হারিয়ে ফেলা একটি কবিতা নিয়ে আমাকে খুব কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
: যেমন?
: সাংঘাতিক এক প্রেমের কবিতায় দুঃসাহসী এক যুবকের ব্যতিক্রমী প্রস্তাব ছিল- নিদ্রা উড়ানিয়া তুমি পূর্ণ লাবণী/হবে কি ঘরণী তুমি উহাদের জননী?
কবিতাটি হাতে নিয়ে একদিন, কোথায় খুঁজে পেলেন তিনিই জানেন, কোমরে পরনের কার্পাস গুঁজে সকল বিচারে সর্বনাশা রূপে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন-
: কে? কে আছে এই সর্বনাশডাকা শব্দগুলোর ভেতর? আমাকে জানতে হবে।
লিখছিলাম তখন। কাগজ থেকে মাথা না তুলে পলিটিক্স করলাম।
: দেখোতো দেখি! প্রশ্ন হলো এটি কোন! আর কে থাকবে! এখনও বুঝতে পাচ্ছো না যে আমি তোমাকেই এঁকেছি! আমি মানুষ মন্দ না। তোমার চেয়ে কে বেশি জানবে যে আমি কত ডিসেন্ট ক্যারেক্টারের মানুষ।
: তাইতো, আমার চেয়ে বেশি আর কে জানবে! আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না। তুমি যে উন্নত মানের ভ-, তার পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি।
আমাকে ভ- বলতে তোমার একটুও বাধলো না! তুমি কি আমার চরিত্রে আমার বন্ধুদের মত কোন ব্যাপার দেখেছো?
: সে কথা পরে হবে। আপাতত এটুকু শুনে রাখ, আমার অনুসন্ধান জারি থাকবে।
: থাকুক। আমার কোন দুর্বলতা নেই।
: দেখা যাবে।
***
সাতদিনের মাথাতেই ব্যাপার সব অন্যরকম হয়ে গেলো। ঝাড়ামোছা পুরোনো এক ডায়রির মাঝ বরাবর খুলে তিনি বললেন-
: এখানটায় একটু পড়। বড় চমৎকার একটা কবিতা আছে। কবিতার ভেতরের মানুষটা নিয়েও ইঙ্গিত আছে তাকে খুব ভালো চেনাও যাচ্ছে।
: এটিতো আমার ডায়রি!
: আমি তো বলি নি যে আর কারও ডায়রি।
: তো?
: তো আর কী! তোমার ডায়রি বলেইতো তোমাকে দেখাচ্ছি! পড়।
: ডায়রি আমি আগে লিখতাম। এখনতো লিখি না!
: ওসব আমার জানার দরকার নেই। বল কাকে তুমি এঁকেছো, কাকে তুমি নিদ্রাউড়ানিয়া বলছো? কে তোমার পূর্ণ লাবণি!
: অন্যের ডায়রি পড়া কি ভদ্রতা! এটি তো তাস্কর্যের মধ্যে পড়ে যায়।
: না পড়লে আমি তো অনেক কিছুই পেতাম না, জানতামও না অনেক কিছু! কালপ্রিটকে ধরার জন্য মাথায় রাখতে হয় কালপ্রিটের চেয়েও বেশি বুদ্ধি।
: মনে হচ্ছে, যুদ্ধে নেমেছো!
: নেমেছিইতো! কোন সন্দেহ আছে তোমার! যুদ্ধে যখন নেমেছি, এখন অনেক কিছুই আমাকে উল্টোপাল্টা করতে হবে। এভরি থিঙ ইজ ফেয়ার ইন লা’ভ অ্যান্ড ওয়ার। বল, এই লাবণি কোন লাবণি!
: আমি কিছুই বলবো না। সব যখন তুমিই বলেছো, আমি চুপ থাকবো।
: চুপ থাকলে চলবে না। সাইলেন্স ইজ কস্টলি। অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকবে না। এই মেয়েটি শিউলি না?!
: আমি কিছু বলছি না। কখনও বলবোও না। তবে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, শিউলি নামের কোন মেয়ে তোমার পরিচিত কিনা!
: পরিচিত। তবে তোমার চেয়ে কম। কেমিস্ট্রির ছাত্রী। তোমার ডিপার্টমেন্টের। ডাকসাঁইটে সুন্দরী। তোমার তিন বছরের জুনিয়র, এখন সীতাকু-ের এক কলেজের শিক্ষক। ঠিক কিনা?
: আমি বলছি না যে ঠিক বা বেঠিক। কারণ, আমি জানি আমার কোন কথাই তোমার বিশ্বাস হবে না। কোত্থেকে তুমি এসব উদ্ভট কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছো, তার মাথামণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পাচ্ছি না।
: বানিয়ে কিছুই আমি বলছি না। আমার কাছে সব এখন আয়নার মত পরিস্কার। শিউলির ছোটবোন মধুমিতা কিন্তু আমার ক্লাসফ্রেন্ড!
: ক্লাসফ্রেন্ড থাকা ভালো। তবে, সব ক্লাসফ্রেন্ড বন্ধু হয় না। কেউ কেউ শত্রুকেও লজ্জায় ফেলে।
: ফাজলামি করো না হীরার বাপ, আমি তোমার কাছ থেকে জ্ঞান নেবো না। সে দুরবস্থায় আমি পড়ি নি।
: কী মুসিবত! আমি এই দুপুরবেলা পেটভরা ক্ষিধে নিয়ে আমি কোন দিক সামলাবো! একদিকে আমার গল্পের নায়িকা বড় দুরবস্থায় আছে, আরেক দিকে তুমি হয়ে গেছো মহারণরঙ্গিনী যুদ্ধবাজ, দেবী চামুণ্ডে, ভয়ের চোটে রক্তে বরফ জমানো শ্রীমতি কাত্যায়নী। মাঝখানে পেটের ভেতর ক্ষুধার্ত কিছু ইঁদুর নিয়ে দুনিয়ার সবকিছুই আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
: পাক তোমার ক্ষিধে। আজ তোমার ভাত জুটবে না। আগে তোমার এই নায়িকার পরিচয় ক্লিয়ার কর। ইনিই তাহলে তোমাকে মেনেছেন তার ভাবনার আকাশ। তুমি তাহলে বলেছো তাকে- আমি তোমার কল্পতরু।
: আমি তো বলেছি, কথাগুলো তোমকে নিয়ে লেখা! স্ত্রী ছাড়া কাউকে নিয়ে আমার মত মানুষ অমন ভাবনা ভাবে! না, ভাবতে পারে!
: পারে। তুমি পারো। আমি তোমার মেরুদণ্ডের আগাগোড়া, এমন কি মাঝখানের ছ্যাঁদাগুলো পর্যন্ত চিনি। আমি তোমার অস্থির মজ্জা, রক্তের কণাকণিকা, স্নায়ুর নিউরণ ও কোষের প্রোটোপ্লাজম পর্যন্ত সব চিনি। তোমার সবকিছু আমি স্টাডি করেছি এবং এখনও করে চলেছি। কিন্তু থৈ পাচ্ছি না আমি! সলিড কোন প্রুফ আমার হাতে পাচ্ছি না।
: এই কঠিন কাজটা আর না করলে চলে না!
: না, চলে না। আমি তোমাকে শেষ করবো। তারপর তোমার হাড় দিয়ে ডুগডুগি বাজাবো।
এমন সময় ফোন এলো। তিনি বললেন- মধুমিতার ফোন।
: তুমি তাহলে শিউলির কথা তাকে এক্ষুণি জিজ্ঞেস করে নাও না কেন?!
: কী জিজ্ঞেস করবো আমি?
: জিজ্ঞেস করোই না, ওর দিদিকে, শিউলিকে আমি চিনি কিনা। ও আমাকে চেনে কিনা, ওর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক ছিল কিনা। ওদের বাড়িতে কোনদিন আমার যাওয়া-আসা ছিল কিনা।
: প্রফেসর সাহেব, এসব সম্পর্ক কি বাড়িতে যাওয়া-আসা নিয়ে হয়? নাকি তার জন্য বসে থাকে?!
জবাব দেয়ার আগে বেজে উঠলো আমার ফোনও। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন- কার ফোন?
: আননৌন নাম্বার। ধরবো না।
: যদি শিউলির ক’ল হয়!
: আমি করে জানবো কার ক’ল! আমিতো কোন শিউলি সেনগুপ্তাকে চিনি না!
: সেনগুপ্তা পর্যন্ত যখন বলে ফেলেছো, চেনা না চেনার সব প্রমাণ তুমি দিয়ে ফেলেছো মিস্টার লায়ার! ফোনটা আমাকে দাও, ক’ল-ব্যাক করে আমি এখনই নিশ্চিত করে দিচ্ছি। ‘দুধ কা দুধ পানি কা পানি’ এখনই করে দিচ্ছি।
আমি দিতে চাচ্ছিলাম না। সেইভ না করা নাম্বারের একটি একটিই শুধু আমি দেখামাত্র বুঝতে পারি। ওটিই সে নাম্বার। ভয়াবহভাবে স্মৃতিদুর্বল হওয়ার পরও ঐ নাম্বারের এগারোটি অঙ্ক আমার মুখস্থ।
: দাও বলছি, ফোনটা আমাকে দাও। আমার অনেককিছু দেখার বিষয় আছে।
আমি দেয়ার জন্য ফোনটি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যাচ্ছিলাম।
: যাচ্ছো কোথায় কালপ্রিট? ওখানে বসে সব ইরেইজ করার বুদ্ধি!
তারপর তিনি ‘ক্রিমিনাল কাহাকার!’ বলে ছাদফাটা এক হুঙ্কার দিয়ে বসলেন। এমন সে হুঙ্কার, হাত থেকে আমার ফোন ছুটে গেলো। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট খেলোয়াড় জণ্টি রোডসকে হার মানানো দক্ষতায় ফ্লোরের এক সেন্টিমিটার ওপর থেকে তিনি ‘ক্যাচটা’ লুফে নিলেন। ছলনায় ভরা মুঠোফোন তার নির্ভরযোগ্য ও শক্ত মুঠোয় চলে গেলো। আমি রুদ্ধবাক দাঁড়িয়ে থাকলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোটে ও নিশ্চিত শঙ্কায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ফোনহাতে দেবী চামুণ্ডে পাশের কক্ষে চলে গেলেন এবং ঘটাং করে দরোজা বন্ধ করলেন।