সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

এক হাসপাতালে এত অনিয়ম!

প্রকাশিতঃ ২১ নভেম্বর ২০২২ | ১১:২৯ পূর্বাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : ওষুধ চোর ও দালাল চক্রের অপতৎপরতা, চাঁদাবাজি, সরকারি পরীক্ষাগারের পরিবর্তে কমিশন নিয়ে প্রাইভেটে রোগী পাঠানো, যন্ত্রাংশ মেরামত না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, সরকারি বরাদ্দের টাকা নয়ছয়সহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসা সেবায় অবহেলা নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই ভুক্তভোগীদের।

এবার চমেক হাসপাতালের আয়া নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের ইনচার্জ থাকাকালে অবৈধভাবে স্পেশাল ও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক আয়া নিয়োগের নামে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা করে টাকা আদায় করেছেন তিনি। এছাড়াও চাকরি থেকে ছাঁটাইয়ের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা নিতেন খালেদা।

সর্বশেষ গত ২২ সেপ্টেম্বর গাইনি ওয়ার্ড থেকে এসি চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় মিলনসহ দুজনকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মিলন জানান, খালেদা বেগমের কথায় বাইরে থেকে আসা এক লোককে এসি নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। এসি কোথায় এবং কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার কিছুই জানতেন না মিলন। পরে পুলিশের জিজ্ঞেসবাদে ওই ব্যক্তি এসি চুরির কথা স্বীকার করেন।

এ ঘটনায় মিলনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও চুরির নির্দেশদাতা খালেদা বেগমকে লোক দেখানো শাস্তি হিসেবে গাইনি ওয়ার্ড থেকে ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডে বদলি করেই দায় সারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও এর আগেই ওয়ার্ডের আয়াদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে আমি ১৪ বছর ধরে স্পেশাল আয়া হিসাবে কর্মরত ছিলাম। কিন্তু ওয়ার্ডে খালেদা ম্যাডাম ইনচার্জ হয়ে আসার পর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়। চাকরি না থাকলে খাবো কি, সেই চিন্তা থেকে ৩ মাস পর এসে সর্দার শেখ আহম্মদের সাথে যোগাযোগ করি। উনি আমাকে খালেদা ম্যাডামের রুমে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন বলে রুম থেকে বের হয়ে যান।’

‘ঠিক ৬ দিন পর ইনচার্জ খালেদা আমাকে ফোন করে তার সাথে দেখা করতে বলেন। চাকরি ফিরে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি আমার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমি ধার দেনা করে ওইদিনই খালেদা ম্যাডামকে ১০ হাজার টাকা দেই। এর প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস পর সব আয়াদের সাথে আমাকেও একটি আউটসোর্সিং ফরম দিয়ে তিনি বলেন ৭০ হাজার টাকা যোগাড় করে দিলে তিনি আমাকে আউটসোর্সিংয়ের চাকরি দেবেন।’

‘মেয়ের বিয়ের জন্য তৈরি করা গহনা বিক্রি করে তাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার চাকরিটা হয়নি। পরবর্তীতে তিনি বলেন আমি যাতে শেখ আহম্মদ সর্দ্দারকে ২০ হাজার টাকা দেই। এতকিছুর পরও আমি খালেদা ম্যাডামকে আবার ১৪ হাজার টাকা যোগাড় করে দেই। তারপরও তিনি আমাকে চাকরিটা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে আমি টাকাগুলো ফেরত দিতে বললে তিনি আমাকে বিভিন্ন কথা বলে ঘুরাতে থাকেন এবং আমাকে স্পেশাল আয়ার পদ থেকে চাকরিচ্যুত করেন।’

চমেক হাসপাতালের আরেক স্পেশাল আয়া জয়নাব বেগমের অভিযোগও অনেকটা একই রকম। তার অভিযোগ, ওষুধ পাচারে রাজি করতে না পারায় খালেদ বেগম তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে চাকরিচ্যুত করেন। পরবর্তীতে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে খালেদা তার কাছেও ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। যার প্রেক্ষিতে খালেদাকে ২০ হাজার টাকা দেন তিনি। বাকি ১০ হাজার টাকা না দিলে চাকরি হবে না বুঝতে পেরে পরবর্তীতে বাকি ১০ হাজার টাকা খালেদাকে দেন তিনি।

জয়নাব বেগম বলেন, ‘এত টাকা দেওয়ার পরও খালেদা ম্যাডাম আমার কাছে বিভিন্নভাবে টাকা দাবি করছিলেন। আমি নিজের অসহায়ত্বের কথা জানালে এক্ষেত্রে তার কিছু করার নেই জানিয়ে আমার বিরুদ্ধে পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেন, এতে আমার চাকরিটা চলে যায়। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আমি খালেদা ম্যাডামের সাথে পুনরায় যোগাযোগ করলে তিনি বলেন ৪০ হাজার টাকা দিলে চাকরি ফিরে পাবো, এটাই নাকি নিয়ম।’

‘চাকরি ফিতে পেতে আমি আবার তাকে টাকা দেই। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ বিনা কারণে আমাকে আবার চাকরি থেকে বের করে দেন খালেদা ম্যাডাম। এরপর আমি তার সাথে যোগাযোগ করলে উনি আবার আমার কাছে ৩০ হাজার টকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি হচ্ছি না বলে, আমি চাকরিচ্যুত হয়ে আছি।’

জানা যায়, হাসপাতালের ২০ জন স্পেশাল আয়াকে চাকরিচ্যুত করার ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং ১৯ জনকে আউটসোর্সিংয়ে চাকরি দেওয়ার নামে জনপ্রতি ৩০-৭০ হাজার টাকা করে অন্তত ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন খালেদা বেগম। বিষয়টি জানাজানি হলে সম্প্রতি সেই খালেদাকে গাইনি ওয়ার্ড ইনচার্জ থেকে ক্যাজুয়াল্টি ওয়ার্ডে বদলি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নিজেদের উপর হওয়া নির্যাতন, অর্থ আত্মসাত ও মাসোয়ারার বিষয়ে জানিয়ে গত ৮ নভেম্বর চমেক হাসপাতাল পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন (বিএনএ) চমেক হাসপাতাল শাখার সভাপতি আশু চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ যেসকল অভিযোগ উঠেছে এগুলো আমাদের জন্য বিব্রতকর। এসব অভিযোগ যাচাইয়ে হাসপাতাল পরিচালক গত ১৬ নভেম্বর ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের পরই অভিযোগের সত্যতা জানা যাবে। তবে খালেদা আমার কাছে এসেছিল। তাকে সমস্যার হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধও আমাকে করেছে।‘

হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানান, গাইনি ওয়ার্ডের ইনচার্জ হওয়ায় একছত্র অধিপত্য ছিল খালেদার। শুধু তাই নয়, গাইনি ওয়ার্ড ইনচার্জ থাকাকালে আয়াদের কাছ থেকে ৩ ধাপে (প্রতিদিন, ১০ দিন এবং ১ মাস পর পর) মাসোয়ারা আদায় করতেন খালেদা বেগম।

জানা গেছে, হাসপাতালের ৩৩ নম্বর গাইনি বিভাগের অধীনে তিন শিফটে (সকাল, বিকাল ও রাতে) লেবার রুমে দায়িত্ব পালন করেন ৯ আয়া। একইভাবে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে ৯ জন, একলামশিয়া ওয়ার্ডে ৪ জন এবং ওটিতে (অস্ত্রোপচার) দায়িত্ব পালন করেন ১৫ জন আয়া। এসব আয়া ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ খালেদার অধীনস্থ।

যার মধ্যে লেবার রুমে ৩ শিফটে কর্মরত ৯ জন আয়ার জনপ্রতি প্রতিদিন ২০০ টাকা করে ১ হাজার ৮০০ টাকা, ২য় ধাপে প্রতি ১০ দিন পর ২০০ টাকা এবং ৩য় ধাপে ৩০ দিন পর জনপ্রতি ১ হাজার ৪০০ টাকা সরাসরি দিতে হতো খালেদাকে। এছাড়া পোস্ট অপারেটিভ ও একলামশিয়া ওয়ার্ডে কর্মরতদের মাসোয়ারা দিতে হতো ২ ধাপে। পোস্ট অপারেটিভে দায়িত্বরত ৯ জনের কাছ থেকে ১০ দিন পর পর জনপ্রতি ৫০০ টাকা এবং মাস শেষে ৪০০ টাকা করে নেওয়া হতো।

অন্যদিকে, একলামশিয়া ওয়ার্ডে কর্মরত ৪ জনের কাছ থেকেও ১০ দিন পর পর জনপ্রতি ২০০ টাকা এবং মাস শেষে ৪০০ টাকা করে নিতেন খালেদা। আর অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) ৩ শিফটে কাজে থাকা আয়াদের প্রতিদিন ১৫০ টাকা ও মাস শেষে ১ হাজার ৪০০ টাকা করে মাসোয়ারা দিতে হতো।

যদিও আয়াদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন খালেদা বেগম। তার দাবি কিছু অসাধু লোক তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিইনি। আমার সম্মানহানির জন্য এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে। যেসব আয়া এই অভিযোগ করেছেন তারা অনিয়মের অভিযোগে হাসপাতাল থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন।’ এক পর্যায়ে প্রতিবেদনটি করার আগে তার সাথে দেখা করার অনুরোধ করতে থাকেন তিনি। প্রতিবেদককে তার ঘরে এসে বিষয়টি মিটমাটের প্রস্তাবও দেন খালেদা।

এদিকে, বিভিন্ন সময় চমেক হাসপাতালের ওষুধ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, হাসপাতালের কর্মকর্তা, নার্স, ট্রলিম্যান, ওয়ার্ডবয়, ফার্মাসিস্ট এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়ে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট এই ওষুধ চুরির সাথে যুক্ত। হাসপাতাল থেকে ওষুধ বাইরে পাচারের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার সরকারি ওষুধ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ২৬ নং ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ আশু চক্রবর্তী ও আউটসোর্সিং কর্মচারী মো. সৈয়দকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এর প্রায় মাসখানেক পর গত ১০ মার্চ হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রির অভিযোগের ভিত্তিতে চমেক হাসপাতালের ফার্মেসিতে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে হাসপাতালের আউটডোর ফার্মেসির বিভিন্ন কাগজপত্র ও হাসপাতালের কেন্দ্রীয় ওষাধুগারে বিভিন্ন নথিপত্র পর্যবেক্ষণ করে অসংগতি পান।

এরপরও গত ১১ জুলাই চমেক হাসপাতাল থেকে রোগীর জন্য বরাদ্দের ওষুধ চুরির ঘটনায় হাসপাতালের স্পেশাল ওয়ার্ডবয় দিলীপ কুমার নাথ (৪৫), আশিষ দাস (৪৫), পলাশ ধরকে (৩৮) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর চমেক হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে ওষুধসহ আরাফাতুল ইসলাম নামে চোর চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এসময় তার কাছ থেকে ২৫ রকমের ওষুধ উদ্ধার করা হয়।

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধের পাশাপাশি স্যালাইন, ইনজেকশন, সিরাপ, ড্রপ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, স্যাভলন, হেক্সিসল প্রভৃতি দেয়ার কথা। জানা যায়, সরকারিভাবে হাসপাতাল থেকে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশনসহ পায় ২২০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু প্যারাসিটামল, গেস্ট্রিকের ওষুধ সহ টুকটাক কিছু ওষুধ ছাড়া বেশিরভাগ ওষুধই হাসপাতাল থেকে রোগীকে সর্বরাহ করা হয় না।

এতো গেলো হাসপাতালে থেকে রোগীকে সরকারি ওষুধ সরবরাহ না করার ঘটনা। অভিযোগ আছে, বাইরের ফার্মেসি থেকে যেসব ওষুধ কিনে রোগীর চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয় সেগুলো নয়ছয় করে একটি চক্র। আর এ ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি ঘটে গাইনি ওয়ার্ডে। এসব তথ্য একুশে পত্রিকাকে দিয়েছেন গাইনি ওয়ার্ডের সাবেক আউটসোর্সিং আয়া জয়নাব বেগম শাকিলা।

তিনি বলেন, ‘গাইনি ওয়ার্ডে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকটি ডেলিভারি হতো। প্রতিটি ডেলিভারি রোগীর চিকিৎসক নির্দেশিত ওষুধ, ইনজেকশন ও অপারেশনের সিজারিয়ান সামগ্রী রোগীর স্বজনেরা এনে দিলেও বেশিরভাগই কৌশলে সরিতে ফেলা হতো। খালেদা বেগমের নির্দেশেই (তৎকালীন গাইনি ওয়ার্ড ইনচার্জ) এমনটা হতো। ওয়ার্ডের প্রতিটি ডেলিভারি রোগীর ওষুধ সরানোর দায়িত্ব একেক সময় একেকজনকে দিতেন খালেদা। খালেদার অনুপস্থিতিতে দামি ওষুধ সরিয়ে রাখার নির্দেশনাও দেওয়া ছিল আয়াদের।’

শাকিলা আরও বলেন, বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে চুরি করা এসব ওষুধের একটি অংশ অন্যান্য ডেলিভারি রোগীদের এবং বাকিটা কমিশনে বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি করতেন তিনি। ২০১৮ সালে ইনচার্জের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে খালেদা বেগম আমাকেও একাধিকবার ওষুধ পাচার করতে বলেন। কিন্তু রাজি না হওয়ায় আমাকে একেবারে চাকরি থেকেই বের করে দেওয়া হয়।’

হাসপাতালের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি ওষুধ চুরিতে দালালদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে। শুধু ওষুধ চুরি নয়, রোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগ পরীক্ষার জন্য নিয়ে গিয়ে রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা বাবদ বেশি ফি আদায় এবং সহজ-সরল রোগীদের প্ররোচিত করে নির্ধারিত ওষুধের দোকান থেকে বেশি দামে ওষুধ কিনতে ফাঁদে ফেলেন তারা। পরবর্তীতে ওইসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের দোকান থেকে কমিশন আদায় করে দালাল চক্র।

সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর রোগীর সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে আলম বাবু, মো. জিসান, মো. ফরহাদ ও মো. জুয়েল নামে ৪ দালালকে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা হাসপাতালের সামনে বিভিন্ন ওষুধের দোকান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল বলে পুলিশ জানায়।

এদিকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হেনস্তা ও ভোগান্তি এবং সেবার মান নিয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৩ আগস্ট চমেকের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে এসব বিষয় উঠে আসে। শুনানিতে হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওষুধ চোর চক্র, চাঁদাবাজি, চিকিৎসা সেবায় অবহেলা, সরকারি পরিক্ষাগারে টেস্ট না করে প্রাইভেটে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, যন্ত্রাংশ মেরামত না করা, মেশিন বাবদ টাকা আত্মসাতসহ বেশকিছু বিষয়ে অভিযোগ উঠে।

শুধু তাই নয়, হাসপাতালটির কেনাকাটা ও সরবরাহে দুর্নীতি এবং অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও। দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় এক যুগ ধরে চমেক হাসপাতালে যন্ত্রপাতি, মনিহারি দ্রব্য কেনাকাটা, রোগীর খাবার সরবরাহ এবং চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড নেই। নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে কে কোন পণ্য বেশি দামে সরবরাহ করে, তা ভাগাভাগি করে নেয় বলে অভিযোগ।

দুদকের ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু এমএসআর খাতে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট সাড়ে ৬৩ কোটি টাকার দরপত্র সিন্ডিকেটভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো করেছে। এ ছাড়া রোগীদের খাবার সরবরাহে গত তিন বছরে ৩২ কোটি টাকার দরপত্র এবং মনিহারি খাতে ৮ কোটি টাকার দরপত্র পেয়েছে একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের দরপত্র বিভাগের প্রধান মো. মঈনুদ্দিন ও হিসাবরক্ষক মো. শাহজাহানের আঁতাত ছিল বলেও অভিযোগ করা হয়।

যদিও এসব অনিয়ম রোধে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান প্রথাগত দরপত্র বাদ দিয়ে ই–দরপত্র বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। গত ২৪ মার্চ এক দরপত্র বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এলইডি বাতি, আলট্রাসাউন্ড কালার ডপলার সিস্টেম, কম্পিউটার মনিটর, সিসি ক্যামেরাসহ ২১টি ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, পণ্য এবং যন্ত্রাংশ মেরামতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ই–দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ই–দরপত্রে শর্তও শিথিল করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ যেন অংশ নিতে না পারে, সে জন্য আগে দরপত্রে কঠিন শর্ত দেওয়া থাকত। যার জন্য একই প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরেফিরে প্রতিবছর বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের দরপত্র নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত।

এতো অনিয়ম ও অসংগতিতে বিব্রত চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি হাসপাতালের দালাল, ওষুধ চুরি চক্র ও সকল সিন্ডিকেটে ভেঙে দেওয়ার। এই হাসপাতালে মানুষ বিপদে পড়ে সেবা নিতে আসে। কিন্তু রোগীর অসহায়ত্বের ফায়দা লুটছে তারা। তাদের থামাতে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি এতটুকু স্পষ্ট বলে দিতে চাই, অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না। অন্তত আমি কাউকে ছাড় দেব না।’

খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনটা শুনেছি মিলনের মামলায় নিজের সম্পৃক্ততা এড়াতে তিনি ২ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এছাড়া আয়াদের সাথেও আমি নিজে কথা বলেছি। আমরা এগুলো খতিয়ে দেখছি। ইতোমধ্যে ৩ সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটিও আমরা গঠন করেছি। তার অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।’