আবছার রাফি : চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব এবং ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর দীর্ঘদিনের আগুন-সম্পর্ক পানি পেল রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে।
সেই আগুনে পানি ঢালার কাজটি হয়েছে শনিবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার আলহাজ্ব নুরুচ্ছফা তালুকদার অডিটোরিয়ামে। আর এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম চৌধুরী ও রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মো. শাহজাহান সিকদার।
এর আগে আগামি ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের সমর্থনে রাঙ্গুনিয়ার বিভিম্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
রাঙ্গুনিয়ার ২১১ জন জনপ্রতিনিধি ছাড়াও এটিএম পেয়ারুল ইসলামের সাথে ফটিকছড়ি থেকে যাওয়া অন্তত ৫০ জন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন সেই মতবিনিময়ে। সঙ্গে ছিলেন ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তুমুল বৈরি সম্পর্কের দুই আলোচিত চরিত্র আবু তৈয়ব ও নাজিম উদ্দিন মুহুরী।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সহ সভাপতি আবদুল মোনাফ সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান স্বজন কুমার তালুকদার, জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম চিশতি, পৌর মেয়র শাহজাহান সিকদার, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী মো. খালেদ মাহমুদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুষ্ঠান-শেষে অতিথিদের সম্মানে পৌরসভার হলরুমে পৌর মেয়র শাহজান সিকদারের আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন এটিএম পেয়ারুল ইসলাম চৌধুরী, তার সাথে যাওয়া লোকজন ও অনুষ্ঠানের অতিথিরা। আবু তৈয়ব ও নাজিম উদ্দিন মুহুরী দুজন দুপ্রান্তে বসতে চাইলে এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নজর কাড়ে বিষয়টি। এক পর্যায়ে তিনি তাদের তার কাছেই পাশাপাশি বসানোর উদ্যোগ নেন।
আর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন পৌর মেয়র শাহজাহান সিকদার। তারা আলোচ্য দুজনকে খাবার টেবিলে পাশাপাশি বসিয়ে দেন। এ পরিস্থিতিতে তারা কিছুটা ইতস্ততবোধ করলেও নেতাদের অনুরোধে পাশাপাশি বসে খেয়েছেন শুধু নয়, পরস্পর সৌজন্যমূলক আলোচনাও করেছেন।
এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত অনেকেই নতুন করে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এটাই রাজনীতির সৌন্দর্য। আশা করি দলের বৃহত্তর স্বার্থে সব বিভেদ ভুলে আজকের পর থেকে তারা সুন্দরের পথেই হাঁটবেন, রাজনীতির ঐক্যকে সুদৃঢ করবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া পৌর মেয়র শাহজাহান সিকদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দুজনেই বঙ্গবন্ধুর আদশের তুখোড় কর্মী, দলের শক্তি। দল ও সরকারের স্বার্থে এই দুই শক্তি এক থাকলে দলের জন্যই লাভ। দেখতেও সুন্দর লাগে। আজকে এই দুই নেতা দীর্ঘদিনের বিভেদ ভুলে পাশাপাশি বসে খেয়েছেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। আশা করি ফটকছড়ির ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির স্বার্থে এই সৌন্দর্য অটুট রাখবেন তারা।’
এ প্রসঙ্গে ফটিকছড়ির সন্তান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সদস্য বখতিয়ার সাঈদ ইরান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে এবং দলের দুঃসময়ে লড়ে যেতে ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প নেই। আশা করি এই দুই নেতা আগামিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি পরিহার করে ফটিকছড়ির রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবেন।’
আজকের সৌন্দর্য আগামিতেও বহাল থাকবে কিনা তা জানতে ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তৈয়বের মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন মুহুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তৈয়বের সাথে আমার সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নেই। ব্যক্তিগত বিরোধও নেই। আচার-আচরণে যেটা হয়েছে সে বিষয়ে এখন তার যদি শুভ বুদ্ধির উদয়, ভালো করে চলতে চায়, তাহলে আমরা কেন তাকে বাদ দেব? দল তো আমার কোনো নিজস্ব সম্পত্তি না যে ওনাকে বাদ দিয়ে আমি মালিক হয়ে গেলাম। দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতা আমার নেই।’
জানতে চাইলে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দল ও রাজনীতির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধতার বিকল্প নেই। বিষয়টি তারা বুঝতে পেরেছেন। কারণ তারা দুজনই তুখোড় রাজনৈতিক কর্মী। আর সেটিরই বহিঃপ্রকাশ আজকে রাঙ্গুনিয়ায় একসাথে যাওয়া এবং পাশাপাশি বসে খাওয়া। অবশ্য গত ২ অক্টোবরে পর থেকে তারা দুজন আমার পক্ষে বিভিন্নভাবে প্রচারণায় একসাথে যাচ্ছেন। আমরা চেষ্টা করছি সকল ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসতে।’
প্রসঙ্গত, আবু তৈয়ব ও নাজিম উদ্দিন মুহুরী দুজনই তৃণমূল থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে উঠে আসা নেতা। উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফটিকছড়িতে বিএনপি-জামায়াত-দুর্গের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন আবু তৈয়ব। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
অন্যদিকে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল তা শুধু নয়, বারে বারে মুহুরীর উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে। তাকে জেলে পাঠিয়েছে বহুবার। তার উপর নির্যাতনের চিত্র এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মুহুরীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, বিএনপি-জামায়াতবিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে সন্তানের কারণে নাজিম উদ্দিন মুহুরীর বৃদ্ধা মাকে পর্যন্ত অন্যায়ভাবে জেলে পুড়েছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি।
এদিকে, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে নাজিম উদ্দিন মুহুরীর কাছে ২২ ভোটে হেরে যান আবু তৈয়ব। তৈয়ব মনে করেন ষড়যন্ত্র করে তাকে হারানো হয়েছে। সে থেকেই তাদের মধ্যে দূরত্ব ও অন্তর্কলহ শুরু হয়।
এরপর ২০১৮ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুজনই মনোনয়ন চান। কিন্তু মনোনয়ন পান নাজিম উদ্দিন মুহুরী। এতে বেঁকে বসেন তৈয়ব। হন বিদ্রোহী প্রার্থী। দল থেকে বহিষ্কৃত হন আবু তৈয়ব। এরপরও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নাজিম উদ্দিন মুহুরীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন আবু তৈয়ব। এরপর থেকে এই দুজনের বিরোধ প্রকাশ্য ও চরম আকার ধারণ করে। রাজনীতির সমস্ত শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি বাক্যসন্ত্রাস, বিষোদ্গার করতে থাকেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের আক্রমণাত্মক, যুগপৎ অশালীন বক্তব্য বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় ফটিকছড়ির রাজনীতিতে।