্রতিবেদক : দীর্ঘ ১৭ বছর পর আগামি সোমবার (১২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন। সেই সম্মেলনে কে হচ্ছেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক – তা-ই এখন আগ্রহ ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু সংশ্লিষ্ট মহলে।

নানা বিচারে চলমান নেতৃত্বের বিপরীতে এবার তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চাইছেন সময়োপযোগী যোগ্য নেতৃত্ব, রাজনীতির মাঠে যাদের আছে অপরিসীম ত্যাগ ও আদর্শিক ভিত্তি। যে নেতৃত্ব নিজেদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ছাপিয়ে সামনের কঠিন, অমসৃণ সময়েও দলকে নিয়ে যেতে পারবে প্রত্যাশিত ঠিকানায়।

সর্বশেষ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল ২০০৫ সালের ২৩ জুলাই। ওই সম্মেলনে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে সভাপতি ও মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রয়াত হলে ২০১৩ এর শুরুতে মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয় কেন্দ্র থেকে। পরবর্তীতে তারাই দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেন।

অভিযোগ রয়েছে, গত এক দশকে সংগঠন গোছাতে না পারলেও দল টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নিজেদের বেশ গুছিয়ে নিয়েছেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে অনৈতিকতার আশ্রয়, নয়ছয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি গঠনে বাণিজ্য-বেসাতির বহু অভিযোগ বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শারজাহ কমিটি, দুবাই কমিটি গঠনের মতো যুগপৎ কর্মকাণ্ডও ঘটেছে বর্তমান কমিটির আমলে।

জানা যায়, গত ১০ বছরে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোও করার গরজ মনে করেনি বর্তমান কমিটি। ফলে সৃষ্ট নেতৃত্বজটে সম্ভাবনাময় মেধাবী নেতৃত্বের বিকাশ যেমন হয়নি, একইভাবে জেলা-উপজেলায় হতাশা, গ্রুপিং ও সংঘাতের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।

বর্তমান সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এমপির বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গত ১০ বছরে নিজের উপজেলায়ও সম্মেলন করতে পারেননি তিনি। সম্মেলন করতে পারেননি বাঁশখালী উপজেলায়। এই দুটি উপজেলায় সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল যথাক্রমে ২৪ ও ২২ বছর আগে। সম্প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশনায় এই দুটি উপজেলায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও সম্মেলনে বিশৃংখলা, হাতাহাতি ও গ্রুপিং ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দৃষ্টিকটু বিষয়গুলোতে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন।

এসব কারণে আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্বের বিপরীতে গণমুখী, আদর্শিক নেতৃত্বের আওয়াজ তুলেছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের একাধিক নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেছেন, সন্ধ্যার পর বেহুশ হয়ে যাওয়া এবং নারীরা নিরাপদ নয় এমন নেতৃত্ব আমরা আর চাই না। যাদের কোনো ন্যূনতম আদর্শিক ভিত্তি নেই, দল ও জনমানুষের জন্য নেই কোনো কমিটমেন্ট, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পদ-পদবির বাণিজ্য হয়– আগামিতে অন্তত তাদের পেছনে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আর রাজনীতি করবেন না।

চট্টগ্রাম মহানগর ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির দিকে তাকালে দেখা যায়, কমিটিতে বিভিন্ন পদে অন্তর্ভুক্ত অন্তত এক-তৃতীয়াংশই ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতা। সেই তুলনায় ২-৩ জন ছাড়া দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের সংখ্যা নগণ্য। আসন্ন কমিটিতে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগে একসময় ডাকসাইটে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরা জায়গা পাবেন বলে আশা করছে তৃণমূল।

তৃণমূলের আশার মেলবন্ধন ঘটাতে সাধারণ সম্পাদক পদে এবার ডজনেরও বেশি প্রাক্তন ছাত্রনেতা আলোচনায় এগিয়ে আছেন। এরা হলেন দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (৮২-৮৩) সাংবাদিক আবু সুফিয়ান, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি (‘৯৩-৯৫) দুঃসময়ের কর্মী, ছাত্ররাজনীতির সময় কারানির্যাতিত, অপহরণের শিকার পটিয়া পৌর মেয়র মোহাম্মদ আইয়ুব বাবুল, প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দিন, প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ দাশ, বিজিএমই’র প্রাক্তন প্রথম সহ সভাপতি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কর্মী শিল্পপতি মোহাম্মদ নাছির ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি আবদুল কাদের সুজন।

দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, আসন্ন কমিটিতে আমি নিজেকে প্রত্যাশা করছি। একসময় এই জনপদে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছি আর এখন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। দীর্ঘ ১০ বছর পর সম্মেলন হচ্ছে, নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই দলে নতুন নেতৃত্ব চায়। কাউন্সিলর ভোট কিংবা নেত্রীর ইচ্ছা যেকোনো ভাবেই নেতৃত্ব নির্ধারণ হতে পারে। কাউন্সিলর ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচন হলে সংগঠন শক্তিশালী হয়। তবে নেতৃত্ব নির্বাচন কিংবা আদৌও নেতৃত্ব পরিবর্তন হবে কি, হবে না এটা সম্পূর্ণ নেত্রীর সিদ্ধান্ত। নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’

সাধারণ সম্পাদক পদ-প্রত্যাশি পটিয়া পৌর মেয়র মোহাম্মদ আইয়ুব বাবুল বলেন, ‘দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় সাবেক ছাত্রনেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তারা পদবঞ্চিত থেকে গেছেন। কিন্তু আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার মত ঘটনা ঘটেছে। এবারের সম্মেলনেও যদি এমনটা হয়ে থাকে তা দলের জন্য কিংবা দক্ষিণের রাজনীতির জন্য সুখকর হবে না। আমি মনে করি বাণিজ্যিক কমিটির পরিবর্তে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দক্ষিণের জনপদে যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করা হলে সংগঠন শক্তিশালী হবে, দল উপকৃত হবে।’

বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দিন বলেন, ‘মনোবাসনা তো সকলেরই থাকে, আমারও আছে। যারা এবার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে ইচ্ছুক তাদের সকলেরই দলের জন্য কনট্রিবিউশন আছে। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সবই জানেন। দলের নেতৃত্ব কে দিবে তা একমাত্র নেত্রীর সিদ্ধান্তে নির্ধারণ করা হয়। আমার সকল চাওয়া-পাওয়াও নেত্রীকে ঘিরে। আমি সবসময়ই আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সততা-নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চেষ্টা করেছি। দলকে ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। বাকিটা নেত্রীর সিদ্ধান্ত।’

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ দাশ বলেন, ‘চিরাচরিতভাবে পদপ্রত্যাশা করা এবং পদের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। এতটুকু বলতে পারি আসন্ন কমিটিতে পদপ্রার্থীদের মধ্যে যোগ্যতার মাপকাঠিতে আমি সবার চেয়ে এগিয়ে আছি। বিগত সময়ে আমি এজন্য সিরিয়াসলি কাজও করেছি। যদি পরিবর্তন আসে, আমি নিজের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’

অন্যদিকে, বর্তমান সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ ছাড়াও সভাপতি পদে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য, সাবেক ছাত্রনেতা নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, বাবুপুত্র ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জান চৌধুরী জাবেদ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, কুয়েতের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ।

সূত্র মতে, সার্বিক বিচারে এবারের সম্মেলনে শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তন অনেকটাই আসন্ন। ৭৫ বছর বয়সী, অসুস্থ মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে নতুন সভাপতি করা এবার সময়ের দাবি। যদি তাই হয়, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের মেম্বার করা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।

আর মফিজুর রহমানকে সরানো হলে তার জায়গা হতে পারে দক্ষিণের সিনিয়র সহ সভাপতি পদে। যদিও মফিজুর রহমান আসন্ন সম্মেলনে প্রার্থী নন বলে ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। তিনি বলেছেন, এবার তিনি প্রার্থী নন। তাই কোথাও তিনি তদবির-লবিং করেননি। তবে দল যদি চায় এবং তাকে যোগ্য মনে করে তবে অবশ্যই তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।

সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় সম্মেলন সামনে রেখে দেশব্যাপী জেলা ইউনিটগুলোর সম্মেলন চলছে মাসব্যাপী। সম্মেলনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আগের কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে বহাল রাখতে। জানা গেছে, সামনে নির্বাচন, অপেক্ষা করছে দলের জন্য কঠিন সময়। এই অবস্থায় নেতৃত্বে পরিবর্তন এনে নতুন করে গ্রুপিং, কলহ তৈরি করতে রাজি নয় কেন্দ্র। কিন্তু যেখানে পরিবর্তন অপরিহার্য, সেখানে পরিবর্তন না এনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, হতাশা ও ধুমায়িত অসন্তোষও বাড়তে দিতে চায় না হাইকমান্ড। এই অবস্থায় দক্ষিণ জেলা ইস্যুতে কী সিদ্ধান্ত আসছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

তবে তড়িঘড়ি করে সম্মেলনের দিন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা না দিয়ে অন্তত এক সপ্তাহ সময় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।