সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

চসিক কর্মকর্তা এনামুলের তেলেসমাতি, বাগিয়ে নিয়েছেন পদোন্নতি-প্রকল্পের কাজও!

প্রকাশিতঃ ৩ নভেম্বর ২০২২ | ৫:৩৮ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রকৌশল (বিদ্যুৎ) উপ-বিভাগে সড়কবাতি পরিদর্শক এনামুল হককে বিধি বহির্ভূতভাবে সহকারী প্রকৌশলীর (বিদ্যুৎ) দায়িত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে দেওয়া এই দায়িত্ব ও পদোন্নতির বিষয়টি গড়িয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। এ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এতো কিছুর পরও তাকে ওই দায়িত্বে বহাল রেখেছে চসিক।

শুধু তাই নয়, উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকেই এনামুল হক নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন বলে অভিযোগ আছে। একাধিক প্রকল্পের কাজ তার স্ত্রী সেলিনা আকতারের নামে করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও আছে এনামুলের বিরুদ্ধে। স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করে এনামুল নিজেই এসব কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালে চসিকের প্রকৌশল (বিদ্যুৎ) উপ-বিভাগে (পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া) অস্থায়ী সড়কবাতি পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পান ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী এনামুল হক। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল তাকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়৷ যদিও সেসময় স্ব-বেতনে পদোন্নতি পাওয়া এনামুল পদটির কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন না বলেই শর্ত ছিল। যদিও সেই পদোন্নতির পর থেকেই সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন তিনি।

সর্বশেষ গত ৭ এপ্রিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে এনামুল হক নতুন করে পদোন্নতি পান। এমনকি দায়িত্ব প্রদানকালে তার মূল পদটিও (সড়কবাতি পরিদর্শক) উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, চসিকের গ্রেডেশন তালিকাতেও তার নাম নেই। সংস্থাটির নিয়োগ বিধিমালায় এ ধরনের দায়িত্ব প্রদানের বিধান না থাকা সত্ত্বেও কৌশলে অর্থের বিনিময়ে তাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

বিধিবহির্ভূত পদোন্নতির এই ঘটনায় কর্পোরেশনে কর্মরত অন্যান্য উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এনামুল হককে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের অফিস আদেশটি বাতিলপূর্বক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে গত ১৬ আগস্ট মোহাম্মদ আবিদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি পাঠান।

যার প্রেক্ষিতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মাদ জহিরুল ইসলাম এ বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

এদিকে, একাধিক প্রকল্পের কাজ স্ত্রী সেলিনা আকতারের নামে করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও আছে এনামুলের বিরুদ্ধে। স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করে এনামুল নিজেই এসব কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তথ্যমতে, গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে (ঠিকানা-এম রহমান মার্কেট ৩৬/৪৬ নন্দনকানন) ২০০৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চসিক থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেন সেলিনা আকতার। সকলের চোখে ধুলো দিতে কৌশলে স্বামীর নামের বদলে ট্রেড লাইসেন্সে বাবা-মায়ের নাম দিয়েছেন তিনি। চসিকের ট্রেড লাইসেন্স শাখার বালাম বইয়ে গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের মালিক হিসেবে জনৈক আলমগীর হোসেন ও সেলিনা আকতারের নাম উল্লেখ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের নামে ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকৌশল বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের জোন-৪ এর আওতাধীনে কেন্দ্রীয় সড়কবাতি রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সোডিয়াম বাতির আনুষঙ্গিক মালামাল সরবরাহ প্রকল্পের (স্মারক-চসিক/প্রবি/বিদ্যুৎ /তঃপঃ-১/১৬-১৫৩) কার্যাদেশ পেয়েছিল। মোট ২ লাখ ৩১ হাজার ৫২৫ টাকার প্রকল্পের কাজটি পরোক্ষভাবে করেছেন এনামুল হক।

একইভাবে ২০১৭ সালে ৫ জানুয়ারি ২৬ উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডের গলাচিপা পাড়ার বি ব্লকে সাবেক কমিশনার মো. ইদ্রিসের বাড়ির পশ্চিম পাশের সড়ক আলোকায়নের কার্যাদেশ পেয়েছিলেন সেলিনা আকতার। ১ লাখ ৬০ হাজার ২২৫ টাকার কাজটি করার সময় চসিকের বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন এনামুল। নথি অনুযায়ী, প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলনকারী ছিলেন সেলিনার স্বামী এনামুল হক। যেখানে এনামই আবার স্ত্রীর কাজের বিল উপস্থাপনকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন।

একই বছরে দামপাড়া স্টোরের জন্য স্টিলের র‍্যাক কিনতে ৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ (স্মারক-চসিক/ প্রবি/বিদ্যুৎ/পিওএম /১৭/১০৬, ৩/০৪/২০১৭) দেয়া হয় গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজকে। আর এই প্রকল্পই সেলিনা আকতার পেয়েছেন স্বামীর কল্যাণে। অভিযোগ আছে, স্ত্রীর নাম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স করে নিজেই এসব প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছেন এনামুল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের জুবলী রোড শাখায় গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজের নামে একটি একাউন্ট (হিসাব নং- ৩০০-৩১১-১০০০০২৮১২) খোলা হয়েছে। যদিও সেই ব্যাংকে একাউন্ট করতে সেলিনা আকতার ব্যবহার করেছেন স্বামী এনামুল হকের নাম। ব্যাংকের এই যৌথ হিসাবেই চসিকের প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজের বিলের টাকা জমা দেয়া হয়েছে।

নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে চসিকে ঠিকাদারির কাজ করেছেন এনামুল হকের স্ত্রী সেলিনা আকতার। সেসময় এনাম ছিলেন সংস্থাটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী। যদিও সেলিনার দাবি, তিনি হালিশহরের ঈদগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন, এ ধরনের কোনো ঠিকাদারি কাজই তিনি করেননি। এমনকি নিজের নামে থাকা ট্রেড লাইসেন্স আছে জানতে পেরে বিষ্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিনা আকতার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি সত্যি এসব বিষয়ে জানি না। আপনার কাছেই এসব শুনলাম। আমি ঠিকাদারি কী করবো, সারাদিন আমার স্কুলেই ব্যস্ত থাকতে হয়। আর আমি কখনও ট্রেড লাইসেন্সই করিনি। এমনকি জুবলি রোডের ব্যাংক একাউন্টের বিষয়েও আমি জানি না। আপনি দয়া করে আমার স্বামীর সাথে কথা বলুন। এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’

তবে একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও অভিযুক্ত সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) এনামুল হকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল আলম বলেন, ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে আমরা মতামত পাঠিয়ে দিয়েছি। রিপ্লাই কি ছিল সেটা তো এই মুহূর্তে মনে নেই তবে মতামত পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে এনামুল হককে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি, এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব। পদোন্নতি তো বোর্ডের মাধ্যমে হবে, এগুলো এমনিতেই দায়িত্ব দেওয়া।’

অস্থায়ী সড়কবাতি পরিদর্শক থেকে এনামুল হককে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া যুক্তিযুক্ত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে অস্থায়ীদের তো রেগুলার প্রমোশন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কর্পোরেশনে তো তেমন স্থায়ী লোকও নেই। তাই অস্থায়ী যারা আছে তাদের দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালানো হয়। তিনি কিন্তু এখনও অস্থায়ী হিসেবেই আছেন।’

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন অনুবিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বেশকিছু অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা এ বিষয়ে চসিকের রিপোর্ট জানতে চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছিলাম। সেটির রিপোর্ট তারা দিয়েছে, কিন্তু এখনও সেটি স্টাডি করার সুযোগ হয়নি। চসিকের রিপোর্টটি দেখেই এ বিষয়ে বলতে পারবো। কোনো অসংগতি পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’