জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : মাস পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ গঠিত তদন্ত কমিটি। যদিও কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে গঠিত ২ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিকে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সময় দেওয়া হয়েছিল ১০ দিন।
কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনের অর্ধেক কাজও শেষ করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অভিযোগ সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের পর্যায়েই স্তিমিত তদন্ত কার্যক্রম। এমনকি মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে আসেননি তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুই নেতা কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক আমজাদ খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আজিম।
তদন্তের ধীরগতির কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় এ দুই নেতা সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ততাকেই অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন। তাদের মতে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সময় নিয়েই তদন্ত করতে চান তারা।
দেবুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তদন্ত প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক আমজাদ খান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ তদন্তের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি এ বিষয়ে অনেকের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। আরও অনেকের সাথে কথা বলা বাকি। তদন্তের ৬০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।’
অন্যদিকে, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আজিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মত করে আগাচ্ছি। আর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলেও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সময় বাড়তে পারে। আমরা সবকিছু সংগ্রহ করছি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী তদন্ত করে আমরা প্রতিবেদন কেন্দ্রে হস্তান্তর করবো।’
তদন্তের স্বার্থে চট্টগ্রামে আসবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে আগে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো যাচাই করতে হবে। এসব কার্যক্রম করতে গিয়ে আমাদের যদি চট্টগ্রামে যাওয়ার দরকার হয়, আমরা যাব। তবে কবে নাগাদ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না।’
এদিকে, তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন দেবু। কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে ঢাকায় গিয়ে ছবি তুলে ফেইসবুকে প্রচার করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজকে নিয়েও ঢাকায় ঢু মারছেন দেবু। অভিযোগ আছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের অজুহাতে ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন দেবু।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী ১ নভেম্বর থেকে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে। সাক্ষ্য দিতে প্রবাসী বন্ধন নাথ দেশে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে দলের ইমেজ রক্ষার্থে মামলার গতিবিধি দেখে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হতে পারে, এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বিলম্বের এটাই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংগঠনটির একাধিক নেতা।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের সভাপতি (দেবু) নির্দোষ প্রমাণিত হোক এটা আমরা সবাই চাই। তবে তিনি যদি আসলেই দোষী হয়ে থাকেন তাহলে তো এটা দলের জন্য সুখকর হবে না। তদন্ত প্রতিবেদন নিজের পক্ষে আনতে তিনি (দেবু) তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। দিনের পর দিন ঢাকায় সময় কাটাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।’
সংগঠনের আরেকজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ‘১ নভেম্বর থেকে তার (দেবু) মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। দেবুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে মামলার বাদী ভুক্তভোগী প্রবাসী বন্ধন নাথ দেশে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারা মামলার গতিবিধি দেখে সেই অনুযায়ী তদন্তের মোড় ঘোরাতে পারেন বলে আলোচনা হচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গাজী মেজবাহুল হোসেন সাচ্চু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সংগঠনের দায়িত্বশীল কোনো নেতা যদি গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কাজ করে, যা সংগঠনের সম্মানকে ক্ষুন্ন করে এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে, সেক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রেই বলে দেওয়া আছে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেবুর চাঁদাবাজির বিষয়ে কেউ বলে সে নির্দোষ, আবার কেউ বলে সে দোষী এর তথ্য-প্রমাণাদিও আছে। তাই সত্যিটা জানতেই আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এখানে পক্ষপাতিত্বের কোন সুযোগ নেই। গত পরশুও আমি দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন তদন্ত কার্যক্রম মোটামুটি গুছিয়ে আনা হয়েছে। দু-চার দিনের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।’
সাক্ষ্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে তদন্ত প্রতিবেদনে মোড় ঘুরতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাচ্চু বলেন, ‘আদালত যদি দেবুর বিপক্ষে রায় দেয় তাহলেও কিন্তু দেবু হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা এসবের জন্য অপেক্ষা করবো না। তদন্ত কমিটি যদি তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায় সেটাই আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে। আর তদন্তে একবার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি সে পাবে।’
এর আগেও চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও প্রবাসীকে গুলির ঘটনায় দলের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করে জিরো টলারেন্সের আভাস দিয়েছিল কেন্দ্র। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে দেবু সর্বোচ্চ শাস্তি (সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি) পাবেন বলেও জানিয়েছিলেন সাচ্চু।
উল্লেখ্য, চাঁদাবাজির ঘটনার ৪ বছর পর গত ২১ আগস্ট এ মামলায় দেবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। এর আগে আসামিরা আদালতে হাজির হয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করলেও তা খারিজ করে দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে কুয়েত প্রবাসী বন্ধন নাথ দেশে এসে নগরের পাঁচলাইশে তার পুরনো একটি ভবন ভেঙে নতুন করে বাড়ি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় তার কাছ থেকে পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবু এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে অভিযোগ উঠে। চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে দেবুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা প্রবাসীকে প্রথমে মারধর ও পরে পিঠের ডানপাশে গুলি করেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে সমঝোতা হলে ভুক্তভোগী বন্ধন নাথ কুয়েতে ফিরে গিয়ে প্রাইম ব্যাংকের পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা পরিশোধ করেন। কিন্তু বাকি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ না করায় বাড়ির নির্মাণ কাজে বাধা দেন দেবু। এ ঘটনায় বন্ধন নাথ ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেবুসহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে পাঁচলাইশ থানায় চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পরদিন দেবাশীষ নাথ দেবুসহ তার সহযোগী এটিএম মঞ্জুরুল ইসলাম রতনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ১৬ দিনের মাথায় তারা জামিনে বেরিয়ে যান। আগামী ১ নভেম্বর থেকে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।