আবদুচ ছালাম : উন্নয়নে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্রতা হ্রাস করে উন্নয়নে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অবদানেই সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা আর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এনেছেন উন্নয়ন। শেখ হাসিনার দুরদর্শী নেতৃত্ব, লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পরিকল্পনা, সাহসিকতা ও দৃঢ়তা আজ বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রধান মার্শি টেম্বন বলেছেন, ‘যখন আমরা বাংলাদেশে কাজ শুরু করি, বাংলাদেশ তখন ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ)-এর একটি নবীন সদস্য ছিল। আমরা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে অনেক কিছু শিখেছি। এই সম্পর্ককে অনেক দূর নিয়ে গেছি, বাংলাদেশ সফল হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞান অন্য অনেক দেশে দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করেছে।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। মাত্র ৫০বছর বয়সে বাংলাদেশ দারিদ্র্যতা কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে মানুষের ভাগ্য বদলাতে একে বড় অর্জন বলে উল্লেখ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা এখন সবার নাগালে। লাখো নারী কর্ম ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের বিষয়ে দারুণ অগ্রগতি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন অনেক দক্ষ। বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অনেক কিছু।
এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ। শিল্প ও সেবা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, অবকাঠামোসহ অন্য খাতেও হয়েছে বড় বিনিয়োগ। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং অন্যসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন অনেকটাই প্রস্তুত বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের অর্থনীতি মজবুত একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান তৈরির ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতসব অর্জনের প্রায় সবটুকুই এসেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে এ হার কমে এসেছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৪৪.২ হাজার কোটি টাকা। নানান চড়াই উৎড়াই এর পরও শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। দেশের সর্বমোট রপ্তানী বাণিজ্যেও প্রায় ৭৫ভাগ সংঘটিত হয় চট্টগ্রামের উপর দিয়ে। অন্যদিকে আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ হার ৮০ ভাগ। অর্থাৎ চট্টগ্রাম হল, দেশের অর্থনৈতিক সঞ্চালনের জীবনী শক্তি। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নকে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিয়েছে। এই দেশ যতদিন থাকবে অনেক প্রধানমন্ত্রী আসবেন, অনেক প্রধানমন্ত্রী যাবেন, কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার মত চট্টলদরদী প্রধানমন্ত্রী আর পাওয়া যাবেনা।
আমি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে যে কোন প্রজেক্ট নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছি, কখনোই তিনি না করেননি। তার হাত ধরে অবহেলিত চট্টগ্রাম আজ কেবল বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম নান্দনিক ও সমৃদ্ধ শহর হতে চলেছে। শুধু শহর নয়, সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ।
কর্ণফুলীর তলদেশে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকায় নির্মিত হয়েছে দুই টিউব বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু টানেল, যার একটি টিউব ২৬নভেম্বর ২০২২, শনিবার ভানচুয়ালি সংযুক্ত হয়ে উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অর্থায়নে নির্মান হচ্ছে দোহাজারী-কক্সবাজার- ঘুনধুন পর্যন্ত রেলপথ। মাতারবাড়ীতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। বাঁশখালীর ও মাতারবাড়িতে হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, আনোয়ারা ও মিরসরাইয়ে দুটি ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন।
এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে সবচেয়ে বেশী উন্নয়ন সম্পাদিত হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। বাস্তবায়িত প্রকল্পের মধ্যে বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভার, বায়েজিদ-মুরাদপুর-লালখান বাজার আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার, স্টেশন রোড-দেওয়ান হাট ওভারপাস, পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট মেরিন ড্রাইভ আউটার সিটি রিং রোড, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের আধুনিকায়ন, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট বাইপাস রোড অন্যতম।
এছাড়াও অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যার মধ্যে বিমান বন্দর হতে লালখান বাজার পর্যন্ত ১৬কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, প্রায় ৯হাজার কোটি টাকার খাল খনন, সংস্কার ও পুনরুদ্ধার করে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প, চাক্তাই হতে কালুরঘাট পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার রিভার ড্রাইভ রিং রোড, ১২টি খালের মুখে শক্তিশালী পাম্পসহ অটোমেটিক টাইডাল রেগুলেটর স্লুইস গেইট নির্মান কাজ অন্যতম। এছাড়াও অনেক পুরানো সংকীর্ণ সড়ক সংস্কার, প্রশস্তকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন সড়ক নির্মাণ কাজ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া হতে চাক্তাই খাল খনন প্রকল্প।
ওয়াসার মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর মধ্যে মদুনাঘাট পানি শোধনাগার, রাঙ্গুনিয়ায় শেখ রাসেল পানি শোধনাগার ও শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার অন্যতম। তাছাড়া সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রামে সড়ক ও সেতু বিভাগ, সওজ, এলজিইআরডি ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পাদিত, চলমান অবকাঠামোগত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বদলে দিচ্ছে পুরো চট্টগ্রামকে। তাঁরই নির্দেশনায় চট্টগ্রামে মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এজন্যই আমি বার বার বলেছি, ‘শেখ হাসিনার অবদান, উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম।’ তাঁরই ঐকান্তিকতায় চট্টগ্রাম আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকলে চট্টগ্রামের উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা কখনোই থামবেনা। বিশ্বকে চমকে দেয়া বাংলাদেশ দিয়েই শুরু করেছিলাম আমার এ লেখনী। সেদিক বিবেচনায় এ কথা না বললেই নয় যে, দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকারের দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ২০০৯-২০১৮ সময়কালে গড়ে ৬.৪৫ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে থমকে দাঁড়ায় বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছিল। মহামারীর ধাক্কা সামলে নিয়ে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ সময় মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় আবারও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে থাকলেও চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে আভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নত আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বর্ধিত জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০নিয়ে অদম্য গতিতে চলতে চায় বাংলাদেশ। সবশেষে আমার হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস থেকে বলতে চাই, “যতদিন শেখ হাসিনার হাতে থাকবে দেশ, পথ হারাবেনা বাংলাদেশ”।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কোষাধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।