এম কে মনির : প্রতিষ্ঠার প্রায় ২ যুগেও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর রউফাবাদে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে (আইএমআরসি)। বছরের পর বছর অর্ধেকের কম জনবল দিয়েই চলছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোনো মানসিক চিকিৎসক। এমনকি নার্সও নেই।
ফলে ব্যাহত হচ্ছে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসা কার্যক্রম। অন্যদিকে ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণ বাসিন্দা, জনবল সংকট, আর্থিক দৈন্যতায় সঠিক পরিচর্যা ও শতভাগ চিকিৎসা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত এ প্রতিষ্ঠানটির এখন বেহাল দশা।
মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে রয়েছে একটি চারতলা অফিস ও স্কুল ভবন, বালক-বালিকাদের জন্য দুটি দোতলা ভবনের হোস্টেল। এ দুই হোস্টেলে বর্তমানে থাকছেন মোট ১৮৮ জন মানসিক প্রতিবন্ধী। যা ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণ। বাসিন্দাদের মধ্যে ৭৬ জন বালিকা ও ১১২ জন বালক রয়েছেন। তবে এ প্রতিষ্ঠানটি মৃদু প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য হলেও বর্তমানে এখানে প্রায় ২৫ জন বয়স্ক মানসিক ও শারীরিক পূর্ণ প্রতিবন্ধী রয়েছেন। বছরের পর বছর এখানে থাকা মানসিক প্রতিবন্ধী অনেক শিশু ও বয়স্কদের পরিবারের খোঁজও মিলছে না।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ১৯৯৬-১৯৯৯ সালে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পে হাটহাজারীর রউফাবাদে অবস্থিত ছোটমণি নিবাসের জায়গায় মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী মৃদু প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন করা। যাতে তারা সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে। কিন্তু ২ যুগে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে ঠিকানাবিহীন মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয়কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। শিশুদের প্রতিষ্ঠান হলেও প্রাপ্তবয়স্ক অনেক মানসিক প্রতিবন্ধী এখন এই প্রতিষ্ঠানের বাসিন্দা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অফিস ভবনের পেছনে দুটি দোতলা ভবনের অবস্থান। যেখানে প্রতিটিতে ৬টি করে কক্ষ রয়েছে। এসব কক্ষের মোট ধারণক্ষমতা ২৫ জন বালক ও ২৫ জন বালিকা হিসেবে মোট ৫০ জনের। পরবর্তীতে ধারণ ক্ষমতার সংখ্যা বাড়িয়ে ৭৫ এ উন্নীত করা হয়। তবে বর্তমানে এখানকার বাসিন্দা ১৮৮ জনে ঠেকেছে।
এখানে থাকা মানসিক প্রতিবন্ধীদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। যারা শারীরিক, মাসনিক, স্নায়ু, বুদ্ধি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আবার কেউ কেউ অটিজম আক্রান্ত (বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু)। তন্মধ্যে ১২ জন ছেলে ও ১২ জন মেয়েসহ মোট ২৪ জন সেলিব্রাল পলসি প্রতিবন্ধী, ৪১ জন ছেলে ও ২১ জন মেয়েসহ মোট ৬২ জন অটিজম শিশু, ৪৯ জন ছেলে ও ৩৯ জন মেয়েসহ মোট ৮৮ জন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, ৬ জন ছেলে ও ২ মেয়েসহ মোট ৮ জন ডাউন সিনড্রমে আক্রান্ত, ৪ জন ছেলে ও ২ জন মেয়েসহ ৮ মুখ বধির।
বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণ বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিষ্ঠানের দুটি ভবনের হোস্টেলে প্রতিবন্ধীদের থাকতে হচ্ছে গাদাগাদি করে। তাদের কেউ কেউ শারীরিকভাবে পূর্ণ প্যারালাইজড। যারা বিছানা থেকে নড়াচড়া করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। তারা শৌচাগার ব্যবহার, গোসল, হাত মুখ ধোয়া, খাওয়া-দাওয়া, জামা-কাপড় পরিধান করতে সক্ষম নয়। এমনকি অনেকেই বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ সারাদিন না খেয়ে ফ্লোরেই শুয়ে থাকেন। কারো সাথে কথা বলেন না, কথা বললেও হঠাৎ রেগে ওঠেন।
মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের অনেকেই জেদি স্বভাবের। তাদের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুয়েকজন এমন আছেন তারা যা চায় তাই দিতে হয়। ধরা যাক, রাতের ডিনারে প্রত্যেক শিশুর জন্য এক টুকরো করে মাংস বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু অনেক শিশু এতোটাই জেদি তাদেরকে ১০ টুকরো মাংস দিতে হবে। অন্যথায় তারা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে রেগে ফেটে পড়বেন। এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ হিমশিম খেতে হয় কর্মকর্তাদের। বিশেষ করে আয়া না থাকায় বিছানায় যারা মলমূত্র ত্যাগ করেন তাদের দেখাশোনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ ২ যুগ ধরে এ প্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোন সরকারি নার্স। বর্তমানে বেসরকারি ভিত্তিতে ১২ জন আয়া দিয়ে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সেবা কার্যক্রম। যা সংখ্যার তুলনায় একবারেই অপ্রতুল। ২০০০ সালে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি প্রতিবন্ধীদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক সাইকোথেরাপিস্ট।
শুধু তাই নয়, প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক ইনডোর চিকিৎসকও নেই। এমনকি এ প্রতিষ্ঠানে নার্স, ঝাড়ুদার, নিরাপত্তা প্রহরীসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদ এখনো শূন্য। এ প্রতিষ্ঠানের মোট প্রাতিষ্ঠানিক জনবল ২৭ জন হলেও বর্তমানে এখানে কর্মরত আছেন মাত্র ১২ জন। ২ জন ফিজিওথেরাপিস্টের স্থলে আছেন ১ জন, ১ জন নার্স, ২ জন ঝাড়ুদার, ২ জন নিরাপত্তা প্রহরী থাকার কথা থাকলেও দীর্ঘ দিন পদগুলো শূন্যই রয়ে গেছে। এছাড়াও দপ্তরের চিঠিপত্র বিলির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জনবলে ১ জন বার্তা বাহকের পদ উল্লেখ থাকলেও সেটিও শূন্য।
৫ জন অফিস সহায়কের স্থলে ৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন আগে ৩ জন অন্যত্র বদলি হলে সেই সংখ্যা এখন ১ জনে নেমেছে। স্পিচথেরাপিস্ট ১ জন কর্মরত আছেন। যাকে আবার অন্যান্য দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। এভাবেই জনবল সংকটে চিকিৎসা কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি ধারণ ক্ষমতার ৩ গুণ বাসিন্দা হওয়ায় বাসস্থানের সংকুলান হচ্ছে না।
পর্যাপ্ত আয়া না থাকায় প্রতিষ্ঠান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন করে ভবনের প্রয়োজন হলেও তা নির্মাণ না করায় সঠিক পরিচর্যা, সেবা-শুশ্রূষা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে এখানে কর্মরতদের। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মাইক্রোবাসটি পুরনো ও জরাজীর্ণ। প্রায় সময় মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের দেশের বিভিন্ন স্থানে আদালতের মামলায় হাজিরা দিতে ও হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যেতে হয়। পুরনো, জরাজীর্ণ গাড়িতে যা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ফিজিওথেরাপিস্ট মোহাম্মদ এনামুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, বারবার প্রতিষ্ঠান থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে জনবল নিয়োগের চাহিদা পাঠানো হলেও এখনো পর্যন্ত নিয়োগ দূরের কথা উল্টো বদলি হয়ে জনবল কমছে। এখানে নিয়োগ না দেয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে অন্যান্য দপ্তরে পদায়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানের বেশ অমিল। এ ধরণের প্রতিষ্ঠান আর নেই। ফলে এখানে নিয়োগ দেয়া সহজ নয়।
তিনি আরও বলেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি বাসিন্দা আমাদের রাখতে হচ্ছে। কেননা চারদিক থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের এখানে পাঠানো হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠান মূলত মৃদু প্রতিবন্ধীদের জন্য করা হলেও এখন এখানে সিরিয়াস প্রতিবন্ধীও রয়েছে। অথচ পূর্ণ জনবল নেই। এখানকার কাজগুলো সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
জানতে চাইলে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ (উপ-পরিচালক) আবুল কাশেম একুশে পত্রিকাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ১০ জনের জন্য একজন হারে আয়া নিয়োগ আবশ্যক। জরুরি ভিত্তিতে আয়া নিয়োগ করা না হলে প্রতিবন্ধীদের পরিচর্যা হুমকিতে পড়বে। কেননা এখানকার বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী। এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য একজন এনডিডি, শিশু নিউরোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসক প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানলগ্ন থেকে নার্স পদটি শূন্য। জরুরি ভিত্তিতে নার্স নিয়োগ প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, দেশের নানা স্থান থেকে আদালতের আদেশে বাসিন্দা আসা অব্যাহত আছে। নতুন হোস্টেল ভবন প্রয়োজন। একই ক্যাম্পাসে ৩টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান হওয়ায় নিরাপত্তা প্রহরী বাড়ানো আবশ্যক। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের ভর্তি ও হাজিরা সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। শিশুদের আদালত, হাসপাতাল, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, বিনোদন স্পটে নেয়ার জন্য নতুন যানবাহন প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের সড়ক কার্পেটিং জরুরি। এসব সমস্যা দূর হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের নির্বিঘ্নে সেবা দেয়ার পথ সুগম হবে। সেই সাথে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম গতিশীল করা সম্ভব হবে।