গণপ্রতারণা দেখেও নীরব থাকে সমবায় অধিদপ্তর!

এম কে মনির : দেশের আইন অনুযায়ী ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান মুনাফার লোভ দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করার অধিকার রাখে না। তবে সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলো চাইলে, নিজ নিজ সদস্যদের অর্থ জমা রাখতে পারে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নামসর্বস্ব ওই সমবায় সমিতিগুলো তাদের সদস্যনির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে উচ্চ হারে মুনাফা প্রদানের লোভ দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের আমানত সংগ্রহ করছে। কিন্তু কথামতো সদস্যদের আমানত ফেরত দিচ্ছে না অনেক সমিতি। আর গণপ্রতারণা ঠেকানোর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে সমবায় অধিদপ্তর। এই অবস্থায় টাকা ফেরত পেতে কখনো সমিতি, কখনো বা জেলা সমবায় দপ্তরের কার্যালয়ে ঘুরছেন শঙ্কিত সদস্যরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘সমবায় সমিতির নামে গণপ্রতারণার চর্চা চলে আসছে বহু বছর ধরে। কিন্তু প্রতারিত মানুষগুলোর টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে প্রশাসন কিছুই করতে পারছে না। যদিও সমবায় সমিতিগুলোর কার্যক্রমের ওপর নিয়মিত নজরদারি করা এবং নিরীক্ষা পরিচালনা করা সমবায় অধিদপ্তরের অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে সমবায় অধিদপ্তর নিবন্ধিত সমিতিগুলোর ওপর নিয়মিত নজরদারি করছে কি না। সেটা করা হলে বার্ষিক নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণীতে তা ধরা পড়ার কথা।’

তিনি আরও বলেন, ‘সমিতিগুলো নিয়মিত পরিদর্শন হয় কি না, সেটাও সন্দেহ আছে। তেমনটি করা হলে সম্পদ আত্মসাৎ পরিদর্শকদের চোখে ধরা পড়ার কথা। এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা হলে বছরের পর বছর ধরে একইভাবে জনগণের টাকা নিয়ে ভেগে যাওয়া কোনো সমিতির পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর শুধু দায়িত্বে অবহেলা নয়, সমবায় অধিদপ্তরের একাংশের যোগসাজশের অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ব্যাপারে সমবায় অধিদপ্তরের জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। তারা উচ্চ মুনাফার প্রলোভন ত্যাগ করলে হায় হায় কোম্পানিগুলোর গণপ্রতারণার সব কলাকৌশল ব্যর্থ হবে।’

সর্বশেষ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে প্রায় ১২শ’ গ্রাহকের ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠেছে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী কয়েক হাজার গ্রাহক তাদের আমানতের টাকা ফেরত পেতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. মুছা মিয়া ও তার স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে বেঁচে না থাকায় টাকা ফেরত পেতে দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের।

অভিযোগ, মো. মুছা মিয়া নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক ২০০২ সালে আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠান করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে উপজেলা সমবায় অধিদপ্তর থেকে সমিতিটির নিবন্ধন নেন তিনি। যার নিবন্ধন নং ৮৩০৯। নিবন্ধন নিয়েই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ৩, ৪ ও ১০ বছর মেয়াদ শেষে জমাকৃত টাকার দ্বিগুণ ফেরত দেয়া হবে জানিয়ে লোভনীয় প্রস্তাব দিতে থাকেন মুছা। আর এ ফাঁদে পা দিয়ে অসংখ্য গ্রাহক টাকা জমাতে থাকেন আল আমানত সমিতিতে। এভাবে ৫ বছর চলার পর ২০১০ সাল থেকে সমিতিটি দেউলিয়া হতে শুরু করে।

২০১৭ সালে সমিতির মূল প্রতিষ্ঠাতা মো. মুছা মিয়া স্ট্রোক করে মারা যান। এরপর তার স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন সমিতির দায়িত্ব নেন। কিন্তু গ্রাহকদের জমাকৃত অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হন সমিতিটির প্রধান নির্বাহী রুবিনা ইয়াসমিন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে রুবিনা ইয়াসমিন সমিতির দেউয়ালিত্ব সইতে না পেরে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যুর পর সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুছা মিয়ার বড় ছেলে মোশাররফ হোসেন (১৮)। তবে তিনিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। এতে গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত টাকা ফেরত পেতে কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন সুফল পাননি। বর্তমানে প্রায় ১২শ’ নারী-পুরুষ সদস্য জমাকৃত টাকা ফেরত না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

গ্রাহকদের অভিযোগ, সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. মুছা মিয়া ছিলেন একজন দিনমজুরের ছেলে। পেশায় তিনি ছিলেন মাদ্রাসার সামান্য বেতনের শিক্ষক। কিন্তু আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তিনি কোটিপতি বনে যান। সমিতির টাকায় তিনি সীতাকুণ্ড পৌরসদরের ভোলাগিরি আশ্রমে বানিয়েছেন বহুতল বাড়ি, ছেলেকে কিনে দিয়েছেন দামি গাড়ি। এছাড়াও অভিযোগ আছে, একসময় ভিটেমাটি না থাকা মুছা মিয়া উপজেলার জোড়ামতল, পৌরসভার চৌধুরী পাড়ায় ক্রয় করেছেন কয়েক একর জমি৷ সীতাকুণ্ড বাজারে গড়ে তুলেছেন নামিদামি কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবসা, নিয়েছেন অন্তত ৬ টি দোকান। মুছা মিয়ার শ্যালক সাইফুল ইসলামও আল আমানত সমিতির দায়িত্ব নিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।

প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টাকা ফেরত পেতে বছরের পর বছর আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির কার্যালয়ে ঘুরলেও কেউ সাড়া দেয়নি। এমনকি কার্যালয় বন্ধ করে একপ্রকার গা-ঢাকা দিয়েছেন সমিতির প্রতিষ্ঠাতার ছেলে। অথচ সমিতির গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকায় বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা গড়ে তুলেছেন মো. মুছা মিয়া। যা বর্তমানে তার দুই ছেলে ভোগ করছেন।

মিরসরাইয়ের ডোমখালীর বাসিন্দা মুন্নি আক্তার বলেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বহু কষ্টে অর্জিত ২ লাখ টাকা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জমা করেছি। তারা বলেছিল ৫ বছর পরে তার দ্বিগুণ ফেরত দিবে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও এখনো মুনাফা দূরের কথা আসলও ফেরত পাইনি। এখন সমিতিটি একেবারেই উধাও।’

সৈয়দপুর ইউনিয়নের বগাচতরের বাসিন্দা মৌসুমী বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ৯ সদস্য আল আমানতে সঞ্চয় করেছি। বর্তমানে এ সমিতির কাছে আমাদের পরিবারের সাড়ে ৩ লাখ টাকা জমা রয়েছে। এছাড়াও আমাদের এলাকায় এ সমিতির ২২ জন সদস্য, যাদের অন্তত ১২ লাখ টাকা সমিতিতে জমা আছে। তারা কেউ টাকা ফেরত পায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সমিতিতে টাকা জমা করতে একসময় স্বামীকে রাজি করিয়েছি। আমার মতো অনেক গৃহবধূও এ কাজটি করেছে। কিন্তু এখন টাকা ফেরত না পাওয়ায় সংসারে কলহ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি অনেকের সংসারও ভাঙার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

খালেদা আক্তার নামে আরেক গ্রাহক বলেন, ‘আমি ১০ বছর মেয়াদে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা জমা করেছি। ১০ বছর শেষ হয়ে ১১ বছর চললেও টাকা ফেরত পাইনি। তারা বলেছিল আসলসহ দ্বিগুণ টাকা ফেরত দিবে। অথচ আসল দূরে থাক সমিতিকেও খুঁজে পাচ্ছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকায় অন্তত ২০ জনের অধিক সদস্য প্রত্যেকে ২ লাখ টাকা করে ডিপোজিট করেছে; সবাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মো. মুছা মিয়ার বড় ছেলে মোশাররফ হোসেনকে মুঠোফোন কল দিলে তিনি সাড়া দেন না। অফিসে গেলে তালাবদ্ধ দেখা যায়। আমি সমিতিটির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মো. হোসেন বলেন, ‘দ্বিগুণ লাভের আশায় আমি প্রায় ২ লক্ষ টাকা জমা করেছি আল আমানত সমিতিতে। মেয়াদ শেষ হলেও এখনো টাকা পায়নি। অনিশ্চয়তায় ভুগছি আদৌ টাকা ফেরত পাবো কিনা?’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মোঃ মুছা মিয়ার ছেলে মোশাররফ হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের তিনটি ব্যাংক হিসাবে টাকার পরিমাণ, পাঁচতলা ভবন, জমি ও দোকানের হিসাব উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা দিয়েছি। আমরা বলেছি যে এসব বিক্রি করে যেন গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। গ্রাহকরা আমাদের কাছে ঠিক কতো টাকা পাবে তাও আমার জানা নেই। মায়ের মৃত্যুর পর আমি দায়িত্ব নিলেও সঠিক কোন হিসাব আমরা পাইনি। আমাদের বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা সবকিছু সমিতির টাকায় বাবা করেছেন। আমরা এখনো উপার্জনক্ষম হইনি। তাই এসব আমাদের নয় মর্মে অঙ্গীকার দিয়েছি।’

জানতে চাইলে আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির মাঠকর্মী পারভিন আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ছিলাম সমিতির স্টাফ মাত্র। যখন যা টাকা মাঠ থেকে তোলা হয়েছে সব টাকা প্রধান নির্বাহীর কাছে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা মুছা মিয়া এসব টাকা তার একাউন্টে রাখতেন। মৃত্যুর আগে স্ত্রীর একাউন্টে রেখে গেছেন। গ্রাহকদের টাকা তারা আত্মসাৎ করেছেন সেটি আমরাও বুঝে ওঠতে পারিনি। চাকুরিজীবি হিসেবে আমাদের যা বলা হতো আমরা তাই করতাম। সমিতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা অবগত ছিলাম না।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আব্দুল শহীদ ভূঁইয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আল আমানত সমিতির ব্র্যাক ব্যাংক হিসাব থেকে ১ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও পূবালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা উদ্ধার করে গ্রাহকদের মাঝে আনুপাতিক হারে ফেরত দেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সমিতির মালিকদের জমি, বাড়ি, দোকান সবকিছু বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া হবে। যদি তাতেও সংকুলান না হয় তাহলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে টাকাগুলো মুছা মিয়া তার স্ত্রীর নামে রেখে গেছেন এবং ব্যাংক হিসাবে নমিনি করেছেন দুই ছেলেকে। আবার কোন ব্যাংক হিসাবে ছোট ছেলেকে নমিনি করেছেন। ওই ছেলে বর্তমানে পূর্ণবয়স্ক না হওয়ায় টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছে না। তাই আদালতের মাধ্যমে মামলা দায়েরের পর টাকা উত্তোলন করে গ্রাহকদের কাছে ফেরত দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। সকল প্রক্রিয়া শেষ হলে সমিতিটির নিবন্ধন বাতিল করা হবে।’

আব্দুল শহীদ ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতি সমবায় আইন লঙ্ঘন করেছে। এ সমিতি বার্ষিক অডিটে তথ্য গোপন করেছিল। যার ফলে অডিট রিপোর্টে সেটি ধরা পড়েনি। গ্রাহকের কাছ থেকে তারা এতো বেশি পরিমাণ টাকা যে সংগ্রহ করেছে তা আমরা জানতে পারিনি। সমবায় বিধি অনুসারে এটি তারা করতে পারেন না। তাছাড়া সমিতির নামে টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত না রেখে সমবায় সমিতির সভাপতি মুছা মিয়া তার স্ত্রীর নামে রাখে। এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা অন্যান্য সমবায় সমিতি এরকম কাজ করছে কিনা তা নজরে রাখছি। আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির এমন অবস্থার দায় আমরাও এড়াতে পারি না। তবে ভবিষ্যতে সতর্ক হব।’

চট্টগ্রাম জেলা সমবায় কর্মকর্তা মুরাদ আহাম্মদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের আল আমানত বহুমুখী সমবায় সমিতির অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ না পেলেও বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। একইসাথে থানায় ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। এবং উপজেলা সমবায় অফিসার বিষয়টি দেখভাল করছেন। ওই সমিতির ব্যবসা, জমিজমা কি আছে সেসব সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়া হবে।’

এদিকে সরকারের সমবায় অধিদপ্তর ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত উধাও হয়ে যাওয়া প্রতারক সমিতিগুলোর ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২৬৬টি ‘সমবায় সমিতি’ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করার পর তা আর ফেরত দিচ্ছে না; অধিকাংশই অফিস গুটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের সবচেয়ে আলোচিত অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে ইপিজেড এলাকায়। এলাকার রূপসা সমবায় ও ঋণদান সমিতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইপিজেড এলাকায় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অতিমুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়েও নিয়েছে। সম্প্রতি ইপিজেড এলাকার বেশকিছু গ্রাহক অর্থ ফেরত নিতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি তা দিতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত না দিয়ে কার্যালয়ে তালা দিয়ে পালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা।

চট্টগ্রাম জেলা সমবায় কার্যালয়ের তথ্যমতে, সিটি করপোরেশন এলাকায় সমবায় দপ্তরের জোন রয়েছে তিনটি। পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও কোতোয়ালি থানাকে জোন ধরে সমবায় ও ঋণদান এবং বহুমুখী সমবায় সমিতি নিবন্ধন দেয় সমবায় কার্যালয়। এর মধ্যে ডবলমুরিং থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ৩৬৩টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক লেনদেনের নিবন্ধন নিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাঁচলাইশ জোনে ১৭১টি এবং কোতোয়ালি জোনে ১০৬টি প্রতিষ্ঠান সমবায়ের নিবন্ধন নিয়েছে।

ইপিজেড এলাকার সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা রূপসা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমবায় সমিতি ও প্রাইম স্টার সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ দুটি মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান সিইপিজেডের সামনের একটি শপিং মলে অফিস নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। দুটি প্রতিষ্ঠানই ২০২১ সালের শেষ দিকে গ্রাহকদের হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ পরিশোধ না করে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। শ্রমজীবীদের আকৃষ্ট করতে প্রতিদিন বিকাল থেকে অফিস কার্যক্রম পরিচালনা, সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে ঋণ গ্রহণ কিংবা সঞ্চয়ের টাকা জমা নেয়ার সুযোগ নিয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করে প্রতিষ্ঠান দুটি।

একইভাবে সিইপিজেডের সামনের চৌধুরী মার্কেটে ভাড়া অফিসে কার্যক্রম শুরু করে প্রাইম স্টার। এ প্রতিষ্ঠানও হাজার হাজার গ্রাহকের কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রূপসার চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান এবং একই মাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ডবলমুরিং জোনের সমবায় কর্মকর্তা সুমিত কুমার দত্ত বলেন, সমবায়ের নিবন্ধন নিয়েও অনিয়ম আর প্রতারণার কারণে আমরা প্রতিষ্ঠান দুটির স্থাবর সম্পত্তি রেজিস্ট্রি না করতে এরই মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, এসিল্যান্ড অফিসে চিঠি দিয়েছি। ইপিজেড এলাকার সব ব্যাংকের রূপসা ও প্রাইম স্টারের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে চিঠি দেয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সমবায় সমিতি খুলে অধিক লাভের লোভ দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ফটিকছড়ির ফারুকিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সলিমুল্লাহকে কারাগারে পাঠানো হয়। জানা যায়, ২০০৭ সালে এহসান এস নামে মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠানটির ফটিকছড়ির নাজিরহাটে শাখা খোলেন মাওলানা সলিমুল্লাহ। উচ্চ হারে লাভ দেয়ার কথা বলার পাশাপাশি হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার সুবাদে অল্পদিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে জমিয়ে তোলেন তিনি। তবে এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের দিকে হাজার খানেক গ্রাহকের প্রায় ৫ কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ক্যাশিয়ার মাওলানা মনির হাসান গা-ঢাকা দেন।

গ্রাহকদের অভিযোগ, মাওলানা সলিমুল্লাহ’র যোগসাজশে মনির এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা সে সময় সলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে কয়েক দফা মানববন্ধন ও ঝাড়ু মিছিল করেছে। এসব অভিযোগে তারা ফটিকছড়ি থানা ও আদালতে ৭টি মামলা দায়েরও করেছেন।

চট্টগ্রাম জেলা সমবায় কর্মকর্তা মুরাদ আহাম্মদ বলেন, ‘কোন সমবায় সমিতি যদি সমবায় আইন লঙ্ঘন করে তাহলে সদস্যরা যেন আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তাহলে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সহজ হবে।’