নকল ওষুধ চক্রের কাছে অসহায় কোম্পানিগুলো


শরীফুল রুকন : ইপাসেট নামে একটি বিদেশি ওষুধ রোগীদের সেবন করতে দিচ্ছেন চট্টগ্রামের কিছু চিকিৎসক। কিন্তু ইতালির রিভার ফার্মার তৈরি এই ওষুধটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদিত নয়। যার কারণে ওষুধটি দেশে আমদানির সুযোগ নেই। তবুও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ফার্মেসি ও অনলাইনে ওষুধটি মিলছে।

গত ১৭ আগস্ট বন্দরনগরীর মোমিন রোডের রহমতগঞ্জ মোড়ের মজুমদার ফার্মেসি থেকে এক পাতা ‘ইপাসেট’ কেনেন এ প্রতিবেদক। ১৫ ট্যাবলেটের ওই পাতাটির দাম নেওয়া হয় ৬৫০ টাকা, যদিও প্যাকেটে লেখা মূল্যের চেয়ে এক পাতায় ৭৫ টাকা কম নেওয়া হয়েছে।

হাজারী লেইন ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘ইপাসেট এক পাতার এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) যদি ৭২৫ টাকা হয়, তাহলে এটার টিপি (ট্রেড প্রাইস) হবে ৫৪১ টাকা। এরপর ১৭.৪ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে ১২৬ টাকা যুক্ত হলে ওষুধটার দাম দাঁড়ায় ৬৬৭ টাকা। এর বাইরে যে ৫৮ টাকা থাকবে তা ব্যবসায়ীর লাভ। ৭২৫ টাকার ওষুধ যখন ৬৫০ টাকায় কেনা যাচ্ছে, তার মানে ওষুধটার ভ্যাট দেওয়া হয়নি। এটা যে আসল ওষুধ নয়, সেটার একটা প্রমাণ এই ঘটনা।’

৬৫০ টাকায় এ প্রতিবেদকের কেনা ইপাসেটের এক পাতায় ১৫টি ট্যাবলেট আছে; সে হিসেবে প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম পড়েছে ৪৩ টাকা ৩৩ পয়সা। অন্যদিকে ফার্মাসিলোরেটো ডটকম নামে ইতালির একটি ‘অনলাইন ফার্মেসিতে’ দেখা যায়, ৩০টি ইপাসেট ট্যাবলেট বিক্রি করা হচ্ছে, ২৫ দশমিক ৫০ ইউরোতে (এক ইউরো সমান ৯৪.৬৭ টাকা ধরলে ২ হাজার ৪১৪ টাকা); সে হিসেবে ইতালিতে একটি ইপাসেট ট্যাবলেটের দাম পড়ছে ৮০ টাকা।

অর্থ্যাৎ ইতালিতে তৈরি ইপাসেটের একটি ট্যাবলেটের দাম ৮০ টাকা। আর একই ওষুধ বাংলাদেশে ‘আমদানি’ করার পর দাম দাঁড়াচ্ছে ৪৩ টাকা! সত্যি অবিশ্বাস্য!

এছাড়া দেশে পাওয়া যাওয়া ইপাসেট ওষুধটির মোড়কসামগ্রী নিম্নমানের, ফিনিশিংও ভালো নয়। ইতালির রিভার ফার্মার ওয়েবসাইটে থাকা ইপাসেটের মোড়কসামগ্রীর সঙ্গে মজুমদার ফার্মেসি থেকে কেনা ওষুধটির মিল নেই।

অনিবন্ধিত ওষুধ হওয়ার পরও ‘ইপাসেট’ বিক্রি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মজুমদার ফার্মেসির মালিক সঞ্জয় মজুমদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ইপাসেট ওষুধটি বেনভিউ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে সরবরাহ করে। আমাদের কাছে রশিদ আছে। তারা যে ওষুধটির নিবন্ধন নেয়নি সেটা আমরা জানতাম না। ডাক্তাররা লিখেন, তাই আমরা ওষুধটি রাখি।’

অবিশ্বাস্য কম দামে ইপাসেট পাওয়া যাওয়ার বিষয়ে সঞ্জয় বলেন, ‘এক পাতা ইপাসেটের এমআরপি ৭২৫ টাকা হলেও আমরা অনেক কম দামে পাই। আমাদের লাভের অংশ রেখে কাস্টমারের কাছ থেকে ৬৫০ টাকা করে নিচ্ছি। ওষুধটির ভ্যাট দেওয়া হয় কিনা সেটা বেনভিউ জানে।’

অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে একুশে পত্রিকার হাতে আসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. প্রতীক চৌধুরীর একটি প্রেসক্রিপশন; যাতে ইপাসেট ওষুধটিও দেওয়া আছে। ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জানতে চাইলে মেডিসিন বিষয়ে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী ডা. প্রতীক চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ইপাসেট একটি মাল্টিভিটামিনের মতো। ভালো ভিটামিনগুলো থাকে আর কি। এজন্য আমরা লিখি।’

ওষুধটি বাংলাদেশে অবৈধ উল্লেখ করলে ডা. প্রতীক চৌধুরী বলেন, ‘সেটা তো আমাদেরকে বলেনি। তবে এটা দোকানে পাওয়া যায়। তারা অনুমোদন পেয়েছে কি না আমি বলতে পারবো না।’ ওষুধটির আমদানিকারক কারা বা মার্কেটিং কারা করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোম্পানির লোকজন এসে বলে যায়। কারা এটা আমদানি করে আমাদেরকে তো বলে না।’ এরপর ‘ফোন আসতেছে অনবরত, আমি পরে কথা বলবো’ বলে লাইন কেটে দেন ডা. প্রতীক চৌধুরী।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ হিসেবে অননুমোদিত ওষুধ লিখতে পারেন না। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ইপাসেট ওষুধটির প্যাকেটে আমদানিকারক হিসেবে ‘বেনভিউ ইন্টারন্যাশনালের’ নাম লেখা আছে; যদিও সেখানে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা উল্লেখ নেই। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার থানাধীন আমিরবাগ আবাসিক এলাকার ৩ নং রোডের ৩৩/সি নং বাড়ির নিচতলায় বেনভিউ’র গুদাম। সেখানে গিয়ে বেনভিউ’র সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। দরজাও বন্ধ। তবে আশপাশের বাসিন্দারা সেখানে বেনভিউ’র ওষুধ জমা রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এই বেনভিউয়ের ‘আমদানি করা’ উল্লেখ করে অক্সোকাল সিল, লেনিফাস্ট জেল, ল্যাপিল ক্রিম, সিলোসেট প্লাস ইনজেকশন ও লেভিসিকা নামের ইতালির রিভার ফার্মার আরও অন্তত পাঁচটি পণ্য বিভিন্ন ফার্মেসি ও অনলাইন শপগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে সিলোসেট প্লাস ইনজেকশনের দাম ৬ হাজার টাকা। অথচ এগুলোর একটিও অনুমোদিত নয়; যা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন নিশ্চিত করেছেন। আর অনুমোদন না থাকলে এসব ওষুধ বৈধপথে দেশে আনাও যায় না। তবে কী ওষুধগুলোর নকল তৈরি হচ্ছে দেশে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে, ‘বেনভিউ ইন্টারন্যাশনাল’ নামের প্রতিষ্ঠানটির মালিক আনিসুর রহমান। তিনি ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শাহমীরপুর এলাকার ‘অরবিট ফার্মাসিউটিক্যালস’ নামের এলোপ্যাথিক ওষুধ তৈরির একটি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অনিয়মের কারণে বিভিন্ন সময় অরবিটের বেশ কয়েকটি ওষুধের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়; এছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত থেকে তাদেরকে এন্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরিতে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়।

এসব দুর্নাম ও নিষেধাজ্ঞা এড়াতে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আনিসুর রহমান অরবিটের নাম পরিবর্তন করে ‘এভারক্স ফার্মাসিউটিক্যালস’ নাম রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে। এভাবে ওষুধ কোম্পানি পরিচালনার আড়ালে আনিসুর রহমান ইতালির রিভার ফার্মার নামে নকল ওষুধ তৈরিতে নেমেছেন কিনা সেই প্রশ্ন এখন উঠছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, আনিসুরের বেনভিউ ইন্টারন্যাশনালের অবৈধ ওষুধের কারবারে মাসে লেনদেন হয় কমপক্ষে কোটি টাকা; যা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন। এই টাকায় বাড়ি-গাড়ি সব করেছেন আনিসুর। চট্টেশ্বরী মোড়ের এক্সেল টাওয়ারে প্রায় ৮০ লাখ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট আছে তাঁর।

ইপাসেটসহ রিভার ফার্মার আরও কয়েকটি অনিবন্ধিত ওষুধ বাজারজাত করার বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেনভিউ ইন্টারন্যাশনালের মালিক আনিসুর রহমানকে ২৫ আগস্ট দুপুর ১টা থেকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৬টা) একাধিক নাম্বার থেকে বারবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি; হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠিয়ে বক্তব্য চাইলে ‘সিন’ করেও সাড়া দেননি। একপর্যায়ে এ প্রতিবেদকের নাম্বার ব্লক করে রাখেন আনিসুর।

তবে একই বিষয়ে জানতে চাইলে বেনভিউ ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজার তারেকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওষুধগুলোর নিবন্ধন নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’ নিবন্ধন না নিয়ে বাজারে ওষুধ বিক্রি করা অপরাধ, এক্ষেত্রে ভ্যাট দেওয়ারও সুযোগ থাকে না- উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে মার্কেটিং সাইটটা দেখি। এ বিষয়ে জানি না।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘বেনভিউর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে শুধু আনিসুর রহমান নয়, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহপাঠী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান, সহকারী অধ্যাপক অনিন্দ্য কুমার নাথের সম্পদও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আনিসুরের ওষুধ কোম্পানিতে দীর্ঘদিন উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি করা ওই শিক্ষক চট্টগ্রাম নগরের চট্টেশ্বরী মোড়ে একটি ফ্ল্যাটের (আনিসুরের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি), গাড়ির মালিক; বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। তাঁর এই অস্বাভাবিক আয়-ব্যয় নিয়ে অডিট করতে নেমেছে কর অঞ্চল-৪, চট্টগ্রাম। সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করতে গত ৭ আগস্ট তাকে চিঠি দিয়েছেন কর অঞ্চল-৪ এর উপ কর কমিশনার এরিনা বেগম। তবে আনিসুরের বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

অস্বাভাবিক আয়-ব্যয় নিয়ে অডিট শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে অনিন্দ্য কুমার নাথ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আনিসুর আমার বন্ধু, পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকি। এক সময় তার ওষুধ কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। এখন করি না।’ আনিসুরের অবৈধ ওষুধের ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন তিনি। কর অঞ্চল-৪ থেকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ রকম কোনো চিঠি আমি পাইনি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করার আপনি কে? আপনি তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নন।’

অন্যদিকে রিভার ফার্মার নামে বাংলাদেশে অনিবন্ধিত ওষুধ বিক্রির বিষয়টি তুলে ধরে মতামত চেয়ে গত ১৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটিকে ইমেইল করা হয়। কিন্তু ২৫ আগস্ট এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সাড়া দেয়নি রিভার ফার্মা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ নকল হলেও কোম্পানি স্বীকার করতে চায় না। কারণ বিষয়টি ব্যাপকভাবে জানাজানি হলে আসল ওষুধেরই বিক্রি কমে যায়।

শুধু বিদেশি ওষুধ নকল হচ্ছে তা নয়, দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর জনপ্রিয় ওষুধগুলোও সমানে নকল হচ্ছে। যা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জব্দ হচ্ছে।

নকল ওষুধ কেনা হয়েছে যেভাবে

আমাদের কাছে আগে থেকে খবর ছিল, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা সদরের চাতরি চৌমুহনি বাজারের মা ফার্মেসিতে নকল সারজেল (গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ হিসেবে বহুল বিক্রিত এই ওষুধটি তৈরি করে হেলথকেয়ার ফার্মা) বিক্রি হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ৪ আগস্ট বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটে একজন কিশোরকে দিয়ে ওই দোকান থেকে এক পাতা ‘সারজেল ২০ মিলিগ্রাম’ ক্যাপসুল কিনে আনেন এ প্রতিবেদক। কিন্তু পাতাটি দেখেই ওষুধটি নকল বলে সন্দেহ হয়।

আমাদের কেনা ওষুধটি আসল, নাকি নকল, তা যাচাই করতে হেলথকেয়ার ফার্মার একজন কর্মকর্তার কাছে সেই সারজেলের পাতাটি উপস্থাপন করা হয়। তিনি দেখেই বললেন, ‘এটি নকল।’ আসল সারজেলটিও দেখান তিনি। পার্থক্য পরিষ্কার।

হেলথকেয়ারের ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অরজিনাল সারজেলের খোসা খুলে একটা দানা মুখে দিলে তিতা লাগবে। আর নকল সারজেলের দানা মিষ্টি। এখন কিউআর কোডসহ নকল করে বাজারে নকল সারজেল এসেছে। আনোয়ারার কিছু দোকানে হাজারী গলি (চট্টগ্রামে ওষুধের পাইকারী বাজার) থেকে নকল ওষুধ এনে বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের শক্ত সিন্ডিকেট রয়েছে।’

তবে নকল সারজেল বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে ৮ আগস্ট মা ফার্মেসির মালিক ওম প্রকাশ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সবসময় কোম্পানি থেকে আসল ওষুধ কিনি। নকল সারজেল বিক্রির প্রমাণ হিসেবে ভিডিও আছে বলা হলে তিনি সেটা দেখাতে বলেন। এরপর একুশে পত্রিকার আনোয়ারা প্রতিনিধিকে তাৎক্ষণিক ওই দোকানে পাঠালে ওম প্রকাশ নানা কিছু বলে অভিযোগ অস্বীকার করেন। ভিডিও থাকার কথা জানালে ওম প্রকাশ বলেন, ‘সেদিন আপনারা ভিডিও করেছেন, আমি দেখেছি তো। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে!’

ঘন্টাখানেক পর আনোয়ারা উপজেলায় কর্মরত হেলথকেয়ারের এমআর তৌহিদকে ডেকে এনে এ প্রতিবেদককে ফোন করান ওম প্রকাশ। তখন তৌহিদ আমতা-আমতা করে বলেন, ‘মা ফার্মেসি সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ওষুধ কিনে থাকে। তাদের কাছে নকল থাকার কথা না।’

পরে হেলথকেয়ারেরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বাধ্য হয়েই মা ফার্মেসির পক্ষে তৌহিদ সাফাই গেয়েছে। আমরা জানি কারা নকল সারজেল বিক্রি করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলতে পারি না, করতে পারি না। করলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে হেলথকেয়ারের ওষুধ বয়কট করবে। ভালো মার্কেটিং (টাকা-উপহার প্রদান) করার ফলে ডাক্তার আমার ওষুধ লিখলেও, তারা যদি বিক্রি না করে তাহলে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’

হাজারী গলিতে নকল ওষুধের আড়ত

নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগ আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওষুধের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের হাজারী গলির বেশ কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। এই বাজারে নকল ওষুধের বিরুদ্ধে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। এ নিয়ে ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা ও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলে ওষুধ বিক্রি বন্ধ রাখেন দোকান মালিকরা। পরে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ‘আলোচনা সভার’ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। দুই মাস পর তড়িঘড়ি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি সমীর কান্তি সিকদারসহ মামলার ৯ আসামিকে বাদ দিয়ে ‘দায়সারা’ অভিযোগপত্র দেন কোতোয়ালী থানার তৎকালীন এসআই গোলাম ফারুক। সংক্ষেপে লেখা ওই অভিযোগপত্রে ৯ আসামিকে বাদ দেওয়ার সুস্পষ্ট কারণ বিস্তারিত লেখা হয়নি। সেদিন শত শত দোকান মালিক-কর্মচারী ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপর হামলা চালালেও মাত্র ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই দিন ঘটনাস্থল থেকেই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই মামলাটি এখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৫ম আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।

ওই ঘটনার পর থেকেই হাজারী গলিতে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান নেই। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঝে মাঝে সেখানে লোকদেখানো অভিযানে গেলে সবাই দোকান বন্ধ করে দেয়। আর একটি-দুটি দোকানকে নামমাত্র জরিমানা করে প্রশাসনের লোকজন ফিরে আসেন। সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট ভোক্তা অধিকারের অভিযানের সময় হাজারী গলিতে একই চিত্র দেখা গেছে। ফলে হাজারী গলিতে প্রকাশ্যে চলছে নকল-ভেজাল, স্যাম্পল ওষুধের অবৈধ কারবার; ভেতরের দোকানগুলোর সামনে স্যাম্পল ওষুধের প্যাকেট ছড়ানো ছিটানো থাকে; কেউ কেউ দোকানের বাইরে বড় কার্টনে এসব অবৈধ ওষুধ রাখছেন। যা ২০ আগস্ট পুরো হাজারী গলি ঘুরে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি সমীর কান্তি সিকদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি তো নিজেই ব্যবসায়ী। তাহলে অন্য ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করব? আমি নিজের ব্যবসা না করে অন্যজন কী করছে সেটা কী করে দেখব বা তদারকি করব?’

ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলার সেই ঘটনার বিষয়ে জানতে গত ২৩ জুন দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বর্তমানে বাংলাদেশ চা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সচিব রুহুল আমিনের কার্যালয়ে হাজির হলাম। হাজারী গলিতে নকল ওষুধের ছড়াছড়ির প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি বললেন, ‘নকল ওষুধ সম্পর্কে জানতে আপনি আজকে আসলেন, আর আজকেই কাকতালীয়ভাবে আমার মেয়ে নকল ওষুধের ভিকটিম হয়ে গেল।’

বিস্তারিত জানতে চাইলে রুহুল আমিন বলেন, ‘ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য বাচ্চাকে দুই দিন ধরে এ্যাকটেরিয়া নামক একটি প্রোবায়েটিক খাওয়াচ্ছি। দুধ বা পানির সাথে পাউডারটি মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। প্রথম দুইদিন বাচ্চা খুব স্বাভাবিকভাবেই খেয়েছে। এরপর শেষ হলে একজনকে দিয়ে চার প্যাকেট কিনে আনি। কিন্তু এই ওষুধ দিলে বাচ্চা খেতে চায় না। পরে জানলাম এই প্যাকেটগুলো হাজারী গলির মুখে ‘দেশ মেডিকো’ ফার্মেসি থেকে আনা হয়েছে। ওষুধগুলো আগেরগুলার মতো না। বড় বড় দানা। আগেরটার ফিনিশিং ভালো ছিল। সহজে পানিতে গোলানো যেত। কিন্তু এগুলা কেমন যেন দলা দলা; পানিতে মিশতে চায় না। আমি চেক করে দেখলাম, প্যাকেটের ফিনিশিং ভালো না। সাথে সাথে কয়েকটা হাসপাতালের ডিসপেনসারি থেকে একই ওষুধ কিনে এনে কয়েকটা প্যাকেট কেটে পাউডার বের করে দেখলাম, আমার সর্বশেষ কেনা ওষুধের প্যাকেট এবং হাজারী গলির ফার্মেসি থেকে কেনা ওষুধ- দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে।’

এই অভিযোগ যাচাই করার জন্য গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৯ মিনিটে হাজারী গলির সেই ‘দেশ মেডিকো’ থেকে রেডিয়েন্টের তৈরি ‘এ্যাকটেরিয়া’ কিনতে যান এ প্রতিবেদক। ‘এ্যাকটেরিয়ার’ চারটি প্যাকেট দিতে বললে মোবাইলে কী যেন দেখে দোকানের কর্মচারী জানান, ‘এক প্যাকেট এ্যাকটেরিয়া ৮০ টাকা লাগবে। এটার দাম বেড়ে গেছে।’ সম্মতি দিলে দোকানের এক কর্মচারী বাইরে গিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসেন এ্যাকটেরিয়ার দুটি প্যাকেট নিয়ে। এ্যাকটিয়ার দুটি প্যাকেটেরই ব্যাচ নাম্বার ২০৪৫৬২১। উৎপাদনের তারিখ ডিসেম্বর ২০২১; মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ মে ২০২৩। কিন্তু প্যাকেট দুটির ফিনিশিং ভালো নয়। দুটি প্যাকেটের গায়ে লেখাগুলোও হুবহু এক নয়, পার্থক্য আছে। এসব দেখে সন্দেহ তৈরি হয়।

এরপর এ্যাকটেরিয়ার প্যাকেট দুটির ছবি তুলে ও পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে ২১ জুলাই সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে রেডিয়েন্টের প্রধান কার্যালয় ও ফার্মাকোভিজিল্যান্স বিভাগকে ইমেইল ও পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করা হয়। একপর্যায়ে ২৪ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় এ প্রতিবেদককে ইমেইল করে স্ট্র্যাটেজিক মার্কেটিং বিভাগের পোর্টফোলিও ম্যানেজার মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, ‘আপনার ইমেইল সংযুক্তি থেকে আমরা দুটি এ্যাকটেরিয়ার পার্থক্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যা আপনি উল্লেখ করেছেন। আমরা এই বিষয়ে কাজ করছি এবং পণ্যটি যাচাই করার জন্য একটি গুণমান পরীক্ষা করব। সুতরাং, সমস্যাটি তদন্ত করার জন্য আমাদের উল্লিখিত নমুনা প্রয়োজন। আমাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধি নমুনা সংগ্রহ করতে আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।’

এরপর ২৫ জুলাই রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের বাদুরতলা এলাকায় এসে রেডিয়েন্টের জোনাল ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে সন্দেহজনক প্যাকেট নেন। হাতে নিয়েই তিনি বলেন, ‘প্যাকেটটি নকল বলে সন্দেহ হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎপাদন করার কারণে তাদের ওষুধের প্যাকেটে ভিন্নতা থাকার কথা নয়। ওষুধের প্যাকেট তাদের পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে এবং ১২ দিনের মধ্যে ফলাফল জানানো হবে।’ কিন্তু তাগাদা দেওয়ার পরও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রেডিয়েন্ট কর্তৃপক্ষ তাদের পরীক্ষার ফলাফল জানায়নি।

তবে নকল সন্দেহে রেডিয়েন্টকে পরীক্ষার জন্য দেওয়া সেই এ্যাকটেরিয়ার একই ব্যাচের আরেকটি প্যাকেট এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত ছিল। হাজারী লেইন ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির একজন নেতার সামনে দেশ মেডিকো থেকে কেনা ওই প্যাকেট খুলে দেখা গেল, দানাগুলো বড়। দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছিল। অন্যদিকে ওই ওষুধ ব্যবসায়ী নেতার ফার্মেসি থেকে কেনা প্যাকেটটি খুলে দেখা গেল, দানা খুবই ছোট, দেখতে সাদা। বড় পার্থক্য। তবে রেডিয়েন্টের একজন কর্মকর্তা জানালেন, এ্যাকটেরিয়া ফ্রিজে রাখতে হয়। ফ্রিজে না রেখে বিক্রি করলে এমন হতে পারে। আবার নকলও হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশ মেডিকোর মালিক প্রিয়তোষ মুখার্জি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আপনার কথা অনুযায়ী এ্যাকটেরিয়ার প্যাকেট দুটি বাইরে থেকে এনে দেওয়া হয়েছিল। দোকানে না থাকলে আমরা অনেক সময় বাইরে থেকে এনে দিই। আমার দোকান থেকে দেওয়া হলে এখনই চ্যালেঞ্জ দিতাম।’ ১৯ জুলাই কার দোকান থেকে এ্যাকটেরিয়া এনে এ প্রতিবেদককে দেওয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটি ২০ তারিখের রশিদ দেখলে জানতে পারতাম। কিন্তু সেটি পাচ্ছি না।’

১৯ জুলাই রাতে হাজারী গলির ‘পাটোয়ারী ব্রাদার্স’ ফার্মেসি থেকে ৯০ টাকায় এক পাতা ফ্লুক্লক্স ৫০০ ক্যাপসুল কেনা হয়, যদিও এটির এমআরপি দাম ১০৬ টাকা। ওষুধটির ব্যাচ নাম্বার এমএম০১৭ই০৩/২৪। এছাড়া ২১ জুলাই দুপুরে হাজারী গলির আরেকটি ফার্মেসি থেকে আরেক পাতা ফ্লুক্লক্স ৫০০ ক্যাপসুল কেনা হয়। এই দুটি পাতার লেখার মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। এছাড়া ফেসবুকে পাওয়া ফ্লুক্লক্সের অন্য একটি পাতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কেনা দুটির পাতার লেখায়ও ভিন্নতা দেখা যায়।

সন্দেহজনক ওষুধের বিষয়টি জানিয়ে আসল-নকল শনাক্ত করতে সহযোগিতার অনুরোধ করে ২১ জুলাই সকালে এসিআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে ইমেইল করা হয়। একইদিন বিকেলে এসিআইয়ের প্রোডাক্ট ম্যানেজার শুভাগত পরিচয়ে একজন ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে ফোন করে নকল ওষুধ সন্দেহ হওয়ার কারণ জানতে চান এবং ওষুধের আরও ছবি পাঠাতে বলেন। কারণ বলার পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে আরও ছবি পাঠানো হলে চট্টগ্রামে কর্মরত তাদের একজন প্রতিনিধি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করবেন বলা হয়। তিন দিনেও দেখা না করায় ২৫ জুলাই শুভাগতকে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তখন তিনি লিখে পাঠান, ‘আমি জানাবো।’ এভাবে একাধিকবার যোগাযোগ করার পরও এসিআইয়ের কেউ আর আসল-নকল শনাক্ত করতে আসেননি।

একইভাবে ওষুধের পাইকারী বাজার হাজারী গলি ও বাইরে থেকে কেনা স্কয়ারের সেকলো, অপসোনিনের ফিনিক্স ২০, ইনসেপ্টার প্যানটোনিক্স ২০ ও বিকনের ওভোকাল-ডি- এর মধ্যে পার্থক্য পাওয়া গেছে। সন্দেহজনক ওষুধগুলো যাচাই করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে গত ২১ জুলাই ইমেইল করা হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কেউ সাড়া দেয়নি।

              >>> নকল-অবৈধ ওষুধ কী দিয়ে বানানো হয়, তা পরীক্ষা করে দেখার উপায় নেই দেশে; এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়ুন  ‘ওষুধ পরীক্ষার নামে প্রহসন!শিরোনামের পার্শ্বপ্রতিবেদনে। 

 

অভিযোগ আছে, গ্রাম থেকে শহর এভাবে নকল-ভেজাল ওষুধের রমরমা কারবার চলার কারণ নকল ওষুধ চক্রকে যথাযথ আইনের আওতায় না আনা। আর এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে সারাদেশে ওষুধের দোকান নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি- চাঞ্চল্যকর এই তথ্য উঠে এসেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আয়োজিত ‘নকল-ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে কর্মপরিকল্পনা বিষয়ক আলোচনা সভায়’। ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই সভার কার্যবিবরণী একুশে পত্রিকার হাতে এসেছে।

এতে বেক্সিমকো ফার্মার তৎকালীন ডেপুটি ম্যানেজার (রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের বক্তব্যের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘বেক্সিমকো ফার্মা কোনো নকল ওষুধের সোর্স শনাক্ত করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানালে কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতি তাদের বিরুদ্ধে নানা কর্মকাণ্ড করে, যেমন বেক্সিমকোর ওষুধ নেওয়া বন্ধ করে দেয়।’

বেক্সিমকো ফার্মায় ১৫ বছর ৮ মাস চাকরির পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তুরস্কের পোলিফার্মায় প্রসেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন। নকল ওষুধ প্রতিরোধ করতে গেলে কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি কী কী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাধা তৈরি করে- জানতে চাইলে ১৯ জুলাই মুঠোফোনে শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এখন তুরস্কে চাকরি করি। দেশে বেক্সিমকোতে চাকরি করার সময় যেটুকু বলার ছিল, বলেছি। লিখিতভাবে জানিয়েছি। এখন এ বিষয়ে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকি আসতে পারে।’ এ কথা বলেই ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

এরপর একাধিকবার যোগাযোগের পর ৩ আগস্ট শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলা সম্ভব হয়। নকল ওষুধের সোর্স শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে গেলে বাধা আসা প্রসঙ্গে আবার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নকল ওষুধ বিক্রির খবর পেয়ে ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জানাই আমরা। এরপর ঔষধ প্রশাসন চাইলেও কোম্পানির লোকজন অভিযানে থাকতে চায় না, কার তথ্যে এই অভিযান সেটা জেনে ফেলবে বলে। এমন অবস্থায় ওষুধ প্রশাসনের লোকজন অভিযানে গিয়ে অনেক সময় বলে ফেলেন, আপনারা নাকি বেক্সিমকোর ওষুধ নকল করেন, দেখি বের করেন। আবার অন্য কোনোভাবেও ফার্মেসির মালিকরা তথ্যটি জেনে যেতে পারেন, কারা সোর্স। এভাবে তারা জেনে যায়। তখন তারা ধরে নেয়, ঝামেলাটা বেক্সিমকো করেছে। তখনই ঘোষণা দেয়, এখন থেকে বেক্সিমকোর সব ওষুধ বন্ধ। এরপর সেলস ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের বলা হয়, আপনারা কী করলেন? মার্কেটে তো ঢুকতে পারছি না। তখন নানাভাবে তাদের ম্যানেজ করে আবার ওই মার্কেটে ঢুকতে হয়।’

এই ভয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ নকল করলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয় না। যার প্রমাণ, নকল ওষুধ ধরা পড়লেও সাধারণত কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা করা হয় না। বাধ্য হয়ে মামলার বাদী হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু আসামির বিরুদ্ধে থানায়-আদালতে তদবিরকারী না থাকায় সেই মামলাগুলোর যথাযথ তদন্ত হয় না। একটা সময় পর দেয়া হয় দায়সারা অভিযোগপত্র; এমনকি চূড়ান্ত প্রতিবেদনও। এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে ‘নকল ওষুধ চক্র’। আর চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এই নকলবাজ চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আসছে কেমিস্ট-ড্রাগিস্ট সমিতির কিছু নেতা। একুশে পত্রিকার দুই মাসের অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

              >>> ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে কীভাবে ওষুধ নকলবাজরা পার পাচ্ছেন- তা পড়ুনঔষধ প্রশাসন ও পুলিশের যোগসাজশে ‘নকলবাজদের’ মুক্তি!শিরোনামের পার্শ্বপ্রতিবেদনে। 

 

নকল ওষুধ উদ্ধার হলেও মামলা করছে না কোম্পানি

চট্টগ্রামে নকল ওষুধ উদ্ধারের প্রতিটি ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশকে মামলার বাদী হতে দেখা যাচ্ছে। গত ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের হাজারী গলি থেকে নকল মোনাস টেন, নকল সারজেলসহ বিপুল নকল ওষুধ জব্দ হলেও সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়নি; যথারীতি মামলা করেছেন র‌্যাবের একজন ডিএডি (উপসহকারী পরিচালক)। সর্বশেষ গত ১২ মে চট্টগ্রামের হাজারী গলির দয়াময়ী মেডিকো ও একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এসএমসি’র ৬৮ হাজার ৮০০ প্যাকেট নকল ‘ওরস্যালাইন-এন’ উদ্ধারের ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় যে মামলাটি হয়, তার বাদীও থানার একজন এসআই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি সমীর কান্তি সিকদার বলেন, ‘নকল বা ভেজাল ওষুধ ধরার পরও কোম্পানি কেন মামলা করে না সেটি তারাই ভালো জানে। কোনো ওষুধ ভেজাল কি ভেজাল নয় তা বলবে ওষুধ কোম্পানি। তারা যদি না বলে আমরা বলে লাভ কী।’

অন্যদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসএমসি’র সেই ৬৮ হাজার ৮০০ প্যাকেট নকল ‘ওরস্যালাইন-এন’ মূলত উদ্ধার হয়েছিল ৯ মে দুপুরে হাজারী গলির দয়াময়ী মেডিকো থেকে। খবর পেয়ে হাজারী গলির কেমিস্ট-ড্রাগিস্ট সমিতির নেতারা ঘটনাস্থলে গিয়ে এসব নকল ওরস্যালাইন নিজেদের হেফাজতে নেন এবং ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন। তিন দিনেও এসব নকল স্যালাইন পুলিশের কাছে তুলে না দেওয়ায় ১১ মে দুপুরে হাজারী গলি ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা দয়াময়ীর সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানান।

একপর্যায়ে ১১ মে সন্ধ্যায় কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির কার্যালয় থেকে এসব স্যালাইন জব্দ ও সুজন কান্তি সিকদার নামে সীতাকুণ্ডের এক ফার্মেসি মালিককে আটক করে পুলিশ। তবে ঘটনায় জড়িত থাকার পরও দয়াময়ী মেডিকোর কাউকে ধরা হয়নি, এমনকি মামলায় আসামিও করা হয়নি। তবে এজাহারে উল্লেখ আছে, দয়াময়ী মেডিকেল হলের মাধ্যমে এসব নকল ওরস্যালাইন বাজারজাত করে আসছিলেন গ্রেপ্তার সুজন কান্তি সিকদার।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার এসআই মৃণাল কান্তি মজুমদার বলেন, ‘নকল স্যালাইনগুলো ৯ মে উদ্ধার হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। দয়াময়ী ফার্মেসির কেউ ঘটনায় জড়িত কিনা তা এখনও নিশ্চিত নই।’ এ ঘটনায় সুজন ছাড়া আর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি; সুজন কান্তি সিকদার আদালতে জবানবন্দিও দেননি বলে জানান তিনি।

এদিকে ৬৮ হাজার ৮০০ প্যাকেট নকল ওরস্যালাইন জব্দ করা হলেও এসএমসির পক্ষ থেকে মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামের সিনিয়র এরিয়া এক্সিকিউটিভ মনোয়ার হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি; যদিও নকল ওরস্যালাইন উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাকে সাক্ষী করেছেন মামলার বাদী কোতোয়ালী থানার এসআই নওশের কোরেশী। জানতে চাইলে এসআই নওশের বলেন, ‘এসএমসি কোম্পানি থেকে হায়ার অথরিটি কেউ আসেনি। চট্টগ্রামে কোম্পানিটির যে প্রতিনিধিরা ছিলেন, তারা বললেন আমরা তো আজকে আছি, কালকে নাই। আমাদের বাড়িও চট্টগ্রামে না। যার কারণে তারা মামলার ঝামেলায় জড়াতে চান না। তাই পুলিশ বাদী হয়েছে।’

এসআই নওশের আরও বলেন, ‘নকলবাজ চক্রের ভয়ে কোম্পানির লোকজন মামলা করতে চায়নি হতে পারে। নকলবাজদের সঙ্গে ঝামেলায় গেলে তাদের মার্কেটিংয়ে সমস্যা হতে পারে। আপস না করলে তাদের ক্ষতি করতে পারে। এরকম অনেক কিছু চিন্তা করে তারা হয়তো মামলা করেনি।’

একটি ওষুধ কোম্পানির পরিচালক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বড় কোম্পানিগুলোর প্রশিক্ষিত জনবল তো অনেক বেশি। তারা চাইলেই তাদের ওষুধ নকল করা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ফেলতে পারে, এটা তেমন কঠিন কাজ নয়। নকল ওষুধ কোন দোকানে পাওয়া যায়, এটা ওষুধ কোম্পানির মাঠপর্যায়ের কর্মীরা ভালো জানেন। কারণ ওই দোকানগুলো তাদের কাছ থেকে পণ্য নেয় না বা নিলেও কম নেয়। দোকানগুলো মনিটরিং করলে সহজে জানা যায়, কারা নকল ওষুধ সরবরাহ দিচ্ছে; তারা কোত্থেকে নকল ওষুধ আনছে। এভাবে নকল ওষুধের গোড়ায় গিয়ে বন্ধ করা যায়। কিন্তু কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির বাধার কারণে বড় কোম্পানিগুলো এই কাজটি ঠিকমতো করতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বড় কোম্পানির মার্কেট সার্ভিলেন্স টিম আছে, তাদের মূল কাজ হচ্ছে নকলবাজ ও নকল ওষুধ শনাক্ত করা। কিন্তু নানা বাধার কারণে তাদের কাজ সীমিত। যদিও নকলবাজদের কারণে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। তবুও বড় কোম্পানিগুলো এখন হয়তো ধরে নিয়েছে, তাদের ওষুধ ১০-২০ ভাগ নকল হবেই, কিছুই করার নেই। কারণ এগুলো বন্ধ করতে গেলে তাদের বিক্রি কমে যেতে পারে। কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির সঙ্গে ওষুধ কোম্পানিগুলো পেরে উঠবে না। এটাই বাস্তবতা।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে ওষুধ কোম্পানিগুলো আইনশঙ্খলা বাহিনীর কাছে বা আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারে। তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নকল ওষুধের বিস্তার লাভে ভূমিকা রাখছে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি!

নকল ওষুধের ব্যাপক বিস্তার লাভে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির ভূমিকার কথা স্বীকার করেন সমিতিরই বর্তমান পরিচালক জাকির হোসেন রনি; তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘একসময় আমাদের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি পদে এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি এসব নকল ওষুধের কারবারের মূলহোতা। তিনি মারা গেছেন। তাই তার নামটা বললাম না। কিন্তু এখন সে সুযোগ কমে গেছে। নকল ওষুধের ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সবাই জানে। কিন্তু সবাই তা স্বীকার করে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ওষুধ সমিতির নেতারাও সবসময় সঠিক কাজ করে তাও কিন্তু নয়। সমিতির অনেক নেতা ওষুধের ব্যবসার সাথে জড়িত নয়। লাইসেন্স বাণিজ্যও করে অনেকে। প্রশাসনের সাথে লিয়াজোঁ করে নকলবাজদের ছাড়িয়ে নেওয়া, মামলা থেকে বাঁচিয়ে আনা, নকল ওষুধ ধরার পর তা গোপন করা বা ম্যানেজ করার ঘটনাও হতে পারে। এটি অসম্ভব কিছু নয়।’

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘আমরা এখন ঠিক করেছি কেউ যদি নকলে জড়িত থাকে তার ড্রাগ লাইসেন্স থাকতে পারবে না। সে ভোটারও থাকতে পারবে না। তবে এটা সত্য যে সমিতির নেতারা সবসময় দোকানদারের পক্ষে থাকে। এটি ভুল না। এটি পলিসি। নকল ওষুধসহ কাউকে ধরার পর সাধারণ অপরাধ হলে আমরা প্রথমে তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করি। কিন্তু বড় অপরাধ হলে আমরা চুপ থাকি। মিডফোর্টে এরকম হয়। এটা টাকা খাওয়ার বিষয় না। এক ধরনের পলিসি। এখন ধরার পর আমি যদি বলি তাকে বেশি করে জরিমানা করেন, তাহলে তো একসময় আমি আমার কমিউনিটির বিরুদ্ধে চলে যাব।’

‘পুরোপুরি বিরুদ্ধে চলে গেলে পরেরবার ইলেকশনে আমার আসার সুযোগ নেই। তারা বলবে যে, সে তো আমাদের প্রতিনিধি হয়ে আমাদেরই স্বার্থের বিরুদ্ধে। তাকে নেতা বানানো যাবে না। তখন দেখা যাবে সমিতির নেতৃত্বে আবারও নকলবাজরা এসে যাবে। এ বছর আমাদের সমিতির নির্বাচন ঠেকাতে ঢাকায় যারা মামলা করেছে, তাদের বেশিরভাগ নকল ওষুধের সাথে জড়িত। কোটি কোটি টাকা তারা খরচ করেছে। নকলবাজদের সিন্ডিকেট শক্ত। সাতজন এমপি ওষুধ কোম্পানির মালিক। নকলবাজদের বিরুদ্ধে তারা কিছু করতে পেরেছেন?’ প্রশ্ন  রাখেন জাকির হোসেন রনি।

২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ‘কাউন্টারফিট মেডিসিন: অ্যা গ্লোবাল থ্রেট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ‘দ্য অ্যাকমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড’ এর হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট জাহাঙ্গীর হায়দার জানিয়েছিলেন, বিশ্বব্যাপী ওষুধ শিল্পের আকার আটশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। নকল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। নকল ও মানহীন ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন প্রায় ১২৪টি দেশের মানুষ। উন্নয়নশীল দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ মানহীন এসব ওষুধের কারণে প্রত্যক্ষভাবে আক্রান্ত। বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া প্রতি দশটি ওষুধের মধ্যে অন্তত একটি নকল ও মানহীন উল্লেখ করে ওই আলোচনা সভায় জানানো হয়, এমন ভেজালের কারণে বছরে পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-২০২১ অনুযায়ী, দেশে ২৮৫টি এলোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে কার্যক্রম চলছে ২০৬টিতে। ১৬টিতে উৎপাদন বন্ধ আছে। ৬৩টির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২০-২০২১ অর্থবছরেই ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন লাইসেন্স বাতিল করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সর্বোচ্চ ৫০টি এলোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানি মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের কেউ কেউ বড় কোম্পানিগুলোর ওষুধ নকল করে বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদিত ৭৯টি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কারখানায় বিভিন্ন নামিদামি এলোপ্যাথিক কোম্পানির ওষুধ নকল করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা সরবরাহ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা জানাতে পারেননি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন যারা করে, তারা তো অমানুষ। কেমিস্ট-ড্রাগিস্ট সমিতিতে আগে যারা ছিলেন, তারা নকলের সঙ্গে বেশি যুক্ত ছিলেন। তাদের বিদায় করেছি। গত এপ্রিলে তাদের নতুন কমিটি হয়েছে। তারা প্রশাসনকে নিয়ে অভিযান চালাবে বলেছে। যেসব ফার্মেসি নকল ওষুধ রাখবে, তাদের সদস্যপদ কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতি বাতিল করবে বলে কথা দিয়েছে। আশা করছি, এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে।’

নকলবাজদের বিরুদ্ধে ওষুধ কোম্পানিগুলো মামলা করছে না কেন, প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘মামলা করতে আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি; যাতে নকলবাজরা সহজে জামিন না পায়।’ তবে ওষুধ নকলবাজদের বিরুদ্ধে অতীতে কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা করার কোনো তথ্য তিনি দিতে পারেননি।

একইভাবে নকল ওষুধসহ বিভিন্ন সময় ধরা পড়া ফার্মেসি মালিকদের সদস্যপদ বাংলাদেশ কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতি বাতিল করেছে- এমন কোনো নজির সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও চট্টগ্রাম শাখায় ৩৫ বছর ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সমীর কান্তি সিকদার দেখাতে পারেননি।

জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ প্রণয়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা গণহত্যার মতো অপরাধ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নকল ওষুধ চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। যারা তদারকির দায়িত্বে আছেন, তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না।’