একুশে প্রতিবেদক : দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি থেকে শিক্ষা নিতে চায় কেন্দ্র। শুধরে নিতে চায় ভুলগুলো। তাই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের কমিটি চূড়ান্ত করেও এখনই ঘোষণা করতে চাইছে না কেন্দ্র। সেইসাথে মহানগর কমিটিও সন্তর্পণে, আরও ভেবেচিন্তে করতে চায় তারা। এসব কারণে আগামি ৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার আগে চট্টগ্রাম উত্তর ও মহানগর যুবলীগের কমিটি ঘোষণা না করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সংশ্লিষ্ট সূত্রে মিলেছে এই তথ্য।
এর আগে গত ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি ঘোষণার পরপরই শুরু হয় টর্নেডো। আঁচড়ে পড়ে একের পর এক ক্ষোভ-বিক্ষোভ। কমিটি ঘোষণার দুই ঘণ্টার মাথায় পদত্যাগ করেন সভাপতি পদে সিভি জমা দেওয়া বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক পার্থ সারথী চৌধুরী। নতুন কমিটিতে তাকে ২ নং সহ সভাপতি করা হয়েছিল।
একইভাবে পরদিন পদত্যাগ করেন ঘোষিত কমিটির সিনিয়র সহ সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক। দুর্দিন-দুঃসময়ে সংগঠনের হাল ধরা মোহাম্মদ ফারুক চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিও লিখেন তিনি। তাতে তাকে টাকার বিনিময়ে নেতৃত্ব কিনতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। জানিয়েছেন এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হলে কমিটির কাছে তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরার কথা।
অন্যদিকে, গত রোববার পদত্যাগ করেন নতুন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নাসির উদ্দিন মিন্টু। অবশ্য তার পদত্যাগের কারণ ভিন্ন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহ সম্পাদক মিন্টুকে দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক করতে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা।
জানা গেছে, নানা চেষ্টার পরও সেই পদে মিন্টুকে আনতে পারেননি তিনি। মিন্টু ভেবেছিলেন জেলা কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদকের পদ ছাড়বেন। কিন্তু তার পাওয়া যুগ্ম সম্পাদক পদ অনেকটাই অবনমনের মতো। কেন্দ্রীয় সহ সম্পাদকের পদ ওই পদের চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট পদটিই ছাড়লেন তিনি।
ক্ষোভ-বিক্ষোভের আছে আরও কারণ। ঘোষিত কমিটিতে শীর্ষ দুই পদসহ ৬ জনই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এর মধ্যে সভাপতি দিদারুল ইসলাম দিদার কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘদিন তিনি প্রবাসে ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহুর বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র। তার গায়ে জাতীয়তাবাদী গন্ধ কিংবা তকমারও অভিযোগ আছে।
এছাড়া সহ সভাপতি মর্তুজা কামাল মুন্সি পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সহ সভাপতি মাঈনু উদ্দিন চৌধুরী পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, সহ সভাপতি পদ পেয়েছেন চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. তৌহিদুল ইসলাম। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বেলাল হোসেন মিঠু ও সদস্য পদ পেয়েছেন পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল হান্নান লিটন।
শুধু তাই নয়, সভাপতি পদে সিভি জমা দেওয়া ব্যক্তি হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদ থেকে সিভি প্রত্যাহার করা ব্যক্তি পেয়েছেন সভাপতি পদ। নতুন সাধারণ সম্পাদক জহুর নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সিভি জমা না দিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে বিশেষ বিবেচনায় সিভি জমা দিয়েছেন বলে জনশ্রুতি আছে।
এদিকে, ৩৫ জনের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বিদেশে অবস্থান করা লোকজনও। সবমিলিয়ে এই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে যে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যুব সংগঠকের কি এতই আকাল পড়েছে যে, আওয়ামী লীগের পদধারী ও প্রবাসে থাকা লোকজন দিয়ে কমিটি ভরাতে হবে?
বিক্ষুব্ধরা বলছেন, আমরা আশা করেছিলাম ২৮ মে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হবে। কিন্তু নেতারা উৎসব করে চলে গেলেন, কমিটি করলেন না। পরবর্তীতে আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সময়োপযোগী কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস পর যে কমিটি দেওয়া হলো তা আমাদের হতাশ করেছে। এ যেন মানবিক যুবলীগের নামে অমানবিক ব্যাপার! এই কমিটি হওয়ার পর একটা আনন্দ মিছিল পর্যন্ত হয়নি। বরং সর্বত্র বিক্ষোভের ঢেউ আঁচড়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে উত্তর জেলা ও নগরের কমিটি নিয়ে সতর্কভাবে এগোতে চায় কেন্দ্র। ফলে ঘোষণার শেষ মুহূর্তে এসে আটকে গেলো কমিটি। জানা গেছে, এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও করেছে যুবলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রয়োজনে কমিটি ঘোষণার আগে বার বার যাচাইবাছাই ও চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। হতে পারে সংযোজন-বিয়োজন। মোদ্দাকথা, আর কোনো বিতর্ক চান না তারা। এমনটাই জানাচ্ছে সূত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উত্তর জেলা যুবলীগের খসড়া কমিটিতে সভাপতি পদে এগিয়ে আছেন বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক, হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম রাশেদুল আলম। সম্মেলনের পর হঠাৎই এগিয়ে গিয়েছিলেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাজীবুল আহসান সুমন। সাম্প্রতিক সময়ে তার পরিবারের সদস্যরাই বিভিন্ন অভিযোগের আঙুল তুলেন সুমনের বিরুদ্ধে। সঙ্গতকারণে প্রশ্ন উঠেছে, যিনি ঘর সামাল দিতে পারেন না, তিনি উত্তর জেলা যুবলীগের মতো বিশাল সাংগঠনিক ইউনিট সামাল দেবেন কী করে?
সূত্র মতে, খসড়া কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনার শীর্ষে আছেন সন্দ্বীপের মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান মিজান। জুয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে খুলশী থানা পুলিশের হাতে আটক হওয়া মিজান যুবলীগের সেক্রেটারি পদে আলোচনায় আসেন কী করে সে প্রশ্নও জোরালো হয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলে।
এরপর আলোচনায় আছেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ খান মেনন। এছাড়া নুরুল মোস্তফা মানিককে সাধারণ সম্পাদক করতে তৎপর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এ তথ্য জানা গেছে সংশ্লিষ্ট মহলে কথা বলে।
সূত্র মতে, খসড়া তালিকাটা বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে দফায় দফায়। দক্ষিণের কমিটির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সাংগঠনিক এবং বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা নেতাদের দিয়েই হতে পারে চূড়ান্ত কমিটি। সাংগঠনিক ভিত্তি ও ক্লিন ইমেজের ভাবমূর্তি বিবেচনা করলে সকল বিতর্কিত, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও সুপারিশ বাদ দিয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে চলে আসতে পারেন আবু তৈয়ব ও রাশেদ খান মেননের যে কোনো একজন।
উত্তর ও মহানগর কমিটি কখন ঘোষণা হচ্ছে, বিতর্কমুক্ত কমিটি গঠনে কতটা সচেষ্ট জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি ঘোষণার পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে এই কারণেই যে চট্টগ্রাম উত্তর এবং মহানগর যুবলীগের কমিটি দিতে দেরি হচ্ছে এমনটা নয়। আপনারা লক্ষ্য করবেন আমরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি বেশকিছু পদেও নেতাকর্মীদের নাম প্রকাশ করছি। এতে যাচাই-বাছাইসহ আনুষাঙ্গিক কাজে আমাদের সময় একটু বেশি লাগছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ জেলা যুবলীগে নেতাদের পদত্যাগের বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত, এমনটা হওয়া সমীচীন নয়। শুধু পদের জন্য রাজনীতি করা উচিত নয়। কারণ আমরা রাজনীতি করি মানুষের সেবার জন্য। যে যেই অবস্থানেই থাকি না কেন সেখান থেকেই রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের সেবা করাটাই সকল নেতাকর্মীর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে যদি নেতাকর্মীরা রাজনীতি করেন তাহলে যেকোনো পদ থেকেই কাজ করা যায়।’