আজাদ তালুকদার : মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জেলা চট্টগ্রামের ডিসি। এমন একটা জেলার ডিসি হয়েও অতিশয় সাদামাটা তাঁর ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন। সন্তানদেরও গড়ে তুলছেন বিলাসব্যসনহীন এক জীবনধারায়।
অন্য দশজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা কিংবা বিত্তবানদের পথে হেঁটে নামিদামি স্কুল কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সন্তানদের পড়াতে পারতেন তিনি। কিন্তু না, সেই বিলাসী, চাকচিক্য পথে তিনি হাঁটেননি; দুই সন্তানকে তিনি পড়তে দিয়েছেন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে।
শহুরে জীবনধারায় অভ্যস্ত একজন সাধারণ চাকরিজীবীও সন্তানদের প্রাইমারি পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য শহরের সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে আস্থা রাখতে পারেন না। তারা হাউস টিউটরসহ এক সন্তানের পেছনে ন্যূনতম পাঁচ-দশ হাজার টাকা ঢালেন বিলাসী স্কুলে পড়াতে গিয়ে।
সে দিক বিবেচনায় ডিসি মোহাম্মদ মমিনুর রহমানই বোধহয় বাংলাদেশে অনন্য, একমাত্র ব্যতিক্রম; যিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও, তথাকথিত জৌলুস ও প্রাচুর্যের প্রাচীর ভেদ করে দুই সন্তানকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তে দিয়েছেন। তাদের নাম হচ্ছে– আবদুল্লাহ আল নাফি ও আবদুল্লাহ আল নূর।
ডিসি মমিনুর রহমান দম্পতির জমজ এই দুই সন্তান বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর একটি প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বাবার পোস্টিং হওয়ার পর এখানেই তাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এই দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বড়জন ফায়াদ আবদুল্লাহ ঢাকা ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
এত এত নামিদামি স্কুল থাকতে দুই সন্তানকে প্রাইমারি স্কুলে কেন পড়তে দিলেন– এমন প্রশ্নে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের মত, ‘আমরাও প্রাইমারি স্কুলে পড়ে আজকের পর্যায়ে এসেছি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়লে যে শিক্ষিত হতে পারবে না, বড় হতে পারবে না ব্যাপারটি এমন নয়। এখানে মানসিকতাটাই হচ্ছে মুখ্য। সরকার প্রাইমারি স্কুল করেছে, প্রতিবছর শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। আর সেসব স্কুলে যদি আমরা সন্তানদের না পাঠাই, না-ই পড়াই তাহলে এতসব স্কুল করে কী লাভ? আমি ডিসি। আগে আমাকেই শোধরাতে হবে, আমাকেই পথ দেখাতে হবে। তবেই অন্যরা সে পথে হাঁটবে।’
‘তাছাড়া বর্তমান সরকার প্রাইমারি শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। কাজেই প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ এখন অনেক উন্নত। আগে উন্নত ছিল না, তা কিন্তু নয়। তবে এখন অনেক যুগোপযোগী হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে। তাই আমি সবাইকে আহ্বান জানাবো আপনার সন্তানকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পাঠান।’– যোগ করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান।
জানা গেলো, ডিসির ছোট দুই সন্তানের জন্য কোনো হাউস টিউটর নেই। মা-ই তাদের গাইডার, তাদের শিক্ষক। সংসার সামাল দিয়ে সন্তানদের নিয়মিত পাঠদান, শৃঙ্খলাপূর্ণ, আদর্শিক জীবন গঠনই তার প্রাত্যহিক কাজ। তিনি নিজেও বিলাসব্যসনবিমুখ, সাদামাটা জীবনে বিশ্বাসী। স্বামী-স্ত্রী দুজনই প্রচুর ধর্মকর্ম করেন। বোরকা পরতে অভ্যস্ত ডিসিপত্নী রাবেয়া নাহারের দুটির বেশি বোরকা নেই। কাপড়চোপড়, খাবার-দাবারেও নেই বাহুল্যতা, বিলাসিতা। অপচয় তো নেই-ই। সন্তানদেরও গড়ে তুলছেন কৃচ্ছ্রতাসাধনের মানসিকতায়।
এবার একটু ফ্লাশব্যাক করা যাক– প্রয়াত কামালুর রহমান ও রওশন আরার দম্পতির ছেলে মোহাম্মদ মমিনুর রহমান ছোটবেলা থেকে বাবা-মার আদর্শে বড় হয়েছেন। শৈশব কাটিয়েছেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও’র জন্মগ্রামে। তখন থেকেই তিনি ছিলেন অন্য দশ কিশোরের চেয়ে আলাদা। দারুণ শৃঙ্খলাপূর্ণ, অদম্য মেধাবী।
কথায় আছে মর্নিং শোজ দ্য ডে। অর্থাৎ সকাল বলে দেয় সারাদিনটা কেমন যাবে বা কেমন হবে। মমিনুর রহমানও কিছু একটা হবেন, দেশের জন্য কাজ করবেন সেটা পাড়া-প্রতিবেশি, স্বজন-শুভার্থীরাও জানতেন সেই তখন থেকে। বাস্তবেও তাই হয়েছেন মমিনুর রহমান। হয়েছেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ জনবান্ধব ডিসি, প্রজাতন্ত্রের সত্যিকারের মেধাশ্রয়ী কর্মচারি, সরকার ও রাষ্ট্রের অনুগত, বিশ্বস্ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন বেশ কর্মব্যস্ত থাকেন মমিনুর রহমান। কিন্তু এত কাজের চাপেও তিনি বিচলিত হন না। প্রেশার বোধ করতে দেখা যায় না। ফোন আসলেই মুহূর্তেই ধরেন। তাৎক্ষণিক ধরতে না পারলে ব্যাক করেন। একজন সাধারণ মানুষও তাঁকে ফোন করে পান; দুঃখের কথা, অভাব-অভিযোগের কথা বলতে পারেন। তিনি সানন্দে, সাগ্রহে তাদের কথা শোনেন এবং ব্যবস্থা নেন।
এ প্রসঙ্গে ক’দিন আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক আড্ডায় চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নানকে বর্তমান জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখা যায়। তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মমিন তুমি প্রশাসন ক্যাডারের গর্ব। আমিও এখানে ডিসি ছিলাম, অনেকেই ছিলেন। কিন্তু তোমার মতো আর কেউ এত সুনাম অর্জন করতে পারেনি। তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়।’ জবাবে বিনয়ী ডিসি বলেন, ‘না স্যার, আমি তেমন কিছুই নয়। সরকারের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি, জনগণের সার্ভেন্ট। সমস্ত প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠেই এই নীতিতে চলে, সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি-ব্যস এইটুকুই। স্যার দোয়া করবেন, শেষদিন পর্যন্ত যেন এমনই থাকি, থাকতে পারি।’- যোগ করেন ডিসি মমিনুর রহমান।
মমিনুর রহমান ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শেষে ভর্তি হন ইসলামিয়া হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন গফরগাঁও সরকারি কলেজে। ১৯৯০ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি সাহিত্যে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুই মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে দু-একটি চাকরি করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ২২ তম বিসিএস (প্রশাসন) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধাতালিকায় প্রথম হয়ে ২০০৩ সালে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। কাজ করেন নানা পদে, নানা অঞ্চলে। চাকরি করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মএলাকা টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের উপজেলায় ইউএনও হিসেবে।
২০১৫ সালে তিনি গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ছিলেন; সেই পদ থেকে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব পদে বদলি করা হয়। তিনি ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ৫ম গ্রেডে বেতন পান। এটি তাঁর মেধা, সততা, বিশ্বস্ততারই ফল বলে মনে করেন সহকর্মীরা।
এর আগে ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে যোগদান করার আগে মোহাম্মদ মমিনুর রহমান উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৭ সালের ২৩ এপ্রিল জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব পদে দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৭ সালের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে বদলি হন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত।
চট্টগ্রামে ডিসি হয়ে আসা প্রসঙ্গে মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আমাকে চট্টগ্রামের ডিসি করে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামে তাঁর অনেক স্মৃতি আছে, আছে এই জনপদের মানুষের প্রতি বাড়তি অনুরাগ, ভালোবাসা। চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, যাও, চট্টগ্রামের মানুষের সেবা করো, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে এগিয়ে নাও।’
বলেন, ‘চাকরির কারণে যেখানেই গিয়েছি দেশের স্বার্থ, জনস্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করেছি। যতদিন চাকরিতে আছি, যেখানেই থাকি এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাব।’
আর এই মনোবৃত্তির উপর দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন ডিসি মমিনুর রহমান। হাতে নিয়েছেন বহু চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প-কর্মসূচি। ঐতিহ্যবাহী পরীর পাহাড় সংরক্ষণে এগিয়ে আসা থেকে শুরু করে ‘মিনি সেক্রেটারিয়েট ফর চট্টগ্রাম’ গড়ে তোলার উদ্যোগও নিয়েছেন তিনি। ওই প্রকল্পে ৭৩ দশমিক ৪২ একর জমির ওপর গড়ে উঠবে ৪৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত দপ্তর। এছাড়া জঙ্গল সলিমপুরের আলীনগরকে ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডিসি মমিনুর রহমান। সেখানে খাস জমিতে সিঙ্গাপুরের আদলে ‘নাইট সাফারি পার্ক’ গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, স্পোর্টস ভিলেজ, ক্রিকেট স্টেডিয়াম, আইকনিক মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনার প্রস্তাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে।
এসব মহাপরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে কখনো-সখনো রাতের ১০টা-১১টা পর্যন্ত অফিস করেন তিনি। মিষ্টভাষী, ভদ্রজন, সদালাপী, সহকর্মীবান্ধব মনন-মানসিকতায় সহকর্মীরাও তাঁকে নিয়ে গর্বিত। তাঁর কয়েকজন সহকর্মী বলেন, চাকরিজীবনে এমন বস বা অভিভাবক পাওয়া সত্যিই গর্বের বিষয়। স্যারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা শিখছি। তাঁর যে কোনো আদেশ আমাদের জন্য শিরোধার্য। স্যারের সঙ্গে রাতের ১১-১২ টা পর্যন্ত অফিস করতেও আমাদের খারাপ লাগে না। মোদ্দাকথা, স্যারের কোনো কিছুই আমাদের কাছে পীড়ন মনে হয় না। স্যার আসলেই সত্যিকার অর্থে প্রজাতন্ত্রের অলংকার, গর্ব।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে দু’বার ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবারসহ মোট তিনবার পবিত্র ওমরা পালনের কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, মানবিক, কল্যাণকর কাজের পাশাপাশি ধর্মকর্মও আমার দুর্বলতা ও আগ্রহের বিষয়। তাই জমানো ছুটি দিয়ে স্ত্রী, তিন ছেলেকে নিয়ে আল্লাহ আমাকে তিনবার পবিত্র ওমরাহ পালনের সুযোগ দিয়েছেন। এজন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।