চট্টগ্রামে চার দশকে ২৪ হাজার পুকুর-জলাশয় ভরাট!

শরীফুল রুকন : চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ানবাজারের দেওয়ানজি পুকুর, ফিরিঙ্গীবাজারের ধাম্মো পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলীর সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর ও উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, ষোলোশহর হামজারবাগ এলাকার হামজা খাঁ দিঘি, খতিবের হাট পুকুর- এগুলো চট্টগ্রাম নগরের একেকটি এলাকার নাম। দিঘি-পুকুরের পরিচয়ে এলাকাগুলো আছে, কিন্তু একটি দিঘি-পুকুরেরও অস্তিত্ব নেই।

গত চার দশকে দিঘি, পুকুর, জলাশয় হারিয়ে আস্তে আস্তে বদলে গেছে চট্টগ্রাম শহর। ঘিঞ্জি এখন এ শহরের পরিবেশ। পানি ধরে রাখার, পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নষ্ট করে ফেলায় বৃষ্টি হলে পানিতে তলিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা। একসময়ের টিলা, ছড়া, দিঘি-পুকুরের শহর এখন বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৯৮১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর ও জলাশয় ছিল। কিন্তু একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরে মাত্র ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয় ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোরশেদ হোসেন মোল্লার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাভূমিতে স্থানিক ও অস্থায়ী পরিবর্তন’ নামে একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭ সালে শহরে মাত্র ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয় ছিল। বর্তমানে দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এনায়েত বাজার এলাকার রানীর দিঘি, আসকার দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আশকার দিঘি, আগ্রাবাদ ঢেবার দিঘি, মিনামার দিঘি, কর্নেল দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়া সুন্দরীর দিঘি, কাজীর দিঘি।

সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট আইন অমান্য করে চট্টগ্রামের হালিশহরের একটি পুকুর ভরাটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার পর দুজন শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যায় পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. মনির হোসেন বাদি হয়ে হালিশহর থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

মামলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরটির একাংশের মালিক দুই ভাই মো. জনি (৩৫) ও মোহাম্মদ জিসান (৩০) এবং ভরাটের কাজে নিয়োজিত দুই শ্রমিক মো. আকরাম (৩৮) ও মো. সোহাগকে (৩২) আসামি করা হয়। এদের মধ্যে দুই শ্রমিককে পরিবেশ অধিদপ্তর আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. মনির হোসেন বলেন, গত এক মাসে পুকুরটি প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ হাজার বর্গফুট ভরাট করা হয়েছে। আমার জেনেছি, মালিক জনি ও জিসানের নির্দেশে পুকুর ভরাটের কাজ চলছিল। অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুসারে, সরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কোন ধরনের জলাধার ভরাট করা নিষিদ্ধ। তারপরও জলাশয় ভরাট ও দখল বন্ধ হচ্ছে না। জলাধারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গত কয়েক দশকে চট্টগ্রামে টিউবওয়েলের সংখ্যা বেড়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, ২০০০ সালে নগরীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিউবওয়েলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০টি, যা চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৩৭টি। টিউবওয়েলের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে গেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, আগ্রাবাদ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০১১ সালে ২৪১ ফুট থেকে ২০২১ সালে ৩১২ ফুটে নেমে আসে। শহরের পাহাড়তলী এলাকায় ২০১১ সালে ১৩৬ ফুট থেকে ২০২১ সালে ২৭৪.৬ ফুটে নেমে আসে। খুলশী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২০১১ সালে ভূপৃষ্ঠের ২২০ ফুট নিচে ছিল, যা ২০২১ সালে ৩৪৫ ফুটে নেমে আসে। বায়েজিদ এলাকায় তা ২০১১ সালে ছিল ১৫৫ ফুট এবং ২০২১ সালে ১৯৮ ফুটে নেমে আসে।

এদিকে শুধু চট্টগ্রাম নগর নয়, জেলায়ও পুকুর-জলাশয় ভরাট থামছে না। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বড়দিঘিরপাড় আস্ত একটা পুকুর ভরাট করে ফেলেছেন আবুল কাসেম ও আবুল হাশেম নামে দুই সহোদর। ২০১১ সালে স্থানীয় কৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ ও অজিত কুমার ঘোষ থেকে মাছ চাষের কথা বলে ১ একর ২৪ শতক আয়তনের পুকুরটি কিনে নেন তারা। কিছুদিন মাছ চাষ করলেও ২০১৫ সালের দিকে পুকুরটি ভরাট করা শুরু করেন তারা। মাটি ভরাট করে পুকুরের চারপাশে নির্মাণ করা হয় সীমানা দেয়াল। আবার দুইভাগে ভাগ করে পুকুরের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় আরেকটি পাকা দেয়াল।

বছর তিনেক আগেও গুগল স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সেই পুকুরের অস্তিত্ব পাওয়া যেত। এখন সেই পুকুরের অস্তিত্ব নেই। বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গুগল সার্চ করলে এখন দেখা যাবে পুকুর নয়, যেন বাগানবাড়ি ও কৃষি জমি।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুকুর ভরাট করা দুই সহোদরের বাড়িও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘আহনের পাড়ায়’। পেশায় তারা ব্যবসায়ী। বড়ভাই লিয়াকত আলী ছিলেন স্থানীয় চিকনদন্ডী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। পুকুরটি ভরাটের সময় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আপত্তি জানালেও তারা পাত্তা দেননি।

স্থানীয় ভূমি অফিসের রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, চিকনদন্ডী মৌজায় পুকুরটির বিএস দাগ ৯৭৩৮। এই দাগের খতিয়ান নং ১৪৪৭। খতিয়ানে ভুমির পরিমাণ ১ একর ২৪ শতক, জমির শ্রেণি-পুকুর লিপিবদ্ধ আছে। বিএস খতিয়ান অনুযায়ী, এই পুকুরের মূল মালিক মনিদ্র লালের ছেলে কৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ, নারায়ণ প্রসাদ ঘোষ; বিমল কান্তি ঘোষের ছেলে অজিত কুমার ঘোষ ও রঞ্জিত কুমার ঘোষ। তাদের বাড়ি চিকনদন্ডী গ্রামে।

নথিপত্র দেখে জানা গেছে, হাটহাজারী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে ২০১১ সালের ৫ মে ৭৩৪/১১ নং নামজারি জমাভাগ মামলা মূলে ১ একর ২০ শতক পুকুরটির মালিক (সৃজিত খতিয়ান নং-৫৯২২) আবুল কাশেমের ছেলে মো. রফিক এবং তার চাচা আবুল হাশেম। স্থানীয় সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, দুই সহোদরের দখলযজ্ঞ থেকে বাদ যায়নি একই মৌজার অধীন বিএস ১১৫৫০ দাগের শতবর্ষী শ্মশানও। মাটি কেটে ফেলার ফলে শ্মশানটিও আজ বিলুপ্ত প্রায়।

জানা গেছে, শতবছর ধরে নাথপাড়া, কৃষ্ণ ঘোষ বাড়ি, দুর্গাপাড়া ও আশপাশের এলাকার পানির অন্যতম উৎস হিসেবে পুকুরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে এই পুকুরের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এছাড়া চিকনদন্ডী ইউনিয়নের পরিবেশ রক্ষায়ও এ পুকুরের বিশেষ অবদান ছিল বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া, আইন অমান্য করে পুকুরটি ভরাট করে ফেলেন আবুল হাশেম ও তার ভাই আবুল কাশেম। ভরাট করে ফেলা শতবর্ষী পুকুর-শ্মশান, পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ভরাটকৃত মাটি অপসারণ করে পুকুরটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবিও জানান তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ দাশ বলেন, ‘পুকুর ভরাট করে ফেলায় আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে। এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন হবে।’ নাথপাড়ার পাশের গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিলুপ্ত হওয়া পুকুরের অদূরে একটি টং দোকান পরিচালনা করেন। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘৭-৮ বছর আগে পুকুরটি ভরাট করে ফেলেন আবুল হাশেম। বিলুপ্ত হওয়া বিশালাকার পুকুরটি কৃষ্ণ ঘোষদের পুকুর হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিল।’

দিলীপ শীল নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘পুকুরটি ঘিরে যারা বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।’

পুকুর ভরাট এবং শ্মশান দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন আবুল হাশেম।

এদিকে হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়নে বিশাল আয়তনের পুকুরটি ভরাটের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘খতিয়ানে ভরাট করে ফেলা ভূমিটি পুকুর শ্রেণি হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলে স্থানীয়রা আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।’

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপক (গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি) ডক্টর মোহাম্মদ ফারুক রহমান বলেছেন, জাতিসংঘের একটি সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নির্বাহী সদস্য দেলোয়ার মজুমদার বলেন, আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালা শক্তিশালী করতে হবে। নগর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাশয় রক্ষার কাজ করতে হবে।