হোসেন আবদুল মান্নান : কলকাতা শহরটা সত্যিই আমাকে টানে। কেন এতটা ভালো লাগে তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। তবু মনে হয় এখানে সব আছে।
যে শহরের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে একজনও আমার বন্ধু, নিকটাত্মীয় বা স্বজন নেই সেখানটার প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার আছে। আর এর প্রধান কারণ ইতিহাস। দ্বিতীয় কারণ মনস্তাত্ত্বিক।
ব্রিটিশদের আগমন এদের স্থাপত্যের আদি নিদর্শনসহ আমাদের রাজনীতির ইতিহাস, নিজের দেশকে টুকরো করে দেয়ার ইতিহাস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দুর্ভিক্ষসৃষ্টির ইতিহাস সবই এখানে স্থির এবং বলবৎ আছে।
আজকের কলকাতা মানে বহুজাতি, বহুভাষী মানুষের মহাকাব্যিক এক মহানগর। একদা পাঠ্য পুস্তকে পড়া থোকা থোকা ইতিহাসের রক্তচিহ্ন স্বচক্ষে অবলোকন করার সাক্ষাত সুযোগ করে দেয় এ শহর। তবে এটা হলফ করেই বলা যায়, ঘুরে দেখা ছাড়া আর অন্য কোনো অভিলাষ থেকে আমি একাধিকবার কলকাতা সফর করি নি। আমার চাওয়া একেবারেই ভিন্ন।
২) এবারে যে দুয়েকটা নতুন জায়গায় গিয়েছি
তার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক বাড়ি দেখতে যাই। বাড়িটি আমাদের সুখ দুঃখের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।
মনে হয়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পর কলকাতা শহরের এলগিন রোডের (লালা লাজপত রাই সরণি) এ বাড়িই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এটি বসু হাউস বা নেতাজী ভবন। বলা যায়, অন্তত দু’জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি এ বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন।
একজন ছিলেন অবিভক্ত বা অখণ্ড বাংলার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি নেতা ব্যারিস্টার শরৎচন্দ্র বসু। অন্যজন পৃথিবী কাঁপানো বিপ্লবী ও গর্বিত বাঙালি, ব্রিটিশবিরোধী ‘আজাদ হিন্দ ফৌজে’র প্রতিষ্ঠাতা তথা
সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু।
ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বাড়িটি ভারতীয় রাজনীতির তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু কলকাতা এলে এ বাড়িতেই উঠতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, কিরণ শংকর রায়, ডা. বিধানচন্দ্র রায় এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও এ বাড়ির আঙিনায় পদস্পর্শ করেছেন।
যুক্ত বাংলার (United Bengal) জন্য শরৎ বসু’র প্রাণান্ত ভূমিকার কথা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৭৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছেন, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সমর্থন থাকা সত্বেও গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরুর ইংগিতে সর্দার বল্লবভাই প্যাটেলের কঠোর বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ বাংলা আর থাকেনি’।
বঙ্গবন্ধু নিজেও মহাত্মা গান্ধী এবং নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এ বাড়িতে গিয়েছেন।
৩) বাড়িটি এখন ৩৮/২ নেতাজী ভবন। নেতাজি সুভাষ বসুর নামেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। নেতাজির চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ এত উচ্চাসনে আসীন হননি।
নিচে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফটকে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় কর্তৃক তাঁর একটা আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
এতে উৎকীর্ণ আছে, কলকাতা পৌরসংস্থার শ্রদ্ধার্ঘ্য, “শহর কলকাতার মেয়ররূপে (২২ আগস্ট ১৯৩০ -১৪ এপ্রিল ১৯৩১) উজ্জ্বল ইতিহাসের অন্যতম রচয়িতা ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনের কান্ডারী দেশনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মহানিস্ক্রমণের হীরক জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে আবক্ষ মূর্তির উন্মোচন”।
উল্লেখ্য, নেতাজি সুভাষ বসু ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বর্তমান উড়িশা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া প্রেসিডেন্সী কলেজ ও স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। তিনি ১৯২১ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মানসিক ও নৈতিক বিজ্ঞান’ ত্রিপোস বিষয়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।
নেতাজি ১৯৩০-৩১ সালে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র। তাঁর পূর্ববর্তী মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেন এবং পরবর্তী মেয়র ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ১৯৩৮-৩৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই পদে তাঁর পূর্ববর্তী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এবং পরে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। ১৯৩৯-৪১ সালে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের সভাপতি হন। তাঁর মৃত্যু ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিঃ। যা ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত।
৪) একটি কাকতালীয় ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
নেতাজি সুভাষ বসু শেষবারের মতো যেদিন এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, তখন ভোর রাত। একটা গাড়ি এসে নিচে দাঁড়ায়। তিনি বিদায় নিচ্ছেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী (এন সি চৌধুরী)। তিনি তখন বাঙালির নেতা ও রাজনীতিবিদ শরৎ বসুর একান্ত সচিব। সুভাষ বসুর গাড়ির দরজা তাঁর হাত দিয়ে বন্ধ হয়।
নীরদচন্দ্র চৌধুরীও ১৮৯৭ সালে আমাদের কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন এ দু’জন সমান বয়সী। এন সি চৌধুরী ১৯৯৯ সালে ১০২ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শতবছর বয়সে লেখা বই ‘আমার দেশ আমার শতকে’ এসব বর্ণনা করেছেন।
২১ আশ্বিন, ১৪২৯ খ্রিঃ