মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): সাগরপথ ব্যবহার করলে দিতে হয় চাঁদা। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মারধরের শিকার হন জাহাজের নাবিক ও বাল্কহেডের সুকানি-শ্রমিকরা। এমন অভিযোগ উঠেছে বাঁশখালী উপকূলের ত্রাস হিসেবে পরিচিত ‘আজগর বাহিনীর’ বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানান, বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের গণ্ডামারা এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্র সক্রিয় রয়েছে। এই দলের নেতৃত্ব দেন গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে আজগর হোসাইন প্রকাশ দমা আজগর। তার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন মালামাল বোঝাই জাহাজ ও ভাল্ক হেড এবং জেলেদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়।
আজগর বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বাঁশখালী থানার জিআর মামলা নং ৯৭/১৫, ১৮৩/১৮, ২৬২/২০, পতেঙ্গা থানার মামলা নং ৯২/২২ সহ আরও অনেক মামলা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আজগর বাহিনীর হাতে আজ অবধি মারধর ও হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। তবে অনেক ভুক্তভোগী ইজ্জত ও প্রাণ হারানোর ভয়ে মুখ খুলেননি। আবার অনেকে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। এ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ করলে নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি চাম্বল ইউনিয়নের পশ্চিম চাম্বল ডেপুটিঘোনা এলাকায় চাঁদা না পেয়ে একটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটান আজগর বাহিনীর সদস্য মাইমুনুর রশীদের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একদল সন্ত্রাসী। এ ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী জাফর আহমদ বাদী হয়ে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন।
ভুক্তভোগী জাফর আহমদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ছেলে প্রবাসে থাকে। ঘরবাড়ি তেমন মজবুত না থাকায় আমার খরিদা জায়গায় একটি ঘর করার উদ্যোগ নিই। ঘর নির্মাণ করতে চাইলে সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হবে ; এমন দাবি করতে থাকে তারা। দীর্ঘদিন ধরে আমার পরিবারের কাছ থেকে ৪ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা না দেয়ায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ দলবল নিয়ে আমার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। আমার স্ত্রী রাশেদা বেগম, পুত্রবধূ হাফছা বেগম ও ছেনোয়ারা বেগমকে টানাহেঁচড়া করে কাপড়চোপড় ছিঁড়ে শ্লীলতাহানি করে জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এসব দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করলে পুত্রবধূ হাফছা বেগমকে মারধর করে তার মোবাইলটিও ছিনিয়ে নেয়। এসময় সন্ত্রাসীরা বাড়ির সীমানা পিলার ভেঙে ২ লাখ টাকা ক্ষতিসাধন, বাড়ি তৈরি করার জন্য আনা ৭৮ টাকা মূল্যের লোহার রড ও বাড়ির পাশে শুকাতে দেয়া ১ লাখ টাকা মূল্যের শুঁটকি নিয়ে যায়। এখন মামলা করায় ওরা আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।’
গত ১৯ সেপ্টেম্বর আজগর বাহিনীর সদস্য পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার মৃত হাবিব উল্লাহ মীরের ছেলে মো. মীর কাশেম প্রকাশ কাশেম ডাকাত ও পূর্ব বড়ঘোনার ফরিদ আহমদের ছেলে আমান উল্লাহ বঙ্গোপসাগরে ‘এম. ভি জিহান অনিক-৪’ নামে একটি ভাল্কহেডে জাহাজ স্টাফদের চাঁদার জন্য মারধর করেন। এসময় জাহাজের সুকানি জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে (৯৯৯) কল করলে ঘটনাস্থল থেকে কোস্টগার্ড সদস্যরা কাশেম ও আমান উল্লাহকে আটক করে। পরে এ ঘটনায় ২২ সেপ্টেম্বর ওই জাহাজের মালিক দুলাল হোসেন বাদী হয়ে সদরঘাট নৌ থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় জেলে যান আমান ও কাশেম। ১ মাস পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার শুরু করেন অপকর্ম।
পরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর মাঝিরঘাট মেসার্স আসফি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এমরানুল হক অফিস থেকে ভাল্কহেড জাহাজের সুকানিদের বেতন, বাজার ও জাহাজের জ্বালানি তেল কেনার টাকা দিতে যাওয়ার সময় পতেঙ্গা ১৪ নম্বর ঘাটে আজগর বাহিনীর সদস্যদের মারধরের শিকার হন ও পকেটে থাকা নগদ ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা হারান। ভুক্তভোগী এমরান বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার ভাল্ক হেড শ্রমিক ইউনিয়ন বাঁশখালী শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক।
এ ঘটনার পর প্রাণনাশের ভয়ে ভুক্তভোগী এমরানুল হক বাঁশখালী থানায় আজগর হোসাইন প্রকাশ দমা আজগর ও মাইমুনুর রশীদের বিরুদ্ধে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাধারণ ডায়েরি করেন।
সবশেষ, শনিবার (৫ নভেম্বর) সকাল ১০টায় আজগর বাহিনীর সদস্যরা এমরানুল হককে মারধর করে ও হাতে থাকা নগদ টাকা লুট করে নেয়। গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা নতুন মার্কেট রহমানিয়া রোডে এ ঘটনা ঘটে।
শনিবার সকালে নতুন মার্কেটে ডাচ বাংলা ব্যাংকে আর্থিক লেনদেন করতে যান এমরান। সেখানে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা আজগর আলীর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এমরানের ওপর হামলে পড়ে। তাকে লাঠিসোটা দিয়ে অতর্কিতভাবে মারধর করে। ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়ে এমরান। এসময় প্রত্যক্ষদর্শী ছৈয়দ নুর ড্রাইভারসহ আশেপাশে থাকা কয়েকজন ব্যবসায়ী তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন।
গুরুতর আহত এমরানকে উদ্ধার করে প্রথমে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাতে এমরানকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি চমেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এমরানুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, সকালে নতুন মার্কেটে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে টাকা পাঠাতে গিয়েছিলাম। সেখানে থাকা ডাকাত আজগর, মীর কাশেম, বাদশা, জসীম মাইমুনুর রশীদ সহ ১০ থেকে ১২ জনের একদল সন্ত্রাসী আমাকে মারধর করে। প্রথমে আজগর আমাকে ঘুষি মারলে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এরপর যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে লাথি মেরেছে। আমাকে ড্রাইভার দিদার, সিএনজির লাইনম্যান ও আবু ছৈয়দ সওদাগর উদ্ধার করে তার দোকানে নিয়ে যায়। এসময় আমার কাছে থাকা নগদ ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। টাকা গেছে। সেটা তো বড় কথা না ভাই; আমি যে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছি সেটাই বড় কথা। সেদিন ওরা আমাকে মেরে ফেলতো।’
এভাবে কেন মারধর করা হলো—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি জাহাজের মধ্যে পাইলট সাপ্লাইয়ের কাজ করি। আজগর আমাকে বলছে, খাটখালী সাগর ব্যবহার করে পাইলট সাপ্লাই দিতে পারবো না। পাইলট সাপ্লাই দিতে হলে তাকে চাঁদা দিতে হবে। আজ থেকে ৩ মাস আগেও আমার কিছু মানুষকে সাগরে নির্যাতন করে বেঁধে রাখে। পরে আমি ঘটনাটি এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে জানানোর পর পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজগর বাহিনীর প্রধান আজগর হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরাও বাজারে গিয়েছি। এমরানও বাজারে আসলো। আমি তাকে মারধর করিনি। আমার সাথে তো ওর জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ নেই। সে সাগরপথে লোক সাপ্লাই দেয়। তার লাইসেন্স আছে কিনা দেখেন আগে। আর আমার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা আছে আপনি বাঁশখালী থানায় গিয়ে দেখুন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি আমি মৌখিকভাবে শুনেছি। এ ঘটনায় কেউ এ পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’