মন নিয়ে লুকোচুরি

 

:: সুরেশ কুমার দাশ ::

fountain pen writing on paper

fountain pen writing on paper

বাইরের চাকচিক্যের জন্য ভেতরের মানুষটাকে কষ্ট দেয়া আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ভেতরের আবার কোন্ মানুষ! ঘরের ভেতরের মানুষ! অন্দর মহলের কেউ! আসলেই অন্দরের, অন্তরের মানুষ।

কখনও কখনও রিমা নামে এক নারীর চারপাশ দিয়ে কেউ একজন ঘুরঘুর করে। সময় থাকলে তার সাথে দেখা হয়। আর সময় না থাকলে তাকে আর সময় দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না।

রিমা ভাবে এ যন্ত্রের যুগে এভাবে কাউকে আর সময় দেয়া আদৌ সম্ভব না। কাকে সময় দেয় না রিমা। তাকে আর চেনা হয় না। ঘুরঘুর করা তিনি তখন কোনো পাত্তা না পেয়ে চলেই গেলেন। কারণ রিমা ভারি ব্যস্ত। ব্যস্ততা ছিড়েখুড়ে খাচ্ছে সবাইকে। ব্যস্ততা না হোক অন্য অনেক দুঃখ কষ্ট আছে কারো কারো।

তাই এখানে ‘আপনাকে আপনি চেনা হয় না’।

এভাবে না চেনার মান অভিমান তো তার হয়। রাগ হয়। রাগ হলেও সেটা নিজের মধ্যে পুষে রাখতে হয়। পুষে পুষে আর কত রাখা যায়। তা তখন তার খোঁজ নিতে ব্যস্ততা বেড়ে যায় সকলের। কিন্তু সেই ব্যস্ততার তখন আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ধরাছোঁয়ার বাইরে তো পরলোকে না।

পরলোকে যায় রিমা। তার দেহটা। কিন্তু দেহ তো দেহই। মন তো না। দেহকেও মনে রাখে মন। মনের দায় আছে। দেহের কোনো দায় থাকে না।

তবু দেহের মূল্য থাকলেও মনের মূল্য থাকে না। যে মানুষ দেহটা চালায়, যে মন দেহটা চালায় তার খবর ব্যক্তি মানুষ নিজেই রাখে না। মনও রাখে না মনের খবর। মনের খবর না রাখাটাই মনের দুঃখ। মন মনের খবর রাখে না, কারণ ব্যক্তি মনের উপর জবরদস্তি করে।

জবরদস্তির ফল ভালো হয় না।

তাই মনের উপর জবরদস্তি করা ভালো না।

‘মনচাষা চিনলে না তুমি আমার এই স্বর্ণভূমি/জমিতে আবাদ করলে ফলত রসের চিন্তামণি . . .’

এটা কোনো এক বাউল কবির গান। এমনি মন নিয়ে হাজার হাজার গান লিখেছে এই অঞ্চলের বাউল কবিরা। এরপরও তাদের মন সন্তুষ্ট ছিল কিনা আমরা জানি না।

শরীরকে সন্তুষ্ট রাখতেই চাই, সুখী, খুশী দেহ। মন যেমনই থাক। কারণ মনের দুরবস্থা বাইর থেকে দেখা যায় না। যাকে আড়াল করা যায় তার সুখ দুঃখ দেখতে নেই। শরীরকে কীভাবে সুখে রাখতে চাই। শরীর তো মনের জন্যই সুখে থাকে। মনকে তুষ্ট করতে।

আসলে শরীরের একটাই বাহাদুরি যে তার মধ্যে প্রাণের বসবাস না থাকলে ‘মন তোমার বসতি কোথায়?’ শরীরের প্রাণ যদি মরে যায়। কোথায় বাসা বাধবে মন।

মন নিয়ে মানুষের যত মনামনি। যত ভাবনা। অন্য কোনো প্রাণীর কেন নেই। আছে অথবা নেই জানি না। থাকলে অবশ্যই বাউলদের মত গাইত। অথবা মনোবিজ্ঞান চর্চা করত।

কিন্তু প্রাণিদের মন থাকে না। থাকলে আমাদের মত বিচ্ছিন্নতা নেই। প্রতিবন্ধিতা নেই। তারা পাগল নয়। পাগলামি দেখা গেলেও মানুষের মত পাগল তারা নয়।

কারণ পাগলদের কথা আমরা ভাবি না। আমরা চাই তারা পাগলই থাক আমারই মত। তারা একটু বেশি আমরা একটু কম।

পাগলামি কম হোক আর বেশি হোক চিকিৎসা তো চাই।

পাগলামি পাগলামিই। এটা চিকিৎসার কোনো বিষয় না। চিকিৎসার বিষয় হলে ব্যবস্থাও থাকত। চিকিৎসা তো আছে। আছে, তবে তা মনের ন্যায় অকার্যকর। কারণ তুমি মন বোঝ না।

তাহলে মন ঝুঝতে হবে। মন ও মানসিকতা বোঝে না বলেই বাংলাদেশে কম বেশি পাগলাটে ৪ কোটি লোক আছে বলে মনোবিজ্ঞানিরা বলছেন। মানে কেউ কারো কদর বোঝে না। এটা অন্যের সাথে প্রতারণা নিজের সাথেও প্রতারণা। একটি মনের সাথে আর একটি মনের প্রতারণাটা মন বোঝে। এটা ব্যক্তি মানুষ নিজের সাথে প্রতারণা করে। কারণ এখানে আমাদের কাছে মনের মূল্য নেই। মনের পরিচর্যা নেই। তাই শরীরের জন্যই চিকিৎসা বরাদ্দ। মনের কোনো চিকিৎসা নেই। অথচ পাগলাটে মনোরোগি সমাজের জন্যও ক্ষতি। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।

শরীরে ব্যথা বা আঘাত লাগলে যেমন প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় তেমনি অস্ট্রেলিয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা চালু করা হয়েছে মনের সুস্থতার জন্য। সম্ভবত পৃথিবীতে প্রথম। পৃথিবীর কোনো দেশে মানসিক রোগিদের প্রাথমিক চিকিৎসা নেই।

কারণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত মনেরও আবেগ, অনুভূতি, বোধ চিন্তা, স্মৃতি, ইত্যাদি আছে। এগুলোকে পরিচর্যা না করলে মন সুস্থ থাকে না। অস্ট্রেলিয়ার মত দেশ এমন কিছু করলেও আমরা তার ধারে কাছেও নেই।

মনো চিকিৎসকরা বলছেন- রাস্তায় যেসব পাগলরা শুয়ে বসে থাকে, উদ্দেশ্যহীন গালাগালি করে, ময়লা আবর্জনা থেকে খাবার খুঁজে খায় তাদের মাসে দেড়শ টাকার ওষুধ খাওয়ালে এরা পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে।

প্রায় দুই শতাধিক মানসিক রোগের মধ্যে এটা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানে একটা সহজ চিকিৎসা। কিন্তু এসব মানুষগুলো সামাজিক পরিস্থিতির কারণে জীবনবিমুখ হয়েছে। তাদের জীবনে লাঞ্ছনার শেষ নেই।

যেমন আত্মহত্যার ইচ্ছা বা আত্মহত্যা করে মানসিক সমস্যার কারণেই। এটা তো বাংলাদেশে কম নয়। সামাজিক কারণেই ব্যক্তির মধ্যে এসব মানসিক সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়।

মানসিক রোগের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন দরকার। সামাজিক সংস্কার দরকার। মানসিক চিকিৎসা তরান্বিত করার জন্য কুসংস্কার দূর করতে হবে। মানসিক রোগিদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও মানবিক হতে হবে। রাষ্ট্র মানসিক রোগিদের পাগল ঠাউরে দায় এড়াতে পারে না।