এম কে মনির : চট্টগ্রাম শহরের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বিপরীতে পাহাড় চূড়ায় চমৎকার একটি বাংলো। চারপাশে সবুজের সমারোহ। বাংলোতে ঢুকতেই পথে লম্বা করে লেখা আছে, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না’। এই লেখাটির পাশে পাড়া দিয়েই বাংলোতে ঢুকতে হয়। বাংলোর মূল দরজায় লেখা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার শিরোনাম, ‘অবনী বাড়ি আছো? এভাবে বাড়িটির পরতে পরতে শিল্প, ঐতিহ্যের ছাপ।
‘স্টোরি’ নামের একতলা ওই বাংলোতে থাকেন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা তারেকুল ইসলাম জুয়েল। সাজানো-গোছানো সে বাংলোকে বরং জাদুঘর বলেই মনে হলো বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হওয়া ১৯৪০ সালের আগের লোহার তৈরি জার্মান মোটরসাইকেল শোভা পাচ্ছে বাংলোটিতে। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম শহরে যখন মাত্র চারটি গাড়ি ছিল, সেই চারটি গাড়ির একটি আছে ওই বাংলোতে; গাড়িটি সেই সময় ব্যবহার করতেন জুয়েলের বাবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ এফ এম আমিনুল ইসলাম।
ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল, ঘরজুড়ে দুর্লভ সব জিনিস। যার মধ্যে নজর কাড়ে তাকে সাজানো ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা ‘ছোলতান’ এর একটি সংখ্যা। ছোলতানের এ সংখ্যায় রয়েছে ঐতিহাসিক বেশকিছু সংবাদ। তন্মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার যে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সেই সংবাদও আছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামে একটি কনসার্ট আয়োজন করেছিলেন। সেই আয়োজনের অরজিনাল পোস্টারও নিজের সংগ্রহশালায় এনে রেখেছেন তারেকুল ইসলাম জুয়েল। যা কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারকই নয়, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে এক টুকরো অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। জুয়েলের সংগ্রহে রয়েছে বেশকিছু পুরোনো ম্যাগাজিন।
এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর প্রকাশ হওয়া নিউজউইক ম্যাগাজিনের সংখ্যা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশ হওয়া ‘দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনের সেই সংখ্যা। তারেকুল ইসলাম জুয়েলের ‘জাদুঘরে’ আছে প্রাচীন আমলে তৈরি কাঠের বন্দুক, তবলা, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, একতারা, দোতারা, পুরোনো ল্যান্ডফোন, টেলিফোন, কুপি বাতি, বেহুলাসহ প্রাচীন অনেক যন্ত্রপাতি।
কালের বিবর্তনে অনেক পণ্যই হারিয়ে গেছে আমাদের সমাজ থেকে। এক সময় গ্রামগঞ্জে ঘরে ঘরে ছিল হারিকেন। সেই হারিকেন আজ দেখা যায় না। প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। হারিকেনের মতোই এমন অনেক পণ্য আছে, যেগুলো একসময় আমরা প্রচুর ব্যবহার করতাম। কিন্তু সেসব পণ্যের সাথে নতুন প্রজন্ম পরিচিত নয় তেমন। নতুন প্রজন্মকে পুরোনো এসব জিনিসপত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা তারেকুল ইসলাম জুয়েল নিয়েছেন এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
পথে-প্রান্তরে, দেশ-বিদেশে যেখানে যা কিছুই ব্যতিক্রম হয়ে ধরা পড়ে তাই নিজের সংগ্রহে নিয়ে নেন তারেকুল ইসলাম জুয়েল। আর তা সাজিয়ে রাখেন নিজস্ব সংগ্রহশালায়। শুধু সংগ্রহ করেই শেষ নয়; পুরোনো স্মৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসের স্মারক এসব জিনিসপত্রের সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতেও তারেকুল ইসলাম জুয়েলের ভূমিকা অনবদ্য। ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন নিদর্শন এমন অসংখ্য পুরোনো জিনিসপত্র সংগ্রহ করে চলেছেন তিনি।
আগেকার দিনের ধনাঢ্য পরিবারের মানুষেরা নানারকম গাড়ি ব্যবহার করতেন। অনেকেই ছোটবেলায় বাবার গাড়িতে স্কুলে যেতেন, বেড়াতে যেতেন। কিন্তু সেই গাড়ি এখন তাদের অনেকের কাছে আর নেই। আধুনিক নতুন মডেলের গাড়ির যুগে পুরোনো সেই গাড়ির ছবিও চোখের কল্পনায় ভাসাতে অনেকের বেশ কষ্ট হয়। অনেকের শৈশবের স্মৃতিমাখা সেরকম একটি গাড়ি ফেক্সিবল। যা সংগ্রহ করে পরম যত্নে রেখেছেন তরুণ উদ্যোক্তা ও সৌখিন এন্টিক সংগ্রাহক তারেকুল ইসলাম জুয়েল। তার সংগ্রহে থাকা এন্টিক এ গাড়িটি দেখলেই যে কেউ ফিরে যাবেন হারানো শৈশবে। গাড়িটিতে চড়লে অনেকের মনে পড়বে পুরোনো দিনে বাবার সাথে স্কুলে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়ার সেসব সুখস্মৃতি। ক্ষণিকের জন্য শৈশবে ফিরে যেতে পারবেন অনেকেই।
দেশের খ্যাতনামা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রয়াত প্রফেসর ডা. এ এফ এম আমিনুল ইসলামের সন্তান তারেকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এরকম একটি গাড়ি আমার বাবা কিনেছিলেন। সেই গাড়ি এখন আর নেই। একসময় মনে হলো এরকম একটি গাড়ি চাইলেই কি সংগ্রহ করা যায় না? তখন আমি অনেক খোঁজাখুঁজির পর খুলনা থেকে এরকম একটি গাড়ি পেয়ে যাই। গাড়ির মালিক বিদেশে চলে যাওয়ায় গাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তখন আমি গাড়িটি কিনে নিই এবং নিজে চালিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসি। এ গাড়িটি চালালে আমি সেই পুরোনো দিনে ফিরে যাই। অনুভূতি এমন যে বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন, আমি, মাসহ আমরা পাশে বসে আছি। সবাই গল্প করছি। এ গাড়ির সাথে আমার শৈশবের তথা জীবনের এক অন্যরকম সম্পর্ক।’
শুধু পুরোনো ফেক্সিবল কার গাড়িই নয়, তারেকুল ইসলাম জুয়েল তাঁর সংগ্রহে রেখেছেন মার্সিডিজ-২৩০ এর ই সিরিজের ১৯৮৫ সালের মডেলের গাড়িও। যা একসময় ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। গাড়ি ছাড়াও তারেকুল ইসলাম জুয়েলের সংগ্রহশালায় রয়েছে অনেক পুরোনো নানা ধরনের টেপরেকর্ডার, ফিতা ক্যাসেট, মিউজিক সিস্টেম। যা আগেকার দিনে সুরের মূর্ছনায় ঝড় তুলতো।
ছোটবেলায় আমরা অনেকেই হরেক রকম খেলনার পিস্তল নিয়ে খেলেছি। আজও সেসব কথা মনে পড়ে অনেকের। মনে পড়ে শৈশবের সেসব বন্ধুদেরও। সেসব খেলনার পিস্তল কি এখন আমাদের কাছে আছে? হয়তো নেই। কিন্তু সৌখিন এন্টিক সংগ্রাহক তারেকুল ইসলাম জুয়েল ছোট্টবেলার সেই খেলনার পিস্তলটিও সংরক্ষণ করে রেখেছেন যত্ন সহকারে।
আগের দিনে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা আমরা দেখেছি। তখনকার দিনে পাসপোর্ট সাইজের ছবি তোলা হতো বক্স সাইজের ক্যামেরা দিয়ে। ষাটের দশকের সেই ক্যামেরার প্রতি আকর্ষণ আমাদের আজও আছে। তবে আধুনিক স্মার্টফোনের উদ্ভাবনে সেই ক্যামেরা হারিয়ে গেলেও তারেকুল ইসলাম জুয়েল তা রেখেছেন নিজের সংগ্রহে। এমনকি ১৯২৭ সালের তৈরি পুরোনো ক্যামেরাও তিনি সংগ্রহে রেখেছেন।
১৯৩০ সালের সাইকেলগুলোতে এক ধরনের বিশেষ লাইট ব্যবহার করা হতো। যা আজকালের সাইকেলে চোখে পড়ে না। সাইকেলের সেই পুরনো লাইটও তারেকুল ইসলাম জুয়েল ময়মনসিংহ থেকে এনে তাঁর সংগ্রহে যোগ করেছেন। এছাড়াও বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা ও তোলা পুরোনো আলোকচিত্র, হাতে আঁকা ছবি, অটোগ্রাফ, ছোরা, চামচ, আগের দিনে রেলস্টেশনে ব্যবহার হওয়া তিন কাটার দেয়াল ঘড়িও তারেকুল ইসলাম জুয়েলের সংগ্রহশালায় দেখা মেলে।
তারেকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘আমাদের আজকের দিনটি অতীতের স্মৃতি থেকে সৃষ্টি। একটা সময় মনে হলো আমরা কেন পুরোনো দিনের সেসব জিনিসপত্র সংগ্রহ করব না। যেগুলোর সাথে আমার শৈশব কেটেছে, যেগুলোকে সঙ্গী করে আমার বেড়ে ওঠা। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল পুরোনো সেসবের সাথে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করানো উচিত আমাদের। সেই চিন্তা থেকে সংগ্রহ শুরু করি। একসময় তা নেশায় রূপ নেয়। আর তাই শুধু ছেলেবেলার জিনিসগুলোই নয় আমাদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত, সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকে ছিল এমন অনেক কিছুই সংগ্রহ করা শুরু করেছি। পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করতে পারলে নিজের ভেতর অন্যকরম আনন্দ অনুভব হয়। কোনও একটি সপ্তাহ কোনও পুরোনো জিনিস সংগ্রহ করতে না পারলে মনে হয় সপ্তাহটি বোধহয় ভালো যায়নি।’
তারেকুল ইসলাম জুয়েল আরও বলেন, ‘আমি আমার ডাইনিং টেবিলে যে ছয়টি চেয়ার আছে সেগুলোর নাম দিয়েছি গিন্নি, অতিথি, বাবা, মেয়ে, আমি ও মা এভাবে। কেউ মনে করতে পারেন, আমি একেকজনের জন্য একেকটি চেয়ার রেখেছি। আসলে আমি দেখতে চাই যখন আমি ডাইনিং টেবিলে খেতে বসি, তখন কোন কোন সম্পর্কগুলো আমার জন্য দোয়া করে, আমাকে ভালোবাসে, প্রেরণা ও শক্তি জোগায়। আর এন্টিক জিনিসপত্র সংরক্ষণের ব্যপারে যদি বলতে যাই, আমি সেই জিনিসগুলোই সংরক্ষণ করি যেগুলো কোনো না কোনো সময় আমার জীবনের অংশ ছিল। যে জিনিসটার সাথে আমার কখনও সংশ্লিষ্টতা ছিল না, এমন জিনিস আমি সংরক্ষণ করি না।’
সৌখিন এন্টিক সংগ্রাহক তারেকুল ইসলাম জুয়েল জীবনের মানে খুঁজে পান ট্রেনে ছড়া উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে ভ্রমণকারীর মাঝে। যে পথিক প্রত্যেকটি স্টেশনে নেমে নেমে ঘুরে বেড়ায় আর কিছু মানুষের সাথে কথা বলে, সময় অতিবাহিত করে, মায়ায় জড়িয়ে পড়ে, স্মৃতির ডায়েরিকে পরিপূর্ণ করে তোলে। এরপর ঘণ্টা কানে বাজলেই অন্য স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয়। এভাবে সেই পথিক এই স্টেশন থেকে ওই স্টেশন ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন। যখন একটি স্টেশন ছেড়ে অন্য স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে, তখনই সেই পথিককে পেছনের স্টেশনে কাটানো সময় ও মানুষের মায়া কাছে টানে। আর সেখানেই পথিক জীবনের মানে খুঁজে নেয়।
তারেকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘আমাদের চারপাশের সম্পর্কগুলোই জীবনের আসল মানে। এ সম্পর্কগুলোর জন্য আমাদের এ পরিভ্রমণ। এগুলো যদি না থাকে, সম্পর্কগুলোকে যদি মূল্যায়িত করা না হয় তাহলে জীবনের মানেই হয় না। আমি যখন শেষ গন্তব্যে পৌঁছাব তখন আমি সেই সম্পর্কগুলোকে চাই। যাদের মাঝে আমি বেঁচে ছিলাম, তাদের মাঝেই আমি চলে যেতে চাই।’