এম কে মনির : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আকিলপুরে পরিবেশকে হুমকিতে ফেলে ফের সমুদ্র উপকূল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু করেছে মাদার স্টিল শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে সাগরে ইয়ার্ডটির কয়েকটি শক্তিশালী ড্রেজার চষে বেড়াচ্ছে।
বালু উত্তোলনের জন্য বেড়িবাঁধ কেটে কয়েক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোটা পাইপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে ওই এলাকায় বসানো হয়েছে সন্ত্রাসী পাহারা। থেমে থেমে দিনে ও রাতে পালাক্রমে বালু উত্তোলন করছে তারা।
আর উত্তোলিত বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন একটি পুকুর। এতে পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে পড়ে সমুদ্র উপকূলে গভীর খাদের সৃষ্টি হচ্ছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে বেড়িবাঁধে। খসে পড়ছে শত কোটি টাকায় নির্মাণ করা বেড়িবাঁধের হাজার হাজার ব্লক। অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় আকিলপুর সমুদ্র সৈকত।
বালুর পানি গ্রামের কৃষি জমি ও বাড়ি ঘরে গড়িয়ে ফসল, গাছপালা, গবাদিপশু ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই এসব কাজ অব্যাহত আছে।
অভিযোগ ওঠেছে, মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিতে সমুদ্র উপকূল থেকে মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডকে বালু উত্তোলন করে দিচ্ছেন একজন ইউপি চেয়ারম্যান। তার মালিকানাধীন ড্রেজার দিয়েই সাগর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
বালু উত্তোলনের পাইপ স্থাপন করতে আকিলপুর এলাকায় বেড়িবাঁধের বিশাল অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। বালু উত্তোলনের পর জমা হওয়া বালুযুক্ত পানি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে ফসলি জমিতে, মানুষের বাড়িঘরে। এতে ফসল, গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আকিলপুর সমুদ্র সৈকত এলাকায় সাগরে বালু উত্তোলনের কয়েকটি শক্তিশালী ড্রেজার চষে বেড়াচ্ছে। ৭-৮ জন শ্রমিক বেড়িবাঁধ কাটা ও পাইপ স্থাপনের কাজ করছে। উত্তোলন করা বালু দিয়ে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন মাদার স্টিল শিপ ইয়ার্ডের একটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওই পুকুরের ৪০ শতাংশ বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে।
আরও বড় আকারে বালু উত্তোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বসানো হয়েছে একাধিক পাইপ। এসময় সাংবাদিক, প্রশাসনসহ বালু উত্তোলনে বাধা হতে পারে এমন কারও প্রবেশ ও তৎপরতা ঠেকাতে বেড়িবাঁধ এলাকায় পাহারাদার দলের সদস্যদের দেখা গেছে। বালু উত্তোলনের এলাকায় কেউ প্রবেশ করলেই কয়েকজন ব্যক্তি মুঠোফোনে ছবি ধারণ করার চেষ্টা করছেন। একইভাবে এ বালু উত্তোলনের দৃশ্য ধারণ করতে গেলে এ প্রতিবেদকের ছবি তুলে নেন কয়েকজন অজ্ঞাত মুখোশধারী ব্যক্তি। এসময় তাদের কাছে পরিচয় জানতে চাইলে তারা দ্রুত সরে পড়েন।
স্থানীয়রা জানায়, নভেম্বর মাসের শুরুতে সাগর থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। পরে বালুর পানি আশেপাশের কৃষি জমিতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে ফসল, গাছপালা যেমন নষ্ট হচ্ছে। তেমনি গবাদিপশুর বিচরণ স্থান অনুপযোগী হয়ে ওঠছে। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে বলেন, একজন ইউপি চেয়ারম্যানের তত্ত্ববধায়নে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। চেয়ারম্যান জড়িত থাকায় কেউ ভয়ে মুখ খুলছেন না। বেড়িবাঁধ এলাকায় বসানো হয়েছে সন্ত্রাসী পাহারা। যারা মানুষের গতিবিধি অনুসরণ করছে। অনেক সময় সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদেরও হয়রানি করছে তারা। স্থানীয়দের স্বাভাবিক চলাফেরায় বাধা দেয়া হচ্ছে।
একই কথা বলেন, আকিলপুরের কৃষক মো. আলী। তিনি বলেন, বালুর পানি কৃষি জমিতে ছেড়ে দেয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। উৎপাদিত ফসল মরে যাচ্ছে। চেয়ারম্যানের লোকেরা এসব করায় কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া মাস্টার আবুল কাশেমও অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক। এলাকার কেউ সহজে তার সাথে ঝামেলায় জড়ান না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আকিলপুরের আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হয়ে বালু উত্তোলন বন্ধে সহযোগিতা করার কথা থাকলেও ওই চেয়ারম্যান এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে বালু উত্তোলনই তার প্রধান ব্যবসা। বসুন্ধরা গ্রুপকে বালু উত্তোলন করে দিয়ে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন। এলাকায় তিনি বালু খেকো চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিত।
জানতে চাইলে মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডের মালিক মাস্টার আবুল কাশেম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় আমাদেরকে বালু উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে। জাহাজ ভিড়াতে নাব্যতা প্রয়োজন হয়। তাই বালু উত্তোলন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। অথচ দেশের অর্থনৈতিক কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে পুরাতন জাহাজ আমদানি বন্ধ রয়েছে।’ এসময় কোন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে ও সেই অনুমোদনের লিখিত অনুলিপি চাইলে তিনি সুর পাল্টে ফেলে বলেন, ‘ওটা মৌখিক অনুমতি ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি তো আমাদের আছেই। শিপইয়ার্ড বালু উত্তোলন করতে পারবে। আমি অফিসের বাইরে আছি। আপনার সঙ্গে পরে আলাপ করব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীর একুশে পত্রিকাকে বলেন, ড্রেজারগুলো আমার নয়, আমার ভাইয়ের। আমাদের বালু উত্তোলনের অনুমোদন আছে। অনুমোদন নিয়েই আমরা বালু উত্তোলন করছি। আর বালু উত্তোলনের ফলে কারও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তাছাড়া বালু উত্তোলন করা হচ্ছে শিপইয়ার্ড এলাকা থেকে। সেখান থেকে বালু উত্তোলন করা যায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে আপনি তথ্য চাইছেন, এটি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানাব।’ এসময় এ প্রতিবেদকের তথ্য চাওয়ার সঙ্গে অন্য সাংবাদিকদের কী সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, আপনাকে বালু উত্তোলনের অনুমোদন আছে সেটার ডকুমেন্টস পাঠাচ্ছি।’ যদিও তিনি পরবর্তীতে কোন কাগজপত্র এ প্রতিবেদককে প্রেরণ করেননি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বালু উত্তোলনের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা দ্রুত অভিযান পরিচালনা করব। পরিবেশের ক্ষতি করে সমুদ্রের তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমরা সীতাকুণ্ডে কাউকে বালু উত্তোলনের অনুমোদন দিইনি।’
প্রসঙ্গত, এর আগে সমুদ্র উপকূল থেকে কয়েক লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করেন মাদার স্টিল শিপইয়ার্ডের মালিক মাস্টার আবুল কাশেম। এ নিয়ে গত বছর তার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দায়ের করে।