একুশে প্রতিবেদক : ৫২ বছর আগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জিতেছিলেন তরুণতম নেতা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। আজ অনুষ্ঠিত কক্সবাজার জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৭৭ বছর বয়সী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সেদিনের পরাজিত, বঙ্গবন্ধুর প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেল হকের সন্তান ৪২ বছর বয়সী শাহীনুল হক মার্শাল। কক্সবাজারের মানুষ বলছেন, এ এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রতিশোধ!
তথ্য মতে, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৭ (কক্সবাজার-মহেশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তৎকালীন কক্সবাজার আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম মোজাম্মেল হক। একই সাথে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ওই সময়ের তরুণ ও মেধাবী আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। কিন্তু পাননি।
মনোনয়ন-বঞ্চিত মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। কেউ বুঝতেই পারেননি ২৫ বছরের একজন তরুণের (মোস্তাক) কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হবেন আওয়ামী মনোনীত প্রার্থী। হ্যাঁ, সবাইকে তাক লাগিয়ে বাস্তবেও ঘটেছিল তাই।
নৌকার প্রার্থী এ কে এম মোজাম্মেলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সবাইকে অবাক করে দেন সেদিনের তরুণ মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। বলাবাহুল্য, ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের গণজোয়ারের মাঝেও পূর্ব পাকিস্তানে যে তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছিল তার একটি কক্সবাজারের এই আসনটি।
বঙ্গবন্ধু এতে ক্ষুব্ধ হননি, বরং মোস্তাকের জনপ্রিয়তা দেখে বিস্মিত হন এবং এক পর্যায়ে তাকে কাছে টেনে নেন। বরং ‘৭৩ এর নির্বাচনে তৎকালীন চট্টগ্রাম-১৭ (সদর-রামু) আসনে সেই মোস্তাকের ওপরই আস্থা রাখেন বঙ্গবন্ধু। এ কে এম মোজাম্মেল হকের পরিবর্তে নৌকা তুলে দেন মোস্তাকের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন মোস্তাক।
সেই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও আস্থা রাখেন মোস্তাকের ওপর। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনেও এমপি হন মোস্তাক আহমদ চৌধুরী। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ইমেজ আর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পরাজিত হয়েছিলেন।
তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে চেয়ারম্যান হন এবং টানা প্রায় ১১ বছর কক্সবাজার জেলা পরিষদের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা কক্সবাজার সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও খেলাপির কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে কানিজ ফাতেমাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, কক্সবাজারের বর্তমান প্রশাসক মোস্তাক আহমদ চৌধুরী আজকের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফের মনোনয়ন পান। কিন্তু সেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি প্রয়াত মোজাম্মেল হকের ছেলে মার্শাল। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছেন। নির্বাচনে তার এই জয়কে বিপুল অর্থে কেনা বলে স্থানীয়রা অভিহিত করলেও এ পরাজয়ের জন্য মোস্তাক দম্পতিকেও দুষছেন অনেকে।
তবে জেলার চারজন এমপি, কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মাঠ চষে বেড়ানোর পরও শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে না পারায় সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। খোদ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা বলছেন, টাকা ও একটি পরিবারকে খুশি করতে গিয়ে শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর বিপক্ষে ভোট করেছেন জেলা ও উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়ার নামে হুমকি দিয়েছেন, এটা পরাজয়ের কয়েকটি কারণের একটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালের বিবর্তনে সেই জনপ্রিয়তা ও ইমেজ হারিয়েছেন মোস্তাক আহমদ। প্রায় ১১ বছর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেছেন। একটা সময়ে আত্মম্ভরিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। এমপি হওয়ার পর তার স্ত্রীকেও খুব বেশি কাছে পায়নি কক্সবাজারের মানুষ। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পেয়ে এই রাজনীতিক দম্পতি বেশিরভাগ সময় পার করেন চট্টগ্রাম ও ঢাকার বাসায়। ফলে ক্রমান্বয়ে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আর সেই জনবিচ্ছিন্নতারই ফল আজকের ভরাডুবি।