একাত্তরে লড়েও মেলেনি স্বীকৃতি, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এখন ‘নাইটগার্ড’


আবছার রাফি : মো. ইউসুফ আলী (৭২)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্ত্রী ও দুই বছরের কন্যাসন্তানকে ঘরে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা ইউসুফ আলী এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। গ্যারেজের নাইট গার্ডের চাকরি করে আসা ইউসুফ আলীর প্রতিটি দিন কাটছে অভাব আর অনটনের সাথে যুদ্ধ করেই।

ইউসুফ আলীর বাবার নাম নুরুল আলম। বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ সরফভাটা মীরের খীল গ্রামে। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন ১ নং সেক্টরের অধীন রাঙ্গামাটি, মাইনি, বরকল ও খাগড়াছড়ি এলাকায় রণাঙ্গনের সৈনিকদের সাথী ছিলেন। বহুবার সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধকালীন তার কমান্ডার ছিলেন আবদুল জলিল।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বপক্ষে ভারতে প্রশিক্ষণ, স্বাধীনতা সনদপত্র, অস্ত্র জমাদানের রশিদসহ সবই আছে তার; কিন্তু নেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি, সরকারি তালিকায় নাম। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে। তালিকায় স্থান পেতে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের দলিলপত্র নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আবেদন করেছিলেন ইউসুফ আলী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার নামটি সরকারি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পায়নি।

সর্বশেষ ২০০৭ ও ২০১৪ সালে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ‘রাঙ্গুনিয়ার তালিকাবিহীন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকায়’ মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীর নাম লিপিবদ্ধ হলেও রহস্যজনক কারণে এখনও তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।

একুশে পত্রিকার এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা, দারিদ্রের কারণে সংসারের টানপোড়েন ও যুদ্ধ দিনের গল্প বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন ইউসুফ আলী।

জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে ইউসুফ আলী একুশে পত্রিকাকে জানান, তিনি ৯ম শ্রেণিতে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর পারিবারিক উৎসাহে নিকটাত্মীয় হাসিনা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হাসিনা বেগমের বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া এলাকায়। বিয়ের পর ইউসুফের আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই চট্টগ্রাম নগরীতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতে ছুটেছেন কাজের তাগিদে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি নগরীর ষোলশহর এলাকায় থাকা তার ফুফির বাসায় যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তার সাথে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎ হয়। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা যে কয়েকজন বিদ্রোহী সেনার সাথে তাঁর দেখা হয়, তারা তাকে বললেন- বোয়ালখালীর পথটা যদি তাদেরকে দেখিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা খুব উপকৃত হবেন।

ইউসুফের শ্বশুড়বাড়ি বোয়ালখালী হওয়ার সুবাধে তাদেরকে সেখানে নিয়ে যান। সেখানে সেনা সদস্যদের সাথে কয়েকদিন থেকে তাদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। এ সময় সেনাদের মধ্যে একজন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান’। এর তিনদিন পর মেজর জিয়াউর রহমান তাকে রাঙ্গুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অশোক মিত্র কারবারির সাথে দেখা করতে বলেন। পরে তিনি রাঙ্গুনিয়ায় গিয়ে দেখা করলে অশোক মিত্র কারবারি তাকে ভারতের দেমাগ্রী আর্মি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেন।

প্রশিক্ষণ শেষেই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন ইউসুফ আলী। তিনি ১ নং সেক্টরের অধীন রাঙ্গামাটি, মাইনি, বরকল ও খাগড়াছড়ি এলাকায় রণাঙ্গনের সৈনিকদের সাথী ছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে তিনি অস্ত্র জমা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তার নামটি সরকারি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পায়নি।

ইউসুফ আলী বলেন, ‘বউ-মেয়ের মুখের দিকে চাইনি। শেখ সাহেবের ভাষণ শুনলে আমার ভেতর উত্তেজনা কাজ করতো। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তাছাড়া শুরু থেকেই আমি আওয়ামী লীগ করতাম। এই সরফভাটা এলাকায় আওয়ামী লীগ করতাম আমরা কেবল ১৪-১৫ জন। বেশিরভাগই করতো মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগ যারা করতো তাদের চাপে রাখা হতো। আমার বন্ধু হাশেম, কালাম, আহমেদ মিয়া, আলী আকবর, নুরুল আজিমসহ সবাই যখন মুক্তিযুদ্ধে চলে যাচ্ছে তখন ভাবলাম আমি না গিয়ে থাকবো কেন?’

‘তৎকালীন সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পঁচাত্তর পরবর্তী রাঙ্গুনিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমার মামা হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ ও সহযোদ্ধা মাহমুদ হোসেন মেম্বারও আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। মামা ও সহযোদ্ধা আমাকে এক কেজি চিড়া ও মিঠা একটি থলে বেঁধে দিলেন। অসোক বাবুর নির্দেশনায় ভারতে যাওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের ১৫ দিনের ট্রেনিং দেয়। তারপর একদিন ভারতীয় সেনারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা কেউ স্পিডবোট চালাতে পারি কি না?’। তখন আমি হাত তুলি। এবং তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ি। এদিকে যে আমার স্ত্রী আর কন্যাকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম, তারা কীভাবে থাকবে, কীভাবে চলবে; তা আমার মামা আর আল্লাহই জানতেন। এ ব্যাপারে আমার হুঁশও ছিল না, খেয়াল ছিল না। তারপর চলে গেছি আল্লাহর নাম নিয়ে। এভাবে ঘর থেকে বের হয়ে সাতমাস পরে ঘরে ফিরেছি।’

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বপক্ষে ইউসুফের কাছে রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনী ওসমানী স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র, সামরিক প্রশাসকের সার্টিফিকেট, যুদ্ধ পরবর্তী অস্ত্র জমাদানের রশিদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা কমান্ডার ও ইউনিয়ন কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০০৭ সালে তালিকাবিহীন মুক্তিযোদ্ধাগণের যাচাই-বাছাই তালিকা প্রেরণের বিভিন্ন তথ্য এবং ২০১৪ সালে আবেদনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।

বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের শুলকবহর এলাকায় একটি গ্যারেজে রাত্রিকালীন পাহারাদার হিসেবে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন ইউসুফ আলী; আক্ষেপের সুরে তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এরশাদ সরকার গেল, বিএনপি সরকার গেল, আওয়ামী লীগ সরকার গেল; আমি বারবার চেষ্টা করার পরও তারা আমাকে সরকারি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান দেয়নি। এখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের দীর্ঘ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আমি বঞ্চিত। আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি নিয়ে মরতে চাই।’

ইউসুফের স্ত্রী শামসুন নাহার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার স্বামী ইউসুফ আলী ২৫ বছর ধরে শহরে গ্যারেজে চাকরি করছেন। মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান পেতে আবেদনে করার সময় একটা কাগজ বা সিগনিচারের জন্যও টাকা দিতে হয়েছে। এভাবে ধার-কর্য করে অনেক টাকা পয়সা আমাদের খরচ হয়েছে। এসব টাকা পরিশোধের জন্য কিস্তিতে টাকা নিয়েছি এনজিও থেকে। বারবার আবেদন করার পরও তালিকায় স্থান না পাওয়ায় আমার স্বামী খুবই হতাশ। একদিকে সংসারের চালাতে বৃদ্ধ বয়সে নাইটগার্ড হিসেবে চাকরি করছেন অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ করেও পদে পদে নাজেহাল হচ্ছেন; এসব তিনি মেনে নিতে পারছেন না। দুইবার স্ট্রোকও করেছেন তিনি।’

সরফভাটা মীরের খীল এলাকার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইউসুফ আলীর সহযোদ্ধা আবুল কালাম চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ইউসুফ আলী মুক্তিযুদ্ধ করেছে। সে ভারতীয় সেনাবাহিনীদের স্পিডবোটের ড্রাইভার ছিল। যুদ্ধকালীন ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পরে তাকে সেনাবাহিনীদের ড্রাইভার বানানো হয়েছে। সরাসরি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে। ইউসুফ আলীর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার এখনো স্বীকৃতি না পাওয়া খুবই দুঃখজনক।’ জানতে চাইলে হুবহু একই বক্তব্য দিয়েছেন একই এলাকার আরেক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর।

এদিকে ইউসুফ আলীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে সহযোদ্ধা আবুল কালাম চৌধুরী ও আলী আকবরের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় ইউসুফ আলীর হাতে থাকা যুদ্ধকালীন সময়ের রাঙ্গুনিয়ার সামরিক প্রশাসক মেজর মোহন চৌহান স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেটে। যে সার্টিফিকেটে মুক্তিবাহিনীর রাঙ্গুনিয়ার অধিনায়কের স্বাক্ষরও রয়েছে। ওই সার্টিফিকেটে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রামের সরফভাটা এলাকার মো. নুরুল আলমের ছেলে মো. ইউসুফ আলী মুজিব বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি উত্তর চট্টগ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে একজন সহযোগী হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং শত্রুর প্রতিরক্ষায় প্রকৃত আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম সরওয়ার কামাল দুলু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়নের ব্যাপার। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাজ হচ্ছে কেউ যদি এরকম তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আসে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো। আমি বলব, যদি ওনার কাগজপত্র ঠিক থাকে তাহলে যেন ইউএনও ও উপজেলা কমান্ডারের সাথে দেখা করেন। তারাই ভালো সমাধান দিতে পারবেন।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার খায়রুল বশর মুন্সী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ইউসুফ আলীকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলাম। সব কাগজপত্র থাকলে তো হবে না। জায়গা বরাবর তো যেতে হবে। ২০০৭ ও ২০১৪ সালে আবেদন করে থাকলে উপজেলাতে ওনার ডিসি নাম্বার আছে। যদি ডিসি নাম্বার থাকে তাহলে জামুকাতে গিয়ে আপিল করতে পারবে। আমি জানি না, আপিল করার সময় এখনো আছে কিনা।’

বারবার আবেদনের পরও ইউসুফ আলীর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউল গণি ওসমানীর সাথে। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যাচাই-বাছাই করে নতুন তালিকা প্রেরণের সময় আমি রাঙ্গুনিয়ায় ছিলাম না। যদি উপজেলা থেকে মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই তালিকা পাঠানো হয়ে থাকে, তাহলে মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিলেই জানা যাবে, কেন তিনি বাদ পড়েছেন। আর এখন ওনি যদি আমাদের কাছে আবেদন দেন তাহলে সেটি ফরোয়ার্ড করে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারব। কাগজপত্র নিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে সেক্ষেত্রে আমাদের যা যা করণীয় তা আমরা করবো।’