জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী ভেলুয়ার দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগিতার আড়ালে দিনেদুপুরে চলছে জমজমাট জুয়ার আসর। অভিযোগ উঠেছে, বড়শি প্রতিযোগিতার নামে এ জুয়ার আসরের আয়োজন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটনের ভাই আব্দুল মান্নান খোকন।
জানা যায়, ভেলুয়ার দীঘিতে প্রতি সপ্তাহে একবার (শুক্রবার) বড়শি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সে অনুযায়ী আগামীকাল শুক্রবারও (২১ অক্টোবর) ‘বড়শি প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বড়শি প্রতিযোগিতায় মোট আসন থাকে ১১২টি। আসন প্রতি ৪০ হাজার টাকা করে ফি আদায় করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রায় ৪৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এসব আসনের জন্য টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নগরের বিভিন্ন দোকানকে।
পাহাড়তলী, ডি.টি রোডস্থ খালেক ও মালেক বড়শি বিতান, আসলাম বড়শি বিতান, পাহাড়তলী বড়শি বিতান, মাকছুদা ফিশিং হাউজ, সরাইপাড়ার ফোর স্টার বড়শি বিতান, আগ্রাবাদের শাহ্ আমানত বড়শি বিতান, বক্সীরহাটের ভোলার দোকান, সাতকানিয়া কেরানীহাটের জামাল বড়শি বিতান, আমিরাবাদ লোহাগাড়ার শাহা পীর বড়শী বিতানসহ বেশ কিছু বড়শি সামগ্রী বিক্রির দোকানে যোগাযোগ করে আগ্রহীরা টিকিট কিনতে পারেন।
যদিও এর বিপরীতে অর্ধেক টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রথম পুরস্কার ৭ লাখ, ২য় পুরস্কার ৩ লাখ, ৩য় পুরস্কার দেড় লাখ, ৪র্থ পুরস্কার এক লাখ, ৫ম পুরস্কার ৮০ হাজার, ৬ষ্ঠ পুরস্কার ৭৫ হাজার, ৭ম পুরস্কার ৭০ হাজার, ৮ম পুরস্কার ৬৫ হাজার, ৯ম পুরস্কার ৬৩ হাজার, ১০ম পুরস্কার ৬২ হাজার, ১১তম পুরস্কার ৬০ হাজার, ১২তম পুরস্কার ৫৮ হাজার, ১৩তম পুরস্কার ৫৬ হাজার, ১৪তম পুরস্কার ৫৪ হাজার, ১৫ তম পুরস্কার ৫৩ হাজার, ১৬ তম পুরস্কার ৫২ হাজার এবং ১৭তম পুরস্কার হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এক্ষেত্রে পুরস্কার বাবদ খরচ হচ্ছে মাত্র ২০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। আয়োজনের আনুষঙ্গিক খরচ আড়াই লাখ টাকা হলেও সর্বসাকুল্যে খরচ হচ্ছে ২৩ লাখ টাকা। বাকি ২১ লাখ ২০ হাজার টাকা যায় আয়োজকদের পকেটে। ভেলুয়ার দীঘিতে এখন পর্যন্ত ৮ সপ্তাহ কথিত ‘বড়শি প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই হিসেবে বড়শি জুয়ার আসর বসিয়ে মোট ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা লাভ থাকার কথা।
যদি রেলওয়ে থেকে মাছ চাষ এবং মাছ শিকারের শর্তে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫ বছরের জন্য ৬০ লাখ ২৪ হাজার টাকায় ১৩.৭৪ একরের ভেলুয়ার দীঘি লিজ নেন কাউন্সিলর লিটনের ভাই আব্দুল মান্নান খোকন।
যদিও লিজ চুক্তির শর্তে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, মৎস্য চাষ/মৎস্য শিকার ছাড়া অন্য কোন কাজে দিঘিটি ব্যবহার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, দিঘি থেকে মৎস্য চাষ/মৎস্য শিকার করার জন্য বা অন্য কোন কাজে ব্যবহার করার জন্য অন্য কাউকে লাইসেন্স/অনুমতি দেওয়া যাবে না এমন শর্ত থাকলেও এসব শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে কথিত বড়শি প্রতিযোগিতার নামে নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, কথিত বড়শি প্রতিযোগিতার জন্য ভেলুয়ার দীঘির দুপাশে কাঠের শক্তপোক্ত বসার আসন তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া কথিত বড়শি প্রতিযোগিতা চলাকালীন কার্যক্রম পরিচালনা ও বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের জন্য মঞ্চও তৈরি করা হয়েছে দিঘির এক পাশে।
জানা যায়, দীঘিতে তেমন মাছ নেই। থাকলেও সেগুলো খুবই ছোট। তাই বড়শি প্রতিযোগিতার আগের দিন কয়েকটি মাছ দীঘিতে ছাড়া হয়। ফলে বেশিরভাগ প্রতিযোগীর ভাগ্যে মাছ জোটে না। এমনটাও হয়েছে ৪০ হাজার টাকায় টিকিট কিনে ২৫০ গ্রাম মাছ না পেয়েও খালি হাতে ফিরে গেছেন অনেকে।
এ বিষয়ে জানতে পাহাড়তলী বড়শি বিতানে টিকিট ক্রেতা হিসেবে যোগাযোগ করা হলে বিক্রেতা বলেন, ‘আমি ওই খেলার ১৪টি টিকেট বিক্রি করি। প্রতিটি টিকেট ৪০ হাজার টাকা হলেও গতকাল ৫৩ হাজার টাকা করেও অনেকে টিকেট কিনেছেন। প্রতি শুক্রবার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলেও এসবের টিকেট শনিবারের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। এসপ্তাহের খেলায় আপনি টিকেট পাবেন না। আগামী শুক্রবারের জন্য টিকেট বুকিং দিতে পারেন।’
একই বিষয়ে জানতে প্যানেল মেয়রের ছোট ভাই খোকনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ‘এটা ভুল নাম্বার’ বলেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে সেই নাম্বার থেকেই ফোন করেন তিনি। অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি কি পুলিশ, প্রশাসন? আপনাকে কেন আমি এই উত্তর দিবো? হ্যাঁ এটা বেআইনি, এখন কি হয়েছে? আমরা বড়শি প্রতিযোগিতা করছি আপনি যা লিখার লিখুন।’
এ প্রসঙ্গে প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন বলেন, ‘এটা যদি জুয়া হয় তাহলে সকল ধরনের প্রতিযোগিতাই জুয়া। সৌখিন মাছ শিকারীরা এখানে মাছ ধরতে আসেন। আমিও এখানে অংশগ্রহণ করি। শুধু আমিই নই, প্রশাসনের অনেকেই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আর এটা আমার ভাই খোকন করছে, আমার নামে হয়তো প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছে। তবে আমি এটা নিশ্চিত নই।’
স্থানীয়রা জানান, দিঘিটি আব্দুল মান্নান খোকন লিজ নিয়ে থাকলেও বড়শি প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং এর পরিচালনা করছেন তার বড় ভাই প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন। মাছ চাষের নামে লিজ নিয়ে এ দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগিতার নামে জুয়ার আসর বসানো নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী মাছ চাষের জন্য দিঘিটি লিজ দেওয়া হয়েছিল। বড়শি প্রতিযোগিতা কিংবা জুয়ার আসরের অনুমতি কখনোই দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমাকে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, যার প্রেক্ষিতে আমি তাদের সাথে কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে বলেছে তারা শুধুমাত্র মাছ ধরার প্রতিযোগিতা করছে। এখানে যদি জুয়া সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় থাকে তাহলে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।’