জালিয়াতি করে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবসা দখল, প্রতিকার চাওয়ায় ‘মিথ্যা’ মামলা


একুশে প্রতিবেদক : শুরুটা এ রকম— চট্টগ্রাম বন্দরে স্টোভিডোরিং ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী, যা বর্তমানে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নামে পরিচিত। রাজিউল করিম চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং (স্টোভিডোরিং লাইসেন্স নম্বর ২/১৯৭২, তারিখ ০১.০১.১৯৭২)। ১৯৮৪ সালে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল মারা যান। এর আগে ২০০০ সাল থেকে রাজিউল করিম চৌধুরীর সই জাল করে স্টোভিডোরিং লাইসেন্সটি নিয়ে বন্দরে ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করে দেয় একটি চক্র।

শুধু তাই নয়, এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর জাল এফিডেভিট ও শেয়ার ট্রান্সফার ফরমে তার স্বাক্ষর ও ভুয়া আয়কর সনদ দেখিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে চক্রটি। তারা কোন ধরনের ক্রয়চুক্তি ছাড়া জাল-জালিয়াতি করে বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং নামক সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম পাল্টিয়ে পরপর দুটি লিমিটেড কোম্পানি গঠন করে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতারণা করে আসছে। সর্বশেষ জ্যাক শিপিং এন্ড লজিস্টিকস লিমিটেড নামে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে আসছে তারা। সিআইডি ও পিবিআই’র পৃথক তদন্তে চাঞ্চল্যকর এই জাল-জালিয়াতির ঘটনা উঠে এসেছে।

জানা যায়, রাজিউল করিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পুনরায় ব্যবসা চালুর জন্য তার ছেলে, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোরশেদ আরিফ চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করেন। সাড়া না পেয়ে পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি বন্দরকে লিগ্যাল নোটিশ দেন তিনি। এরপর বন্দরে খোঁজাখুঁজি করে এবং ফাইল চেক করে মোরশেদ আরিফ চৌধুরী দেখতে পান, একটি চক্র যোগসাজশে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে এ. এ. রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর জাল করে ২০০০ সাল থেকে তারই প্রতিষ্ঠানের নামে অবাধে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে রাজিউল করিম চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে (বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং) বিলুপ্ত করে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড নামে কোম্পানি গঠন করে চক্রটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে উক্ত বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডে এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীকে ভুয়াভাবে ১০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার দেখনো হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো রাজিউল করিম চৌধুরীর মৃত্যু হয় ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল। অথচ মৃত্যুর ১০ দিন পর একই বছরের ৩০ এপ্রিল জয়েন্ট স্টক কোম্পানির শেয়ার ট্রান্সফারের ১১৭ ফরমে স্বাক্ষর জাল করে ওই ১০ শতাংশ শেয়ারকে সম্পূর্ণ হস্তান্তর দেখিয়ে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের নাম পাল্টিয়ে ‘জেক শিপিং এন্ড লজিস্টিক্স লিমিটেড’ নাম রাখা হয়। এসব কাজ করতে সব কাগজপত্রে এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে জালিয়াতি করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ব্যবসা দখলে নেয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা দায়ের করেন প্রয়াত রাজিউল করিম চৌধুরীর ছেলে মোরশেদ আরিফ চৌধুরী। এতে আসামি করা হয়- মো. জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, মো. আনোয়ার হোসেন মজুমদার, আমেনা বেগম, আনোয়ার আহমেদ, আবু বক্কর সিদ্দিকী, শফিকুল ইসলাম ও মো. নুর নবীকে।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং নামক প্রতিষ্ঠানের কোন শেয়ারের মালিক হওয়া কিংবা হস্তান্তর কিংবা কোন ধরণের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেননি। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি যাবতীয় কাগজপত্রের মাধ্যমে আসামিরা কথিত বর্তমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জেক শিপিং এন্ড লজিস্টিকস লিমিটেড পরিচালনা করে আসছেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে সংরক্ষিত সমস্ত কাগজপত্রে থাকা রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর, জন্ম তারিখ ও আয়কর সনদ ভুয়া।

দণ্ডবিধির ৪৬৭, ৪৬৮, ৪০৬, ৪২০, ৪৭১ ও ১০৯ ধারায় করা উক্ত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোকে নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর আদালতে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামিগণ কর্তৃক জাল-জালিয়াতির বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

পিবিআইয়ের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টাক্সফোর্স স্টিভিডোরিং কাম শেয়ার হ্যান্ডলিং ঠিকাদার প্রথা বিলুপ্ত করে বার্থ অপারেটর, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর ও টার্মিনাল অপারেটর পদ্ধতি চালু করে। উক্ত পদ্ধতির ফলে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান কর্মহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পরিচালকগণ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৭নং বিবাদী মো. নুর নবীর ১০ শতাংশ শেয়ার জাহাঙ্গীর আলম মজুমদারের (১নং বিবাদী) নিকট হস্তান্তর করেন। অপরদিকে আমেনার নামে (৩নং বিবাদী) ১৫ শতাংশ শেয়ার, আনোয়ার আহমেদের নামে (৪নং বিবাদী) ৫০ শতাংশ শেয়ার, আবু বক্কর সিদ্দিকের নামে (৫নং বিবাদী) ১৫ শতাংশ শেয়ার এবং শফিকুল ইসলাম সবুজের নামে (৬নং বিবাদী) ১০ শতাংশ শেয়ারসহ সর্বমোট ৯০ শতাংশ শেয়ার ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর ২নং বিবাদী আনোয়ার হোসেন মজুমদারের নিকট হস্তান্তর করেন মর্মে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং নামক প্রতিষ্ঠানটি ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ও অত্র মামলার বাদীর বাবা এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করেন আসামিরা। পরবর্তীতে একই কায়দায় এ.এ. রাজিউল করিম চৌধুরীর স্বাক্ষর জাল করে প্রোপাইটরশীপ বিলুপ্ত করে ২০০৬ সালে ‘বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড’ নামক কোম্পানি গঠন করেন আসামিরা।

উক্ত বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড অত্র মামলার বাদীগণের পিতা ও স্বামী মরহুম এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীকে ভুয়াভাবে ১০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার দেখানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী মৃত্যু হয় ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল। অথচ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে হলফনামা দেখানো হয় ২০০৭ সালের ২৫ এপ্রিল তারিখে এবং শেয়ার ট্রান্সফার দেখানো হয় ২০০৭ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখে। সুতরাং জালিয়াতি প্রমাণের জন্য এটা উৎকৃষ্ট উদাহরণও বটে। কেননা মৃত্যুর ৫দিন পর হলফনামা দেখানো হয় এবং ১০দিন পর শেয়ার ট্রান্সফার দেখানো হয়।

তাছাড়া উক্ত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেড এবং পরবর্তীতে জেক শিপিং এন্ড লজিস্টিবস নামক কোম্পানিতে রূপান্তর বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় দলিল হচ্ছে ভেন্ডারস এগ্রিমেন্ট (প্রতিষ্ঠান ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি)। উক্ত ভেন্ডারস এগ্রিমেন্টের বিষয়ে মেমোরেন্ডাম এন্ড আর্টিকেলস অব এসোসিয়েশনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু বারবার তাগাদা দেয়ার পরও সেটি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দেখাতে পারেননি আসামিরা।

পিবিআইয়ের ওই প্রতিবেদনে সিআইডির হস্তলিপি বিশারদের মতামত তুলে ধরে আরও বলা হয়, অত্র মামলার স্বাক্ষর জাল সংক্রান্তে তর্কিত দলিলাদিতে থাকা আঙ্গুলের ছাপ ও স্বাক্ষর এবং প্রামান্য দলিলের নমুনা স্বাক্ষর তুলনামূলক পরীক্ষা করে আসামিদের জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়।

তাছাড়া বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের শেয়ার বন্টনের ক্ষেত্রে এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৩৪ সালের ১০ মার্চ। প্রকৃতপক্ষে এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর জন্ম তারিখ ১৯৩৫ সালের ৯ মার্চ; যা পাসপোর্টে উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এ এ রাজিউল করিম চৌধুরীর জন্ম তারিখেও জালিয়াতির প্রমাণ রয়েছে।

পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা এভাবে প্রকৃত সত্য ঘটনা উদঘাটন করে তার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও রহস্যজনক কারণে মামলার ১ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার ও ২ নম্বর আসামি মো. আনোয়ার হোসেন মজুমদারকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে আদালতের কাছে আবেদন জানান। ফলে তদন্ত প্রতিবেদনটি স্ববিরোধী ও বিতর্কিত হওয়ায় মামলার বাদী মোরশেদ আরিফ চৌধুরী ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আদালতে নারাজি দেন। এ প্রেক্ষিতে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য ২০২১ সালের ২১ মার্চ সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে একই বছরের ২৩ নভেম্বর ফের ১ ও ২ নম্বর আসামিকে বাদ দিয়ে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি। তবে সিআইডি তদন্তেও রাজিউল করিম চৌধুরীর সকল স্বাক্ষর জাল বলে প্রমাণিত হয়। ফলে বাকি ৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। তারা জেল খেটে বর্তমানে জামিনে আছেন।

অন্যদিকে ১ ও ২ নম্বর আসামিকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়ার প্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারী রিভিশন দায়ের করেন মোরশেদ আরিফ চৌধুরী; তিনি জানান, উক্ত রিভিশন গ্রহণ করে উক্ত দুই আসামিকে তলব করেন আদালত। একইসঙ্গে তাদের সহযোগি স্টিভিডোরিং এসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যানকেও তলব করেন আদালত।

এছাড়া ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জালিয়াত চক্রের সকল সদস্যসহ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিকে বিবাদী করে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করেন মোরশেদ আরিফ চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা। মামলা দায়েরের পর বিবাদীগণ কোন জবাব দাখিল না করে সময় নষ্ট করে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মামলা খারিজের দরখাস্ত দেন। এর বিরুদ্ধে মোরশেদ আরিফ চৌধুরী আপত্তি দিলে গত ২৪ মার্চ শুনানি শেষে মামলা খারিজের দরখাস্ত নামঞ্জুর করেন আদালত। আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন দায়ের করা হয়। বর্তমানে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দুটি চলমান আছে।

অন্যদিকে সি.এ ফার্ম এম.আর. দে এন্ড কোং এর স্বত্বাধিকারী মনোরঞ্জন দে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করে জানান, কথিত বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের আনোয়ার আহমেদের বরাবরে ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল তারিখে ১০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর পত্রে প্রদত্ত স্বাক্ষীর স্বাক্ষরটি তার নয়। ওই স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।

এদিকে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের টিআইএন দেখানো হয়েছে; যার নম্বর- ৪৯৯১৭৭৪১৪৬৫২/সি-৫৩ (কোম্পানীজ), ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ওই দুটি সনদে পুরনো টিআইএন দেখানো হয়েছে ৩৭৬২০০৪৮৩৭। বাস্তবে দেখা যায়, বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের দেখানো এই টিআইএন এইচ সি মেরিন লিমিটেডের। তাছাড়া বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের কথিত মালিক জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার ও ছেলে আনোয়ার হোসেন মজুমদারের আয়কর বিভাগের নথিতে বিএসটিসি শিপিং লিমিটেডের আয় সম্পর্কেও কোন তথ্য নাই। এছাড়া কথিত আয়কর সনদ দুটিতে স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে উপ কর কমিশনার মাসুদ রানার। অথচ উক্ত মাসুদ রানা তার বহু আগেই যুগ্ম কমিশনার পদে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে গেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন মজুমদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে, সব শতভাগ মিথ্যা। এর চেয়ে বেশি জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশদারের সঙ্গে আলোচনা করে আপনি প্রতিবেদন লিখুন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’

এদিকে যার স্বাক্ষর জাল করে লাইসেন্স দখল করার অভিযোগ উঠেছে, সেই এ এ রাজিউল করিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা অস্ত্রভর্তি পাকিস্তানি ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানো ঠেকাতে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন। তিনি অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি জাহাজ বন্দরে আসার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জানে আলম দোভাষকে নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে যান। এরপর তিনজন মিলে ছুটেন বন্দর এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় শ্রমিক ও যুবক সংগ্রহ করতে। তারা পরে হাজার হাজার লোক নিয়ে বন্দরের বিভিন্ন গেইটে অবস্থান নিলে তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র নামানো থেকে পিছিয়ে আসে পাক সেনারা। মাহবুবুল আলম ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল স্বাধীনতা’ নামক ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বইটিতে রাজিউল করিম চৌধুরীর এই অবদানের কথা বিস্তারিত লিখেছেন।

রাজিউল করিম চৌধুরীর পুত্র, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোরশেদ আরিফ চৌধুরীর অভিযোগ, এই জালিয়াতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন রাজাকার হিসেবে অভিযুক্ত বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মনজুর আলম। বর্তমানে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের কোন পদে না থেকেও প্রতিষ্ঠানটির প্যাড ব্যবহার করে আসামিদের পক্ষে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সরবরাহ করেছেন তিনি। তার এসব দাবির সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের মূল কাগজপত্র উদ্ধারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি আবেদন করেন মোরশেদ আরিফ চৌধুরী। আদালত এই আবেদন গ্রহণ করে এ এইচ এম মনজুর আলমকে নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এখনও সেই মূল কাগজপত্রগুলো আদালতে উপস্থাপন করেননি।

মোরশেদ আরিফ চৌধুরী আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের করা রাজাকারের তালিকায় ৯১ নম্বরে থাকা এ এইচ এম মনজুর আলম ওসেনএইড সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর হিসেবে ব্যবসা করে আসছেন; তার বাবা মাকসুদ আহমেদও সরকারের তালিকাভুক্ত রাজাকার। ২০১৮ সালে দুইটি চেক জালিয়াতি মামলায় মনজুর আলমের এক বছর করে সাজা হয়। সাজা অবস্থায় বাদীকে টাকা ফেরত দিয়ে তিনি ওই মামলা থেকে রেহাই পান। এমন একজন মানুষ সিআইডিকে মনগড়া, মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে জালিয়াত চক্রকে বাঁচাতে সুপারিশ করেছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মনজুর আলম বলেন, ‘লাইসেন্স নিয়ে তাদের মধ্যে যে বিরোধ চলছে তাতে এমন কিছু নেই, যেটা আমি আপনার কাছ থেকে লুকাবো। এই ধরনের উদ্দেশ্যেও আমার নেই। আমি সাংবাদিকবান্ধব মানুষ। অনেকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। প্রেসকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি এখন খুব অসুস্থ। আপনি সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করুন। আপনাকে সব বলবো।’

এদিকে রাজিউল করিম চৌধুরীর পুত্র, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোরশেদ আরিফ চৌধুরীর অভিযোগ, মামলায় সুবিধা করতে না পেরে জালিয়াত চক্রের হোতারা তাদের নামে দুটি মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দিয়েছেন।

এর মধ্যে একটি মামলা আদালতের আদেশে আকবরশাহ থানায় এফআইআর হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। ওই মামলায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যে প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়েছে, তাতে ‘ফিজিক্যাল অ্যাসাল্ট পুলিশ কেইস’ লেখা সিল থাকলেও কোন ধরনের ইনজুরির কথা উল্লেখ নেই। এমনকি ওই প্রেসক্রিপশনে কোন ওষুধের নামও নেই; তবে এক্সরে করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আকবরশাহ থানার ওসি মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রেসক্রিপশনের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে অগ্রগতি আছে। যত দ্রুত সম্ভব আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’

মোরশেদ আরিফ চৌধুরীর অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াত চক্রের হোতাদের করা আরেকটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। মারধরের অভিযোগে করা ওই মামলায় ডা. সাহাবুল হুদা চৌধুরী নামের চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের একজন সহযোগি অধ্যাপকের প্রেসক্রিপশন সংযুক্ত করা হয়। তবে ওই হাসপাতালে চিঠি দিয়ে সিআইডির এসআই মোশায়েদ উল্যাহ ভূঁইয়া জানতে পারেন, ওই নামে কোন চিকিৎসক মা ও শিশু হাসপাতালে আগেও ছিলেন না, এখনও নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন মজুমদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই চিকিৎসক মা ও শিশু হাসপাতালে না থাকলে কোথায় আছে খুঁজে বের করে আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে বলেন। তাহলে তো আমার ফাঁসি হয়ে যায়। মেরেছে যে সেটা সত্য, সেটা আগে জরুরি। চিকিৎসক কোথায় আছে, নেই সেটা তো তাদের জানার দরকার নেই। আমি চিকিৎসা নিতে মা ও শিশু হাসপাতালে গিয়েছি কিনা সেটা আমি আদালতে বলবো।’ এ কথা বলেই গালাগালি করে ফোন কেটে দেন আনোয়ার।